রূপকথাঃ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অশ্রু

চোখ খুলল সে। সেই পরিচিত ঘুম জড়ানো কিছু দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে উঠল সে বিড়বিড় করে। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে মোবাইলটা খুঁজে বের করে কাঙ্ক্ষিত নম্বরে মেসেজ পাঠানোর উদ্দেশ্যে টাইপ করা শুরু করল।

কয়েক সেকেন্ড পরেই স্ক্রীনে পুরো বিষয়টা দেখতে থাকা ফ্র্যাঙ্কের মেসেজ টোনটা বেজে উঠল।

“উঠি… খাইসো?”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ফ্র্যাঙ্ক। তার এতদিনের পরিশ্রম বোধহয় সাফল্যের মুখ দেখল। তাঁর লিওনা ফিরে এসেছে তার কাছে। আকার-আকৃতি-কণ্ঠস্বর সব ঠিক আছে। অনুভূতিগুলো নির্ধারিত হয়েছে অ্যালগরিদমের মারপ্যাঁচে। অ্যাকসিডেন্টের ঠিক আগের দিন পর্যন্ত মেমরি দেওয়া আছে ওর ভেতরে। নিজের হাতে একটু একটু করে বানানো রোবটটার দিকে তাকিয়ে ১০ বছর ৩ মাস আগের রবিবারে ফিরে গেল সে।

প্রথমবারের মত লং ড্রাইভে যাবে সেদিন ওরা দুজন। প্রথম কেনা গাড়ি ফ্র্যাঙ্কের, প্রথম রাইডটা লিওনার সাথেই করার পরিকল্পনা করে সে। সেই মোতাবেক খুব সকালে বাসা থেকে তুলে নেয় সে লিওনাকে। সাদা জামায় অপ্সরীর মত লাগছিল ওকে… কেবল আর এক দিন এই জামাটা পরেছিল সে… ফ্র্যাঙ্কের সাথে কাটানো প্রথম জন্মদিনে।

খুব রোমান্টিক কিছু গান বাজছিল… আর মাঝেমাঝেই স্টিয়ারিং থেকে একহাত সরিয়ে ফ্র্যাঙ্ক ছুঁয়ে দিচ্ছিল লিওনার হাত। হাইওয়ে ফাঁকা, তাই কোন সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না… লিওনার চুল উড়ে এসে আলতো স্পর্শে বারবার শিহরিত করে দিচ্ছিল ফ্র্যাঙ্কের চোখমুখ। এরকমই কোন এক মুগ্ধ মুহূর্তের পরিসমাপ্তিতে রাস্তা পার হতে থাকা মা বিড়াল এবং তাঁর মুখে ধরে রাখা বাচ্চাটা নজরে পড়ে ফ্র্যাঙ্কের। সর্বশক্তি দিয়ে স্টিয়ারিং ডানে সরিয়ে হার্ডব্রেক করে সে।
বিড়াল দুটিকে বাঁচাতে পেরেছিল কিনা সে খোঁজটা আসলে কখনও নেওয়া হয়ে ওঠেনি পড়ে আর ফ্র্যাঙ্কের। কারণ তাঁর নতুন কেনা নিশান গাড়িটা বেশ কয়েকটা ডিগবাজী দিয়ে রাস্তার পাশে হারানোর সময় বিড়াল দুটির চেয়েও অনেক প্রিয় কিছুকে নিয়ে চলে যায় তাঁর কাছ থেকে… চিরতরে।
প্রথম কয়েকটা দিন মোটেও সহজ ছিলনা। শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়ার পর বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে। কেন যেন প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। প্রতিটি ব্যর্থতার পর যেন বাতাসে ভেসে আসতে শুনে সে লিওনার গলা- “লুজার!” অবশেষে সে বুঝতে পারে এর অর্থ কী। লিওনা কখনোই চাইত না ফ্র্যাঙ্ক এভাবে নিজেকে শেষ করে দিক…

রোবট আগেও বানিয়েছে ফ্র্যাঙ্ক, কিন্তু মানুষের মত আবেগ অনুভূতি তাতে দেওয়া কখনোই পুরোপুরিভাবে সম্ভব হয়নি। এক অসম্ভবকে লক্ষ্য ধরে কাজ শুরু করে ফ্র্যাঙ্ক। লিওনাকে ফিরিয়ে আনবে সে, নিজ হাতে তৈরি করবে তাঁর ভালোবাসার রোবটকে।

দশ বছরের বেশি লাগল পুরো কাজটা শেষ করতে। কেবল রোবট বানানোই নয়, হিউম্যান স্কিন ইন্টিগ্রেশন একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সে কারো সাহায্য নেয়নি। একা একা শিখেছে সব। সাইকোলজি আর অ্যানাটমি নিয়ে পড়তে হয়েছে অনেকদূর; সাথে তাঁর প্রেমিকার জীবন নিয়েও অনেক স্টাডি করতে হয়েছে (এই কাজটা অবশ্য অনেক আগ্রহ নিয়ে করেছে সে)। তারপর সেগুলোর ভিত্তিতে বানিয়েছে জটিল সব অ্যালগরিদম। যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে লিওনার আবেগ-অনুভূতির অংশটুকু। ভেতরে সূক্ষ্ম তাঁর দিয়ে চামড়ার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। কেবল চোখের পানির অংশটা নিয়ে কাজ করা হয়নি। এটা ইচ্ছাকৃত। ফ্র্যাঙ্ক চায়নি তাঁর নিওনা আর কাঁদুক… কোনদিন।

সব কাজ ঠিক হওয়ার পর লিওনার বাসায় ওকে রেখে এসেছে সে। একটু আগেই পাওয়ার দিল সে দূর থেকে। লিওনার মেমরিতে দশ বছর আগের অ্যাকসিডেন্টের দিনের আগেরদিন পর্যন্ত মেমরি দেওয়া আছে- রোবট লিওনা তাই উঠে মনে করেছে তাঁর ঘুম ভাঙল মাত্র।
দশ বছর তিনমাস আগে এদিনে ওদের বের হওয়ার কথা ছিল একসাথে। লিওনা তাই একটু পর রেডি হবে। ফ্র্যাঙ্কেরও রেডি হওয়া উচিত। হাজার হোক দশ বছরেরও বেশি সময় পর ডেটে যাচ্ছে সে!

মুখোমুখি বসে আছে ওরা দুজন। সাগর পাড়ের এই রেস্টুরেন্টটা ওদের অনেক প্রিয়। প্রায়ই আসত এখানে। আরও একটি বিশেষ কারণে রেস্টুরেন্টটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওদের কাছে। পুরোপুরিভাবে চালু করার আগে রোবট লিওনাকে কখনও আবেগ নিয়ে ছুঁয়ে দেখেনি ফ্র্যাঙ্ক। দেখতে ইচ্ছে হয়নি আসলে।আসল লিওনার ভেতর একটা প্রাণের আলো ছিল…যেটা অনেক উজ্জ্বল। ওকে ছুঁয়ে দিলে সেই প্রাণের আভাটা জ্বলে উঠত, ভালো লাগার জায়গাটা ছিল ওখানেই। আজ খুব সন্তর্পণে লিওনার হাত ধরল ফ্র্যাঙ্ক–কী অনুভব করবে সে জানেনা।

ঝট করে হাতটা সরিয়ে দিল লিওনা- “ধরো ক্যান, হ্যাঁ? আমি কি ধরার জিনিস?” ভেতরে ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ফ্র্যাঙ্ক–যেভাবে আচরণ করার কথা, ঠিক সেভাবেই আচরণ করছে তাঁর লিওনা। অনেক বেশি আবেগ এসে ভর করল ওর উপর। এখান থেকে একটু দূরেই সাগর পাড়ে ও প্রপোজ করেছিল লিওনাকে- প্রায় তের বছর আগে। হাত ধরে সে টেনে নিয়ে এল লিওনাকে সেই জায়গাতে। অবাক লিওনা বড় বড় চোখে দেখল কীভাবে সেই প্রথম দিনটির মত সাগরের পানি আর বালুর মাঝে হাঁটু গেড়ে গোলাপ হাতে নিয়ে তাকে প্রপোজ করেছিল ফ্র্যাঙ্ক। তাঁর চোখ কাঁপতে শুরু করল…
বরাবরের মতই একটু বেশি আবেগী ছিল লিওনা। ফ্র্যাঙ্ক বুঝতে পারল, সে কাঁদতে শুরু করবে। ঝট করেই মনে পড়ে গেল তাঁর, যে চোখের পানির কোন ফাংশন রাখেনি তার লিওনার ভেতর। লজিকে এক্সেপশন খেতে যাচ্ছে সে- যেটার ফলাফল যেকোন কিছু হতে পারে। কারণ তার প্রসেসর তাকে কমান্ড দিচ্ছে কাঁদতে, কিন্তু সেই কমান্ড এক্সিকিউশনের কোন ব্যবস্থা ওর হাতে নেই।

বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হল ফ্র্যাঙ্কের রোবট লিওনা। প্রথমে মাথার পেছনে আর চোখদুটো, তারপর একটু একটু করে বাকি দেহটাও… ফ্র্যাঙ্কের দশ বছরের কাজের ফসল, তের বছরের ভালোবাসা…

বিস্ফোরণে ছিটকে সাগরের আরেকটু ভেতরে ছিটকে পড়েছিল ফ্র্যাঙ্ক। কানে তালা লেগে গিয়েছে, কিন্তু তারপরেও সে ডাকটা শুনতে পেল, এমন একটি নামে তাকে কেউ ডাকছে- যেই নাম কেবল একজনই জানত। আর কন্ঠস্বরটাও চিরপরিচিত।

 

ঘুরে তাকিয়ে লিওনার পরিচিত মুখটা দেখতে পেল ফ্র্যাঙ্ক।

মধ্যবয়স্কা লিওনা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। জীবন্ত। শেষ যখন দেখেছিল ওকে, তার চেয়ে ২০-২৫ বছর বড় মনে হচ্ছে তাকে দেখে।

লিওনাতুমি আজকে যা বানালে ১০ বছর ধরে, তা বানাতে আমার ১৫ বছর লেগেছে। ওয়েল ডান।

ফ্র্যাঙ্ক– (অবিশ্বাস্য চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে) তুমি?! কিন্তু কীভাবে…?? কে কাকে বানিয়েছে…১৫ বছর? কী বলছ এসব?

লিওনা– (বড় একটা দম নিয়ে) অ্যাকসিডেন্টে বেঁচে যাই আমি, কিন্তু ফ্র্যাঙ্ককে বাঁচাতে পারেনি ডাক্তাররা। কিন্তু বাঁচিয়ে রেখে আমাকে মৃত্যুর চেয়ে বড় শাস্তি দিয়ে যায়। এলোমেলো চিন্তা ছাড়া কোন স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারতাম না। ওই অবস্থায় চিন্তাটা প্রথম মাথায় আসে- তোমাকে তৈরি করার। কিচ্ছু জানতাম না এসবের-নিজে নিজে শিখতে হয়েছে। তাই হয়ত এত সময় লাগল। সারা পৃথিবীর কেউ জানেনা আমার এ কাজের কথা।

ফ্র্যাঙ্কতার মানে… আমি রোবট?

লিওনাহ্যাঁ, প্রথম দিকে কয়েকবার রিপেয়ার করতে হয়েছে তোমাকে। ছাদ থেকে লাফ দেওয়াসহ নানাভাবে নিজেকে ধ্বংস করার চিন্তায় ছিলে তুমি। তারপর তোমার ভেতরে প্রোগ্রাম সেট করে দিই যাতে তোমার উদ্দেশ্য হয় আমার মত কাউকে বানানো… দেখলাম আজ… ভালোই বানিয়েছ। ওরা সত্যিই বলে- মানুষের চেয়ে রোবট অনেক বেশি কার্যকরী।

ফ্র্যাঙ্ক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর স্রষ্টার দিকে। প্রচণ্ড অভিমান আর বেদনায় মাথা ঘুরে উঠল তার। চোখ ফেটে এখনি পানি বের হবে-বুঝতে পারছে। কিন্তু সে তার স্রষ্টার সামনে কাঁদতে চায়না।

চলে গেল আরও কয়েকটি মুহূর্ত। কিছু একটা গোলমাল লাগছে ফ্র্যাঙ্কের। বুঝতে পারছে না ঠিক। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল- লিওনার চোখ দুটো ছলছল করছে।

লিওনাদুঃখিত ফ্র্যাঙ্ক। তোমার মত আমিও আমার ভালোবাসাকে আর কাঁদাতে চাইনি। তাই তোমার চোখের পানির ফাংশনও আমি তৈরি করেনি।

তের বছর আগে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জায়গাটাতে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটল।

একটু আগে রোবট লিওনা যেভাবে বিস্ফোরিত হয়েছিল , ঠিক তেমনিভাবে বিস্ফোরিত হল তার স্রষ্টা রোবট ফ্র্যাঙ্ক।

 

সাগরের দিকে টলমল চোখে অগ্রসর হল মধ্যবয়স্কা লিওনা। প্রচণ্ড বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছে, যেগুলো বহুদিন কারো চোখ-মুখের স্পর্শ পায়নি।

আজ বাতাস আর লোনা পানি ছুঁয়ে দেবে ওদের। অনেক অনেক বাতাস।

 

frankenstine

ইতস্তত বিপ্লবী সম্পর্কে

যদি কখনো আমায় মনে পড়ে যায়,খোলো দুয়ার আকাশের-আমি তারাময়!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সায়েন্স ফিকশান, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to রূপকথাঃ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অশ্রু

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    খুব ইন্টারেস্টিং টুইস্ট।
    ভাল্লাগছে।

    ভবিষ্যতের গল্পের জন্য টিপ্সঃ
    আমাদের বাংলা অনলাইনে এত সব দারুণ তরুণ দারুণ আইডিয়া। এই চমৎকার আইডিয়াগুলাকেই নানান ভাবে লিখে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারেন। লেখার মান আরও অনেক বাড়বে।
    ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল একই লেখা ১০/১২ এডিট করে।
    তাই বলে আবার ফরএভার লেখা রেখে দেবেন না।
    ব্লগ তো লেখালেখির একটা অনুশীলনের জায়গা।

    • ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

      পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। প্রতিবারই ভাবি নিয়মিত হব, এবং প্রতিবারই ব্যর্থ হই। :thinking:
      তবু, চেষ্টা থাকবে, প্রমিজ। পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। 🙂

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    টুইস্টটা সত্যি ভালো ছিল
    বেশ ভালো লেগেছে 😀

  3. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    হায় খোদা! মাথা ঘুরতাছে… করছেন কি!

    অস্থির, মাথানষ্ট, সুপার্ব (ভদ্র কমেন্ট খুইজা পাইতাছিনা!)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।