ফিলিস্তিন, আমরা ও আমি

আজকে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো,

ফিলিস্তিন নিয়ে facebook এ প্রতিবাদ এর ঝড় উঠছে। আমি নিজেও এই প্রতিবাদ এর প্রতি সমর্থন জানাই। ইসরাইল কে ধিক্কার জানাই। তুই ও এর প্রতিবাদ করেছিস বলে স্বাগতম জানাই।

কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করছিস কিনা জানিনা, ইসরাইল এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ এর ঝড় উঠলেও ইরাক বা সিরিয়ার গণহত্যা অথবা পাকিস্তান এ তালেবান এর আত্মঘাতী বোমা হামলা নিয়ে সবাই অনেকটাই নিরব। তুই নিজেও এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করছিস কিনা জানিনা। এই মুহুর্তে আমার বা তোর হোমপেজ এ সবই ইসরাইল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এর পেজ। কিন্তু ইরাক, সিরিয়া অথবা পাকিস্তান নিয়ে প্রতিবাদ এর এক টা পেজ খুজে পাওয়া অনেক কঠিন। সবাই যেন এটা নিয়ে আনেকটাই উদাস।

এর পিছনে কি কারন থাকতে পারে তোর মনে হয়?

প্রথম কথা হল, I do not care much! এই জন্য করিনা না যে, আমি সরাসরি এফেক্টেড না; বরং এইজন্য যে, আমার তেমন কিছু করার নাই এবং আমার মাথা ঘামানোর অন্য আরো অনেক জিনিস আছে । যাহোক, আমি কেয়ার করলে উত্তরটা কেমন হত চিন্তা করে লিখেই ফেলি ।

(১)

ফিলিস্তিন ইস্যু একটা দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত একটা ইস্যু । প্রথমত, ইয়োরোপের এন্টি-সেমিটিক (ঈহুদি-বিরোধী) মনোভাব, বিশেষত সোভিয়েত ও নাৎসি দের অত্যাচারের ফলে সাধারণ ঈহুদিরা নিরাপদ আবাসের খোঁজ করতে থাকে । জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বেশ আগায়ে থাকলেও এবং অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হলেও নাৎসি বা সোভিয়েত কোন দুঃসাশনেই এসব ঢাল হিসেবে কাজ করে নাই । ঈহুদি-খৃষ্টান নির্বিশেষে এসকল দখলদারী টোটালেটারিয়ানরা সবাইকে কৃতদাসে পরিণত করে । কিছু সংখ্যক লোক নাৎসি বা সোভিয়েত শাষকগোষ্ঠির অংশ হয়ে সবার উপর ছড়ি ঘুরাতে থাকে; আর যারা এরকম ধান্ধাবাজি করতে পারে নাই, তাদের নিজ দেশে পরবাসী হয়ে দিন কাটাইতে হয় । সাধারণ জর্মন বা অস্ট্রিয়ান এমনকি পোলিশদের বাঁচার তাও তরিকা ছিল, হিটলারের দেশে ঈহুদিদের বাঁচার কোন উপায় ছিল না । সে শুরু করলো হলোকাস্ট ।

ঐতিহাসিকভাবে ঈহুদিদের প্রাচীন আবাসস্থল ফিলিস্তিন । মূসা (আঃ) এর সময় মিশরী ফারাওদের থেকে মুক্ত হয়ে এসে বনী ইসরাইল ফিলিস্তিনে বসবাস করা শুরু করে । সে সময়ের পরে, দাউদ (আঃ) ও সুলাইমান (আঃ) এর শাসনে ইসরাইল ও যুডিয়া দুই রাষ্ট্র বেশ ভালো অবস্থায় পৌঁছে । এরপর ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব রোমান, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে দাঁড়ায় । ওমর (রাঃ) ঈহুদিদের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস ও ধর্মকর্ম করার সকল সুযোগই দেন । কিন্তু, ৪র্থ খলিফার পর থেকে খিলাফাহ যখন প্রকৃত খিলফাতের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন পরিবারের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে তখন বিভিন্ন সময় ঈহুদিদের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপিত হতে থাকে । তারপরে, একসময় খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা পবিত্রভূমি ফিলিস্তিনে আক্রমন করা শুরু করে ও ক্রুসেডাররা নির্মমভাবে ঈহুদিদের মারতে থাকে । পরে বিখ্যাত আরব সেনাপতি সালাহউদ্দীনের হাতে ক্রুসেডারদের অত্যাচার বন্ধ হলে, বেশ কিছুদিনের জন্য ফিলিস্তিন শান্ত হয় । কিন্তু, ঈহুদিরা এসময় মিশর ও ইয়োরোপের বিভিন্ন জায়গায় মাইগ্রেট করতে থাকে । আস্তে আস্তে ফিলিস্তিন প্রধাণত আরব বসতি হয়ে উঠে । (দ্রষ্টব্যঃ দুহাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস খুব সংক্ষেপে এখানে লিখছি)

ঈহুদিদের নিরাপদ আবাসস্থল যখন দরকার, তখনই জিয়োনিজম চাঙ্গা হয়ে ওঠে । জিয়োনিস্ট আন্দোলন যত না ধর্মীয় তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক । মূসা (আঃ) তৎকালে মিশর থেকে এক্সোডাসের পর এক ‘প্রমিজ্‌ড ল্যান্ড’-এ নিয়ে যাবার কথা বলেন ও ফিলিস্তিনে নিয়ে যান । তার উপর ভিত্তি করেই, জিয়োনিস্টরা দাবী করে যে ফিলিস্তিন, তথা প্রাচীন ইসরাইল ও যুডিয়া এর অন্তর্ভুক্ত জমিই বনী-ইসরাইল এর আসল আবাসস্থল । তখন, এই অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব ছিল ব্রিটিশের । ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ব্রিটিশরা তাদের কলোনিগুলা আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়া শুরু করে, তখন জিয়োনিস্টদের চাপে পরে তারা ফিলিস্তিনের অঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ইসরাইল রাষ্ট্র ।

মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধশতাব্দব্যাপী সমস্যার শুর এখানেই । প্রথমতই, যেখানে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানে বসবাস করতো আসলে আরব (তথা ফিলিস্তিনি) রা । এখন, আপনার বাসাবাড়ি যেখানে সেটা যদি হঠাৎ কেউ নিয়ে নেয়, তখন আপনি যাবেন কই? ইয়োরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ঈহুদি রিফিউজিদের থাকার জায়গা করতে তাই লাখ-লাখ ফিলিস্তিনি (আরব) দের ঘরছাড়া করা হয় । একদঙ্গল ইচ্ছাকৃত রিফিউজির বদলে তৈরি হয়ে আরেকদঙ্গল হতভাগা রিফিউজির ।
সেসময়, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু আরব দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । এক, “ফিলিস্তিন তারা নিয়ে নিছে;” দুই, “ফিলিস্তিন দখল করার পর ফার্টাইল ক্রিসেন্টের আর জায়গা তারা দাবী করা শুরু করবে না, এর নিশ্চয়তা কি?” যাহোক, দীর্ঘকালীন সে যুদ্ধে ইসরাইল জিতে । কিন্তু ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না । আন্তর্জাতিক মহলের তদারকিতে তৈরি করা হয়, গাজা ও ওয়েস্টব্যাংক – যেখানে ফিলিস্তিন (আরব) রা থাকবে আর ইসরাইলের অন্যান্য অংশ – যেখানে ইসরাইলিরা থাকবে ।
কিন্তু সেটা মেনে চলতে নারাজ জিয়োনিস্টরা । পুরো অঞ্চল জুড়ে, তারা ঈহুদিদের আবাস গড়ে তুলে ও আরবদের থাকা অসম্ভব করে তুলে । খাবার, পানি, বাড়ি কিছুরই ব্যবস্থা নাই । নিজভূমে কারাবন্দী ফিলিস্তিনিরা ।

স্বভাবতই, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ আরব ও ফলশ্রুতিতে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় চেয়ে আসছে । এই বছর এসে, জিনিসটা অনেকবেশি আন্তর্জাতিক প্রচার পাচ্ছে । গত কয় দিনে, আম্রিকান সিনেটর, তারকা সঙ্গীতশিল্পী ও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পক্ষে সরব হয়েছে ।

(২)
১৯৭১ এ যখন মুক্তিযুদ্ধ হয়, আমাদের অবস্থাও তখন ফিলিস্তিনিদের মত । তখন, ফিলিস্তিন বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় । যদিও তাদের কিছু করার কোন ক্ষমতা ছিলনা; কিন্তু নৈতিক সমর্থন ছিল, প্রেরণা ছিল । এই কারনেই সম্ভবত, ইসরাইল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও বঙ্গবন্ধু সে স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেন ও ইসরাইল রাষ্ট্রকে অস্বীকার করেন । {জাতিসংঘের ৩২ সদস্যদেশ ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না । আবার ১৩৪ টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকার করে (পক্ষান্তরে ১৬০ দেশ ইসরাইলকে স্বীকার করে) । }
আমাদের আর কোন পররাষ্ট্রনীতি সুনির্দিষ্ট না হলেও এই এক ব্যাপারে আমরা একদম পরিষ্কার । ফিলিস্তিন আছে, ইসরাইল নাই ।

(৩)
ধান ভানতে শিবের গান গাইতে নাই ।

(৪)
ইরাকে ও সিরিয়ায় যে গণহত্যা হচ্ছে সেগুলো মোকাবেলা করতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পক্ষ ইতঃমধ্যে তৎপর । সবসময় ফলাফল আসছে যে তা না, কিন্তু প্রচেষ্টা আছে । সুতরাং, কারো দৃষ্টি আকর্ষণের কিছু নাই । এছাড়া, এইসব যারা ঘটাইতেছে, তারা তথাকথিত “সভ্য” গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী না ।

(৫)
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সমস্যার রুট (মূল) কারণ অনেকে মনে করে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা । এর সমাধান হলে বাকিগুলার সমাধানও হয়তো হবে ।

(৬)
ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু long overdue. আমার বন্ধুটি যে কয়টা সমস্যার দিকে নজর দিছে, সবগুলার সাথে মুসলিমরা জড়িত । কিন্তু, এই সমস্যাগুলা, ধর্মীয় না, রাজনৈতিক । আর সমস্যাগুলার সমাধান চাওয়াটা মানবিক । এটা ছাড়াও, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, ক্রিমিয়া, উত্তর কোরিয়া, বেলারুস, মধ্য আফ্রিকা ইত্যাদি নানা সমস্যার দিকেই আন্তর্জাতিক নজর একে একে দেয়া দরকার । সব জায়গার মানুষের পাশে দাঁড়ানো (মুসলিম হন আর না হন) সকল মানুষেরই উচিৎ ।

(৭)
হয়ত অবস্থা অনেক অনেক গুরুতর এখন -তাই এখন ফিলিস্তিন ইস্যু আমাদের চোখে বেশি করে পরছে । সুতরাং, ফেসবুকেও এর কাভারেজ বেশি পাওয়া যাবে ।


আশা করি আমার মহা মূল্যবান আলোচনা আমার বন্ধুটির (ও অন্যান্যদের) উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও দিছে । এর বেশি কিছু প্রশ্ন থাকলে, আমি আবারো আমার আসল পজিশনে, I do not care much.

পুনশ্চঃ ফিলিস্তিনে আরবদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেক বাঙালি ”মুসলিম” ভাই ‘প্রতিশোধপরায়ণ’ হয়ে ‘হিটলার’ কে নায়ক মানছে ও ঈহুদিদের উপর গণহত্যা সমর্থন করছে । এটা কোনক্রমেই উচিৎ কাজ না । সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কাম্য ।

রামাদানুল মুবারাক


লেখাটি মূলত ফেসবুকে নোট আকারে প্রথম লেখা হয়

প্রকৃষ্টপুত্র সাধ সম্পর্কে

আমি একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী ও প্রোগ্রামার; শখের বশে ছবি আঁকা, বই পড়া, আড্ডাবাজি এসব কাজকর্মের পাশাপাশি কখনো সখনো লিখালিখিও করে থাকি। সাধুবচনে আমি সাধুভাষায় লিখে থাকি আর আমার বিভিন্ন অপসাহিত্যের স্থান হয় সুলল সংগ্রহে । আমার নিয়মিত ব্লগঃ ইনসাইড দ্য ইনসাইট ॥ সরবে মাঝে মাঝে কিছু লেখা দেয়ার ইচ্ছা আছে — মন্তব্য সমাদৃত :)
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।