আমার সিদ্ধান্ত নেয়া

অপ্রত্যাশিত সব জায়গা থেকে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপারটা হয়তো কেবল আমার সাথেই ঘটে না। তাই ‘বড়’ হবার পর থেকে যে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমার যে কথাগুলো মনে পড়ে, সেগুলো লেখা ছিল অনেক ছোটবেলায় পড়া কোন এক বইতে। জেরোম কে জেরোমের লেখা ‘থ্রি মেন ইন আ বোট’এর এক অনুবাদ বেরিয়েছিল সেবা কিংবা প্রজাপতি প্রকাশনীর ‘কিশোর ক্ল্যাসিক’ সিরিজে – ‘ত্রিরত্নের নৌবিহার’। আমার জীবনে পড়া সবচাইতে দম-ফাটানো হাসির বইগুলোর একটা থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়ার মতন গুরুগম্ভীর কাজটা শিখেছি, কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা?

স্মৃতি থেকে যদ্দুর মনে পড়ে, ঘটনাটা এমন – তিন/চার বন্ধু মিলে যাবে নৌভ্রমণে। এখন দরকারি কী কী জিনিস সাথে নিতে হবে তার তালিকা করে, একে একে সব একসাথে করতে বসে দেখা গেলো পাহাড়সমান জিনিস! এত কিছু সাথে নিতে হলে নৌকাডুবি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

সমস্যা সমাধানের জন্য মাথা ঘামাতে গিয়ে শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো, তাদের অ্যাপ্রোচটাই আসলে ভুল। তাদের উচিত নৌভ্রমণের জন্য কী কী লাগবে সেগুলোর হিসেব করা নয়, বরং কী কী না হলে চলবেই না তার তালিকা করা।

making-decisions

কোন ব্যাপারে মনস্থির করার জন্য মাত্র এক বাক্যের ছোট্ট এই কথাটা অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও, এখনো ভুলি নি। এটা আমার এত বেশি প্রিয় যে, সুযোগ পেলেই এই গল্পটা বলি আমি মানুষকে। আমি অনেক বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি সন্দেহ নেই, কিন্তু কপালটা এমন যে জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তগুলো যখন নিয়েছি, তখন রীতিমত একাই ছিলাম। অনেক বেশি স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই হয়তো কেউ কখনো নাক গলাতে আসে নি, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে আসে নি। তখন দারুণ কাজে দিয়েছিল এই ছোট্ট টিপ্‌স। একদম প্রিয়তম বন্ধুর মতন।

নিজের বিয়ের জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না যখন, তখন প্রথমবারের মতন বিয়ের প্রস্তাব পাবার পরে একটা প্রশ্নই করেছি নিজেকে, আমার যা না হলে চলবেই না তা কি আমি পাচ্ছি? আমার কী চাই তার তালিকা করতে গেলে নিশ্চয়ই অনেক বড় হতো, কিন্তু কী না হলে চলবেই না ভাবতে গিয়ে তালিকা ছোট হতে হতে গিয়ে ঠেকেছিল এক কি দুই লাইনে। তাই ‘পরে যদি আরো ভালো পাই’ কিংবা ‘আরো বেশি চাওয়া পূরণ না করি কেন’ এসব না ভেবে সেই প্রথমবারেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।

এইচএসসির পর কী নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই সে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়েও সামান্য হলেও সাহায্য পেয়েছিলাম এই কথাটা থেকে। যদিও বয়স কম হওয়ার কারণে জানি না কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি।

এমন কিন্তু না যে এই কথাটা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিই বলে আমার সব কাজ ঠিক হয় কিংবা সিদ্ধান্তগুলো আসলেই নিখুঁত হয় (আর সিদ্ধান্তের যে সবসময় ঠিক-বেঠিক থাকে, তাই বা কে বলতে পারে?)। কিন্তু অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সময়ে দারুণ সাহায্য করে এটা মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে। আবার পরে অনেক আক্ষেপের সম্ভাবনা থেকেও বাঁচায়। স্বার্থসংশ্লিষ্ট চিন্তা থেকে দূরে রাখে, আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যেটা – অপূর্ণতার অনুভূতি থাকে না বললেই চলে!

অনেক চাওয়ার মাশুল হিসেবে নৌকাডুবি যেন না হয়, তাই অল্পতেই তুষ্ট থেকে, অল্প চাওয়া পূর্ণ করে জীবনের চমৎকার নৌভ্রমণ যথাসম্ভব উপভোগ করাই হয়তো ভালো।

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

12 Responses to আমার সিদ্ধান্ত নেয়া

  1. অক্ষর বলেছেনঃ

    :huzur:

    দ্য গ্রেট ‪#‎সামিরা‬ ইজ ব্যাক! এই লেখাটা পড়ে অনেক কথা মনে পরে গেছে! কিছুটা খারাপ লাগাও কাজ করছে। নিজের ছোটবেলার কথা মনে পরে গেছে, আগে বোধহয় আমি আরও ভালো ভালো সিদ্ধান্ত নিতাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে কনফিউশন বাড়ছে প্রচুর ! হয়তো “শিক্ষা” বেশি পাচ্ছি অথবা “চিন্তা-ভাবনার বিক্ষিপ্ততা”ও একটা কারণ হতে পারে। তবে কিছু কথা খুবই সত্য যে আমার জীবনে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা অনেক বেশি ছিল, এমনকি নিজের পড়াশোনা, কোথায় কি পড়বো (শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় না, স্কুল-কলেজেও) , কেন পড়বো, কিভাবে পড়বো, এই প্রায় সব ডিসিশনই আমার নেওয়া, সাথে আম্মুর সাপোর্ট। তবে মনে হয় কিছু সিদ্ধান্ত খুব বেশি একা নিয়ে নিয়েছিলাম, কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে এতটাই দ্বিধান্বিত ছিলাম যে এখনও মাঝে মাঝেই ভাবি ঠিক কতটা ভুল করেছিলাম!
    “নিজের বিয়ের জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না যখন, তখন প্রথমবারের মতন বিয়ের প্রস্তাব পাবার পরে একটা প্রশ্নই করেছি নিজেকে, আমার যা না হলে চলবেই না তা কি আমি পাচ্ছি? আমার কী চাই তার তালিকা করতে গেলে নিশ্চয়ই অনেক বড় হতো, কিন্তু কী না হলে চলবেই না ভাবতে গিয়ে তালিকা ছোট হতে হতে গিয়ে ঠেকেছিল এক কি দুই লাইনে। তাই ‘পরে যদি আরো ভালো পাই’ কিংবা ‘আরো বেশি চাওয়া পূরণ না করি কেন’ এসব না ভেবে সেই প্রথমবারেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।”
    এই ছোট্ট কয়েকটা লাইন বোধহয় সামনে আমাকে ভালোই সাহায্য করবে। ধন্যবাদ আপি, কে বলছে লেখা কিছু করতে পারে না

  2. ক্ষণভাবনা বলেছেনঃ

    কী কী লাগবে সেগুলোর হিসেব করা নয়, বরং কী কী না হলে চলবেই না তার তালিকা করা।

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    ওয়েলকাম ব্যাক!
    😀

  4. স্রোতস্বিনী বলেছেনঃ

    কতবার যে পড়লাম হিসেব নেই… পড়লাম আর বারবার নিজের ভুলগুলোর কথা ভেবে কষ্ট পেলাম !! প্রয়োজনের সময় নিজেকে স্থির করাটা খুব জরুরি…
    “অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সময়ে দারুণ সাহায্য করে এটা মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে। আবার পরে অনেক আক্ষেপের সম্ভাবনা থেকেও বাঁচায়।”
    নেক্সট টাইম মাথায় থাকবে ইনশাল্লাহ…
    “কী কী লাগবে সেগুলোর হিসেব করা নয়, বরং কী কী না হলে চলবেই না তার তালিকা করা।” 🙂

  5. তরঙ্গ বলেছেনঃ

    ওয়াও!! অসাধারন লেখা। লেখাটা ছোট হলেও একটা সম্পূর্ণ লেখা মনে হয়েছে। এই লেখা থেকে আমার অনেক কিছুই শিখার আছে… আপনার কাছে এরকম চমৎকার লিখা আরো আশা করি। আপনার নৌকা ভ্রমন শুভ হোক। 🙂

  6. শারমিন বলেছেনঃ

    ওয়েলকাম ব্যাক :love:
    দারুণ লিখা :love: 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।