অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে মা কায়সুন্নেসার মন। দরুদ পড়ে ফুঁ দেন পাগল ডানপিঠে ছেলেটের মাথায়। মায়ের দোয়া নিয়ে বেরিয়ে যান সদ্য তরুণ স্বপ্লালু সেই ছেলেটি।
নাহ আর ফেরা হয়নি সেই তরুণের। মা কায়সুন্নেসা পথ চেয়ে বসে ছিলেন বহু বছর।
২৮ অক্টোবর ভোররাত ১৯৭১
লেঃ কাইয়ুমের নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে ১২৫ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল। এই দলেই আছেন সেই দূরন্ত ডানপিঠে ছেলেটি। নাম তার হামিদুর।সুকান্তের আঠারো বছর বয়সের কাব্য যেন ঠিক আমাদের এই হামিদুরকে নিয়েই লেখা। দেশপ্রমে উদ্দীপ্ত সদ্য আঠারো পেরুনো এই যুবকের চোখে তখন হানাদার বদের জীঘাংসা। চোখের সামনে সে দেখেছিল তার মত ২৫ শে মার্চের রাতে তার মত আরো প্রায় দুই হাজার যুবককে পাকবাহিনী হত্যা করেছিল চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে।
বাড়ীর কাছে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ঘাঁটিতে সেনাদের নিয়মিত সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ করতে দেখে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছে ছিল তার সেই ছোট থেকেই। এইকারণেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারীতে সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর তাকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে।কিন্তু পঁচিশে মার্চের কালরাতে প্রশিক্ষণ রত সেসব নিরস্ত্র বাঙ্গালী যুবকের উপরও ঝাঁপিয়ে পরে হানাদার বাহিনী।অনেক কষ্টে নিজের জীবন বাঁচিয়ে যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তুত হন হামিদুর।মায়ের দোয়া নিতে এসেছিলন সেদিননের সেই মধ্যরাতে। ভোর হবার আগেই বেরিয়ে পরেন সেদিন।হামিদুরের চোখে আজো সেই ভয়ঙ্কর রাতের দুঃস্বপ্ন।
==============
লেঃ কাইয়ুমের নেতৃত্বে চলতে থাকা এই দলের লক্ষ্য ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল,এই ঘাঁটি দখল করলেই মুক্ত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সেখানে সতর্ক অবস্থায় আছে পাকবাহিনীর সদস্যরা। নিঃশব্দে তারা পৌঁছে যান ঘাঁটির কাছে। কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটে বিপত্তি।হঠাৎ পাকবাহিনীর পাঁতা মাইনে পা দিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বহু মুক্তিযুদ্ধের দেহ। পাকবাহিনীর কাছে পরিস্কার হয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি।শুরু হয় মুহুর্মূহ গুলী বর্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ।
দলনেতা কাইয়ূম বুঝতে পারেন জিততে হলে নিশ্চিহ্ন করতে হবে পাকিস্তানীদের সেই মেশিনগান পোস্ট। লেঃ কাইয়ুম জানেন এই মুহুর্তে দরকার এমন কাউকে যে পারবে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে এই অপারেশনকে সফল করতে। প্রথমেই তার মনে আসে হামিদুরের কথা। তার হাতে গ্রেনেড তুলে দায়িত্ব দেন সেই মেশিনগান পোস্ট ধ্বংসের।
দায়িত্ব পেয়ে পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে হামিদুর।বুকের নিচে কঠিন মাটি, চারদিকে সমানে চলছে গুলি৷ মাটির নিচ যেকোন সময় বিধ্বস্ত হতে পারে মাইন। এসব উপেক্ষা করে মৃত্যুকে পরোয়া না করে সিপাহী হামিদুর রহমান এসে পড়লেন একেবারে এলএমজিটার কাছাকাছি৷ দেখলেন, এলএমজিটার পেছনেই দুজন পাকিস্তানি সেনা৷ একবারও ভাবলেন না খালি হাতে একা দুইজন সসস্ত্র যোদ্ধাকে কীভাবে মোকাবেলা করবেন। এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন না তিনি। গ্রেনেড চার্জ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এলএমজি পোস্টের ওপর৷এলএমজি চালনায় নিয়োজিত দুই পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে শুরু হলো ধ্বস্তাধস্তি।
একসময় নিঃশব্দ হয়ে যায় মেশিনগান পোস্টটি। মুক্তিসেনারা ঝড়ের গতিতে ঢুকে গেলেন ধলই সীমান্ত ঘাঁটিতে৷ বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি পোস্টের কাছে দৌড়ে এসে পেলেন হামিদুর রহমানের মৃতদেহ৷ তাঁর পাশেই মৃত অবস্থায় পড়ে আছে দুই পাকসেনা। শহীদ হলেন হামিদুর,তার রক্তের মাধ্যমে অর্জিত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিজয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার হামিদুরকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধী প্রদান করে।
==============
হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। নীচু স্থানে অবস্থিত কবরটি এক সময় পানির তলায় তলিয়ে যায়।দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানের লাশটি পড়ে থাকে অনাদরে অগোচরে বিদেশের মাটিতে। আর এদিকে আমারা নিজেদের দেশের সংসদের মত পবিত্র জায়গার প্রাঙ্গণে সসম্মানে সমাহিত করি যুদ্ধাপরাধীদের।লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে এই কথা ভাবলেই।
===============
অবশেষে ২০০৭ সালের ২৭শে অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন করে।আরেকটি পাপ থেকে দায়মুক্তি ঘটে জাতির।
===============
একটি সুখী এবং সমৃদ্ধিশীল দেশের স্বপ্ন দেখতেন হামিদুর। সেই কারণে নিজের জীবন বাজী রেখে লড়েছিলেন এই অকুতভয় বীর যোদ্ধা। আসুনে এই বীর সেনার শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি এবং সেই সাথে এই দেশকে হামিদুরের স্বপ্নের মত করে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
লেখাটি একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন পেইজে প্রকাশিত।
ছোটবেলায় গল্পের বইতে পড়েছিলাম, আজ আবার পড়লাম | আমাদের মক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব সবসময়ই অনুপ্রেরনাদায়ী….
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।সেই সাথে আমার বাড়ীতে প্রথম অতিথি হবার জন্যেও। 🙂
পড়লাম লেখাটা।
কত অল্প বয়সে কত বড় আত্মত্যাগ, ভাবতে অবাকই লাগে।
ভাল লেখায় বানান ভুল একটু বেশি চোখে লাগে। ডানপিটে, বধ এরকম আরো কিছু শব্দ একটু ঠিক করে দেবেন? আর অভ্র দিয়ে লিখলে অভ্রের “spell checker” ব্যবহার করতে পারেন, অনেক ভুল ধরা পড়ে ওখানে।
আর প্রতি লাইন শেষে দাঁড়ির পর একটা করে স্পেইস হবে। 🙂
ওহ্, ভুলেই গেছিলাম বলতে! :welcome:
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
ধন্যবাদ। স্পেল চেকার আমি নিয়মিত ব্যবহার করি।খানিকটা তাড়াহুড়োতে থাকায় আজ সম্ভব হয়নি।
শুরুতেই বলি সরবে স্বাগতম! :welcome:
হামিদুর রহমান! আমাদের গর্বের নাম!
যাঁর রক্তে বাংলার পতাকা আরেকটু বেশী লাল।
যাঁর তারুণ্যে আমাদের পতাকা আরেকটু বেশি সজীব!
চমৎকার লাগল।
আমাদের এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার এবং *কাজ* করা দরকার।
“এবং সেই সাথে এই দেশকে হামিদুরের স্বপ্নের মত করে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।” ণ
আপনার লেখা একসময় নিয়মিত পড়তাম। মাঝে কেন যেন আর পড়া হয়নি।এখানে পেয়ে ভাল লাগলো। পড়ার জন্য,মন্তব্যের জন্য এবং স্বাগতমের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
কী মহান ছিলেন মানুষগুলো, যারা এই দেশের জন্য কত সহজে নিজের প্রাণ দিয়ে গেছেন। কিন্তু, আমরা কবে যে এই দেশটা সুন্দর করে সাজাতে পারবো। 🙁
আপনার লেখা পড়ে অনেক ভালো লাগলো।
সরবে স্বাগতম। :welcome:
ধন্যবাদ। 🙂
সরবে স্বাগতম। :welcome:
আমাদের এই বীরযোদ্ধার স্বপ্ন পূরণ হোক। নিজে যতটুকু পারি অবশ্যই তার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করব।
এমন বিশুদ্ধ স্বপ্ন ছড়িয়ে যাক আমাদের সবার অন্তরে।
Ditto.
সরবে স্বাগতম! :welcome:
“আসুন এই বীর সেনার শাহাদাৎ বার্ষিকীতে … এই দেশকে হামিদুরের স্বপ্নের মত করে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।”
দেশপ্রেমের কোন বয়স যে কোনো বয়স লাগে না তা আসলে বীরশ্রেষ্ঠদের এমন অসাধারণ গল্পগুলো পড়েই জানা যায়, শেখা যায়!
পড়বার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। 🙂