বৃহস্পতিবার অফিস করে বেরিয়ে হাটছিলাম। সামনে শুক্র-শনি দুইদিন ছুটি। অনেকদিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। বিশেষ একটা কারনে মানসিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছিল না। দূরে কোথাও পালিয়ে যাবার চিন্তা মাঝে-মাঝেই মাথাচাড়া দিচ্ছিল। আমার আবার ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা মনে হলেই সবার আগে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনের কথা মনে পড়ে। সেন্টমার্টিন যেহেতু যাওয়া যাচ্ছে না অতএব কক্সবাজার যাবো। যখন ডিশিসন ফাইনাল করলাম তখন সাড়ে সাতটা বাজে। যেই ভাবা সেই কাজ- বাসের টিকেট কেটে বাসায় ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে তারপরে বুয়েট ঘুরে সেখান থেকে বাস কাউন্টারে যেতে যেতে ধুম বৃষ্টি নামলো। বুয়েটে গিয়েছিলাম সজীবের ক্যামেরা আনার জন্যে- বাট ছেলে চার্জার না রেখে শুধু ক্যামেরা রেখে গেছে। অতএব ক্যামেরা নেয়ে হয় নি। বাস ছাড়লো রাত সাড়ে এগারোটায়।
পরদিন সাড়ে এগারোটার দিকে কক্সবাজার পৌছলাম। কক্সবাজারে বেশ কয়েকটা হোটেলের সাথে বাংলালিংকের কর্পোরেট রিলেশন রয়েছে। বসতি বে রিসোর্ট নামে একটা রিসোর্টের সাথে বাসে বসে কথা বলে গিয়েছলাম। বাংলালিঙ্কের পরিচয় পেয়ে খুব খাতির করা শুরু করলো। সাততলার ওপরে সাগরের দিকে মুখ করা- দুই রুমের সবচেয়ে ভাল স্যুইট দিল আশাতীত কম খরচে। ফ্রিজ, টিভি, এয়ারকুলার নিয়ে বেশ ভাল রকমের একটা ফ্যামিলি ফ্লাট- পছন্দ না হয়েই যায় না।
তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে- সাগর বেশ উত্তাল। রুমে জানালা খুলে দাড়াতেই বিশাল সাগর গ্রীলের ফাক দিয়ে চোখে এসে ধরা দিল। কানে ভেসে আসতে লাগলো সাগরের ভয় জাগানা, হৃদয়ে শিহরন তোলা গর্জন- এই গর্জন দেখা আর শোনার জন্যেই না বারবার বর্ষায় কক্সবাজার আসি।
রুম সার্ভিস রুমে খাবার দিয়ে গেল- খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের পর সাগরের কাছে গেলাম। তখন রোদ ছিল, সাগরে নামার প্লান ছিলো না। সন্ধায় সাগরে নামব ভেবে রেখেছিলাম।
আবার যখন সন্ধায় গেলাম তখন ধুম বৃষ্টি, আকাশ কালো হয়ে আছে- বিশাল বিশাল সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে- সাগরে নেমে কিছুটা ঝাপাঝাপি করলাম। কিন্তু সিকিউরিটি বেশি পানিতে বেশিক্ষন থাকতে দিলো না। অতঃপর তীর এসে বালিতে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। সামনে বিশাল সাগর- বিরাট বিরাট ঢেউ, প্রচন্ড শব্দে গর্জন, দিগন্ত জোড়া কালো মেঘে অন্ধকার- সম্পূর্ন অপার্থিব এক পরিবেশ।
সারারাত বৃষ্টি হলো। পরের দিক সকালে মেশিন রিক্সায় করে রওয়ানা দিলাম ইনানীর উদ্দেশ্যে। সৈকতে পাশে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে স্বর্গের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলতে লাগলো রিক্সা। একদিকে সাগর আর আরেকদিকে সবুজ পাহাড়ের সারি। মাঝরাস্তায় আবার শুরু হলো ভারি বর্ষন। ততক্ষনে লম্বা সোজা পাকা রাস্তা দু-পাশে গাছগাছালির সারির মাঝে চলে এসেছি। সম্পূর্ন অপার্থিব লাগছিলো। কোথাও কোন মানুষ নেই। প্রবল বর্ষন। গ্রাম পাকা রাস্তা, সবুজ গাছে- বৃষ্টির শব্দ- ভাষায় প্রকাশের যোগ্য না।
ইনানীতে গিয়ে দেখি সাগরের বেশ উত্তাল অবস্থা। তখন আবার গুড়ি বৃষ্টি। সাগরে নামলাম। কেউ নেই কোথায়। একটা মহিলা ছিল- তার কাছে মোবাইল মানিব্যাগ দিলাম। তার স্বামী আর দুই বাচ্চা সাগরে নেমেছে। মানুষ বলতে এই। তাদের পাশে সাগরে নামলাম। আস্তে আস্তে বৃষ্টি আবার তুমুল হলো, সেই সাথে ঝড়োবাতাস। ঢেউ আস্তে আস্তে আগের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেল। তুমুল বৃষ্টিতে দিগন্তজোড়া ক্যানভাস সাগরে বড়বড় ফোটা পড়ছে। চারিদিকে কালো মেঘের আনাগোনা। সে কি এক অপার্থিব অশরীরি জিনিস!
বৃষ্টি থামে নাই- ফিরতি রাস্তায় রিক্সার হুড ফেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফিরলাম।
পরের দিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাগরের কাছে গেলাম। কেউ নেই কোথাও- কেমন যেন এক পবিত্র পবিত্র ভাব। তখনও গুড়ি বৃষ্টি, তখনো সাগর অশান্ত। ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিলো না- কিন্তু ফিরে যেতে হবে। সাগরকে বিদায় জানালাম। ১৭ জুলাই, ২০১৪ রাত থেকে ২০ জুলাই, ২০১৪ রাত পর্যন্ত অসাধারন সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম ঢাকা।
ঢাকা ফিরে এসেছি। কিন্তু আমার মন এখনো সেই খোলা সাগরের তীরেই পরে আছে। কান পাতলেই আমি সেই দশদিগ-বিধ্বংসী শব্দ শুনতে পাই- শুনতে পাই সে শো শো শো শব্দের একের পর এক আছড়ে পড়া। কালো আকাশের নিচে উত্তাল সাগরের সামনে বসে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে মনটা বড় খাখা করে। নিজের চারপাশটা বড় রসকষহীন শুষ্ক লাগে। একটুকু শীতলতা, একটু ভেজা অনুভুতির জন্যে প্রান কাদে। আবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে ইনানীর বিশাল বিশাল সব ঢেউয়ের মাঝে।
এই টানের কারনেই বার বার ছুটে যাই নীল সাগরের কাছে। সাগরের অবগাহন করে মনের জ্বালা মেটাই।
ভাগ্যিস অনেক টাকা নেই- থাকলে কোনদিন আমাকে কেউ সাগরের কাছ থেকে আলাদা করতে পারতো না। আমি চিরকাল মহাসাগরের পাশে কোন এক ছোট্ট কুড়েঘরে জীবন কাটিয়ে দিতাম। সাগরে রোদ বৃষ্টি আর বাতাসের খেলা দেখতাম।
আফসোস!!!
( যারা সাগরকে ভালবাসেন, সাগরের সাথে যাদের অন্তরের যোগাযোগ- একবার হলেও বর্ষায় সাগরের কাছে যাবেন। বর্ষার সাগরের সাথে তুলনা নেই। যারা সাগরের পাশে হেটে হেটে আনন্দভ্রমণ করে তাদের জন্যে শীতকালই ঠিক- তবে যারা সাগরকে সাগরের মত দেখতে চায়- তাদের জন্যে বর্ষার বিকল্প নেই। )
বর্ষার সাগর আসলেই অসাধারণ। আমার কাছে কক্সবাজারের চাইতে সেন্টমার্টিন বেশি ভালো লেগেছে, কিন্তু বর্ষায় সাগরের যেই রূপ সেটা দেখতে অন্তত কক্সবাজার যাওয়া উচিত মনে হয়েছে।
থাকার জায়গা তো দারুণ।
সুন্দর
যেতে ইচ্ছে করছে 🙁
আমারও খুব ইচ্ছা উচু একটা জায়গা থেকে সমুদ্র দেখার, যেমন আপনার হোটেলের রুম :p ।
সত্যি বলতে কক্সবাজারে অন্য সবকিছুর চাইতে মেরিন ড্রাইভ রাস্তাটা আমার বেশি ভালো লেগেছিল।
চমৎকার পোস্ট, ছবিগুলোও সুন্দর।
বর্ষার সময় সমুদ্রের ওইদিকে গেলে খুব অল্প টাকায় সেরে আসা যায়। আমি অসবসময় বর্ষায় কক্সবাজারে যাই… শুধু একবার শীতের সময় গিয়েছিলাম