ভিড়-ভাট্টা আমার বেশ ভাল লাগে, নির্জন কোন জায়গায় আমি এক সপ্তাহও টিকতে পারবো না। মানুষের হৈ-হুল্লোরে উৎসবের আমেজ থাকে, সেটা আমাকে স্পর্শ না করে পারে না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় কয়েকদিন চলাচল করবার পর আমার মন মেজাজ পুরো উল্টে যায়, সারাক্ষণ মনে হয় এত মানুষ কেন রাস্তা-ঘাটে, পথ-ঘাটে হাঁটা যায় না, বাসে জায়গা নেই, জ্যাম কাটে না ঘন্টার পর ঘন্টা…মানুষ আর মানুষ!
এই শহরে আসলে কত মানুষ! লেখার আগে গুগলে খোঁজ নিলাম, হিসাব মতে দেড় কোটির চেয়ে বেশি, প্রতিদিন তার সাথে যোগ হয় আরো দেড় হাজারের মত মানুষ- হিসাব মতে আর পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে এ সংখ্যা দু’কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
ডেমোগ্রাফিক এসব রিপোর্টে’র উপর আমার খুব বেশি ভক্তি নাই, কারন প্রতি বার জনসংখ্যা জরিপে সরকারী আর জাতিসংঘের রিপোর্টে বেশ বড় অংকের পার্থক্য থাকে। আর আমার বিশ্বাস এখনকার রিপোর্টগুলোতে বড় ধরনের গোঁজামিল আছে, worldpopulationreview.কম এর হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালেই এ দেশে জনসংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে, আবার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলছে ২০০৮ সালেই এ দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি, অথচ আমাদের সরকারী হিসেবে এখনও ১৬ কোটি জনসংখ্যা হয় নি। ২০১১ সালের হিসেবে দেখলাম এক একটা হিসেবে ২-৩ কোটি মানুষের তফাৎ। আবার ২০০৫ এ থেকে ২০১১ এর বেশ কিছু হিসাব দেখে মনে হল জনসংখ্যা বরঞ্চ কমেছে।
কিন্তু আমরা জানি আসলে মানুষ অনেক বেড়েছে, আমি গত ৫ বছর ধরে সিলেটে আছি, প্রথম দুই বছরের তুলনায় সেখানে অনেক জ্যাম বেড়েছে, মানুষের ভীড় বেড়েছে, ঢাকায়ও বেড়েছে।
জরিপে কেন এরকম গোজামিল দেয়া হচ্ছে জানি না, তবে বিষয়টা যথেষ্ট ভীতিকর।কিছুদিন আগে ড্যান ব্রাউনের সর্বশেষ থ্রিলার ইনফার্নো পড়ছিলাম। এবারকার উপন্যাসের পুরো মনোযোগই ছিল আশু এ বিপর্যয় নিয়ে। পুরো পৃথিবীতে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে সেটা কতোটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তার সকল সম্ভাব্য দিকগুলো সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন ব্রাউন। আমাদের পৃথিবীর সত্যিকারের ধারন ক্ষমতা মাত্র ৪ বিলিয়ন মানুষ, অলরেডী সেটা দ্বিগুনের পথে। আর জনসংখ্যা বাড়ছে মূলত জ্যামিতিক হারে, তারমানে এভাবে বাড়তে বাড়তে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি আমরা, মানুষের মাঝে হানাহানি শুরু হয়ে যাবে, শুরু হবে বেঁচে থাকার স্বার্থে খুনোখুনি,মহামারী, দুর্ভিক্ষ।
আর বইটা পড়তে পড়তে আমি বার বার আঁতকে উঠছিলাম- কারন আর কিছু না, এই বিপর্যয় এর সবগুলি পৃথিবীর মাত্র একটা দেশে আঘাত করলেও সেটা আমাদের দেশ হওয়ার চান্স সবচেয়ে বেশি- কারণ আর কিছুই না, কয়েকটা ছোটখাট দ্বীপ রাষ্ট্র বাদ দিলে এ গ্রহের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ আমাদেরটা- সরকারী হিসাব মতেই। উন্নত দেশগুলো সযত্নে এসব বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাবে।
আর এই হানাহানি অলরেডি শুরু হয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। তা না হলে প্রতিটা ক্ষেত্রে এত দুর্নীতি কিভাবে হচ্ছে- রাজনৈতিক নেতারা পৃথিবীর সবদেশেই বিতর্কিত, কিন্তু আমাদের দেশে পাতি নেতা থেকে শুরু করে একেবারে সবাই কীভাবে এরকম ছ্যাচড়া দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠছে, কলেজ ভার্সিটির বাচ্চা বাচ্চা পোলাপাইন দুইদিনেই ছাত্র নেতা হয়ে খুন-খারাপি করে বেড়োচ্ছে, আবার তাদের শিক্ষকরাও দলাদলির স্বার্থে এসব ছেলেদের মাথায় নিয়ে নাচছে, বুক আগলে রক্ষা করছে, সরকারী আমলারা বৈধকাজের মত করে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিচ্ছে- সবাইকে জানিয়ে শুনিয়েই- যেন রীতিমত এটা তাদের ক্রেডিট। যে যেই সেক্টরে আছে সে সেই সেক্টরের দুর্নীতি নিয়ে হতাশ। আমি এখনো আমার স্বাস্থ্যখাতের ক্যারিয়ার সেভাবে শুরু করিনি, তারপরও আমি এই খাতের ছোট্ট একটা জায়গা আমার প্রতিষ্ঠানেরই যেসব দুর্নীতির কথা জানি সেগুলো সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করতে চাইবে না, এরকম প্রতিটা সেক্টরেরই একই অবস্থা।
আমি গত এক সপ্তাহে যে কয়বারই বাসে উঠেছি- প্রত্যেক বারই যাত্রী আর ড্রাইভার-কনডাক্টারদের অশ্লীল গালিময় ঝগড়া-ঝাটি শুনেছি, রাস্তাঘাটে, দোকানে সবাই হাই টেম্পারড, হিংস্র, কিংবা অসহায়। এগুলো সবই অবশ্যই কোন ফ্যাক্টরের সাইড এফেক্ট, বাড়ন্ত অগুনতি মানুষই এই ফ্যাক্টর আমি সেটা অনেকদিন থেকেই বিশ্বাস করি!
আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই, এদের চোখের সামনে দেশ ভাগাড়ে পরিণত হলেও এদের কিছু যায় আসে না, কারণ তারা তাদের আখেড় গুছিয়ে রেখেছে- ভবিষ্যতে এদেশে থাকতে না পারলে কোথায় গিয়ে থাকতে হবে-সেসব ব্যবস্থাও তাদের পাকা।
কিন্তু ভাবুন, চীনের ’এক সন্তান নীতি’ টাইপ পলিসি আমরা কত আগে থেকে শুনে আসছি, খোঁজ নিয়ে দেখলাম এটা ১৯৮৯ এর নীতি। কিছু ক্ষেত্র ছাড়া চীনের নাগরিকদের জন্য এটা বাধ্যতামূলক, আছে আরো নানা ধরণের পুরস্কার বা জরিমানা নীতি- তার ফলে তাদের জনসংখ্যা আস্তে আস্তে নেগেটিভ এ চলে যাচ্ছে। ভারতেও এসব ব্যাপারে অনেক কড়া হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব কিন্তু অনেককাল আগে থেকেই চীনের চেয়ে প্রায় ৮-৯ গুন বেশি! অথচ আমাদের দেশে এখনো কোন দৃঢ় বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ নেই!
কী আজব ব্যাপার !!
জরিপের এই ধোঁকা দিয়ে আমাদের কতদিন বোকা বানিয়ে রাখা হবে জানা নেই, তবে বিপর্যয় নিয়ে যদি এখনই আমরা ভাবতে শুরু না করি তবে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে..অনেক বেশি দেরি!
একটা ‘হয়তো অমূলক’ শংকা: কিছুদিন আগে এক জনসভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমাদের জনসংখ্যা নিয়ে বলতে গিয়ে বেশ বড় একটা সংখ্যা বলেন, পরপর দুইবার একই সংখ্যা বলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ইশারায় তার ভুল শুধরাতে বলেন। মন্ত্রী বার বার আমাদের দেশের জনসংখ্যার যে সংখ্যাটা বলেছেন সেটা ছিল : ৩০ কোটি!
তিনি হয়তো ভুলে এটা বলেছেন, তবে নিউজটা পড়ে বোকার মত একটা অজানা ভয়ে আমি শিউরে উঠেছি। খবরের লিংক: http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article805953.bdnews
একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
আমার দুই পয়সা
ড্যান ব্রাউন এর রিসার্চ খুবই দুর্বল জনসংখ্যা ইস্যুতে। তুমি একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই সম্ভবত ভুলগুলো পেয়ে যাবে।
১) চায়নার এক সন্তান নীতি সম্ভবত লম্বা সময়ের জন্য খুব একটা ভালো হবে না। চায়না নিয়ে ভয়াবহ লেখা এসেছে নিউজউইকে এই বছরেই। [২]
If China’s demographic trends hold, the country will probably scrap the policy by 2020, according to Zuo. “By 2025, the government will be encouraging people to have more children.” [১]
২) সরকারি ভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ইস্যুতে মানবাধিকার একটা বড় ব্যাপার। অনেক মেয়ে শিশুকে মারা হয়েছে এর ফলে।
৩) অর্থনৈতিক কারণেই আসলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যায়। এবং যাবে। এক্সপার্টদের ধারণা ২০৩০, অর্থমন্ত্রীর ধারণা ২০৪০/২০৫০ এর মধ্যে আমাদের জনসংখ্যা স্ট্যাবল হয়ে যাবে। [৩]
“So, the demographic and other indicators show that the country’s population to stabilize at 200 million within 2030 when total births and deaths will be same,” said the expert, adding, “this status quo would continue for another 30-40 years before it either reverses or goes otherwise.”
Finance Minister Abul Mal Abdul Muhith, who opened the conference, has had a different view as he said the population increase would come to a halt by 2040 or 2050. He, however, said the family planning was on the right track, but it requires further attention with promotion of male sterilization and permanent methods.
[১]http://www.theguardian.com/world/2014/jan/31/time-running-out-china-one-child-policy-exemptions
[২] http://www.newsweek.com/2014/01/24/one-child-policy-one-big-problem-china-245118.html
[৩] http://www.daily-sun.com/details_BD-population-likely-to-stabilize-at-20-crore-by-2030_315_5_0_3_24.html
উনার এই টকটা দেখতে পারো http://www.ted.com/talks/hans_rosling_on_global_population_growth
চীনাদের পলিসি নিয়ে বিতর্ক আছে সেটা উইকিপিডিয়াতেই দেখেছি, তাদের গ্রামীন সমাজের জন্য এটা রীতিমত অমানবিক, তাদের পলিসি পরে কিছু চেঞ্জও করেছে দেখেছি- যেমন প্রথম সন্তান মেয়ে হলে বা সুস্থ না হলে দ্বিতীয় সন্তান নেয়া যাবে টাইপ…যাইহোক আমি আসলে ওদের এই পলিসিকে সাপোর্ট করার জন্য লিখছি না, আমার উদ্দেশ্য চীন-ভারত ওভারপপুলেশন ব্যাপারটা নিয়ে যত চিন্তিত আমাদের স্বাস্থ্যনীতি অতটা স্ট্রং দেখলাম না, মানুষকে মোটিভেট করা, জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি সহজলভ্য করার মধ্যেই আছে…এটা আরো জোরদার করা উচিত ( সেটা যদিও সবাই স্বীকারও করে মুখে মুখে), কিভাবে উচিত সেসব নিয়ে অনেকের অনেক পরামর্শ আছে, সেটা হয়তো অন্য টপিক, মানবিকতার রেঞ্জে থেকেই সবকিছু করতে হবে অফকোর্স। দুইয়ের অধিক সন্তানের জন্য অতিরেক্ত করারোপের মতও পরামর্শ আছে- রিসোনেবল ওয়ে আরো আছে।
তবে কেউ যদি ওভারপপুলেশন ব্যাপারটাকে মিথ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চায় ( কিছু ধর্মীয় ও অন্যান্য গ্রুপের এ সংক্রান্ত প্রচারণা দেখেছি) তাহলে আমার কাছে ব্যাপারটা একধরণের অদূরদর্শীতা মনে হয়। কারন জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এটা কেউ চোখ বন্ধ করে থাকলেও অস্বীকার করতে পারবে না। গত ৬০ বছরেই পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে, আমাদের দেশেও তাই হচ্ছে, স্টাবলিটি আসবে এমন সম্ভাবনা আছে হয়তো, তবে সেটা ধরে নিয়ে নিশ্চিত থাকাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না মোটেও ..ওভারপপুলেশন নিয়ে অনেক উন্নত দেশ মাথা না ঘামালেও কোন সমস্যা নেই সেটা সত্যি, কিন্তু আমরাও কি সবচেয়ে বেশি জন-ঘনত্ব নিয়ে বাস করে
অর্থনৈতিক স্টাবলিটি আসবে তারপর জনসংখ্যা এমনিতেই কমে যাবে- এই অনিশ্চিত সম্ভাবনাকে ধরে বসে থাকাটা অ্যাফোর্ড করি?
সারা বিশ্বের তুলনায় আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানো তেমন ভালো না হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার হিসাবে বেশ এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ।
http://goo.gl/Si5d3O
এই ডাটা বেশ ভালভাবেই বলছে, যে জনসংখ্যা একসময় স্থির হয়ে যাবে। তবে, এজন্য শর্ত হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন।