আমাদের বাঙলা সাহিত্য: অন্ধকারের দিনগুলি

বাঙলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন বলে যে পুস্তিকাটিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তার নামটা বেশ রহস্যময়। পুস্তিকাটির নাম চর্যাপদ। এই পুস্তিকাটির আরও কয়েকটা নাম আছে। অনেকে একে ডাকেন চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় নামে, কেউ আবার ডাকেন চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয় নামে। বড্ড বিদঘুটে নাম, বলতেই হয়। তবে আজকাল একে চর্যাপদ নামেই ডাকতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, তুলনামূলকভাবে যথেষ্টই সহজবোধ্য নাম।

বিশেষজ্ঞদের মতে এই চর্যাপদ রচিত হয়েছিল ৯৫০ থেকে ১২০০ সালের মাঝামাঝি কোন একটা সময়ে। বলা হয়ে থাকে, এরপরেই বাঙলা সাহিত্যের দুনিয়ায় নেমে আসে এক করুণ অন্ধকার, যে আঁধার টিকেছিল প্রায় দেড়শ’ বছর!

আচ্ছা, সাহিত্যের কি কখনও অন্ধকার সময় আসতে পারে? সাহিত্য নিজেই তো একটি দ্বীপ জ্বালা আলো, সে কেমন করে অন্ধকারের আড়ে রূপ আড়াল করবে?

১২০০ সাল থেকে প্রায় ১৩৫০ সাল পর্যন্ত আমাদের বাঙলায় কোন সাহিত্য রচিত হয় নি! একটা ভাষা, যার কিনা তখন কেবল বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে কোন সাহিত্য রচিত হয় নি! এও কি সম্ভব! কবিরা, গীত, পুঁথি লেখকেরা কোথায় গিয়েছিলেন তখন!

এটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে এই সময়ের মাঝে বাঙলা ভাষায় কোন সাহিত্য রচিত হয় নি। কোন এক বিচিত্র কারণে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সালের মাঝে রচিত কোন সাহিত্যকর্মের নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই না, তাই এসময়টাকে পণ্ডিতেরা বলেন ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এই সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, পড়াশোনা করেছেন, আলাপ করেছেন – কিন্তু তাঁরা কেউই এই অন্ধকারটুকুকে মুছে ফেলতে পারেন নি। এ সময়টার দিকে তাকালে চোখে কোন আলো আসে না, যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, ঘন কালো আঁধারে ঢাকা চারপাশ!

১৩শ’ শতকের একদম শুরুর দিকে বাঙলায় প্রথম মুসলমানদের আগমন হয়। রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে মুসলমানেরা এই বাঙলায় প্রবেশ করে। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন, সে সময় এই ভূখণ্ডে কেবল পা রাখা মুসলমানেরা নিজেদের জোর ছড়াবার জন্যে এখানকার মানুষদের উপর এতই অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছিল যে সাহিত্য রচনার কথা কারো মনেই আসে নি। এই যুক্তিটা খুব একটা শক্ত-পোক্ত হয় না আসলে। অতীতের আরও অনেক সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, যখনই কোন একটা শক্তি এর চর্চাকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে, তাদের সে সাহিত্য এক বিদ্রোহী, পরাক্রমশালী রূপ ধারণ করেছে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হবার কথা না। আর তাছাড়া দেড়শ’ বছর ধরে একটানা তো আর রক্তপাত চলে নি, যদি চলতই তবে আর আমাদের এই ভূখণ্ডে আজ অবধি কোন মানুষ থাকতো কিনা সন্দেহ আছে!

আরও একটা ব্যাপার, মুসলমানেরা তো এই দেশে বাঙালিদের মারার জন্যেও আসে নি, তারা এসেছিল রাজত্ব করতে। পাশাপাশি দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে এসে মুসলমান রাজারা বাঙলা সাহিত্যকে বেশ উৎসাহও দিয়েছেন। যারা বাঙলা সাহিত্যকে বেগবান করবার জন্যে উৎসাহ দিচ্ছেন, তারাই আগে একে দমিয়ে দিয়েছিল, এমনটা মানতে ইচ্ছে করে না।

তবে আবারও প্রশ্ন জাগে, তাহলে কোন সাহিত্য কেন রচিত হল না তখন? কেন সেই সময়ের একটা সাহিত্যকর্মও আমরা খুঁজে পাই না?

সেকালে কোন সাহিত্য লেখা হত না। বলা চলে, মুখে মুখেই তৈরি হত সে সাহিত্য, গাওয়া হত। লিখিয়ে নেয়াটা খুব একটা সহজ কাজ ছিলো না তখন। মুখে মুখে একটা সাহিত্য তৈরি হবার পর তা মুখে মুখেই থেকে যেত, সাহিত্যিকগণ স্মরণে রেখে দিতেন। হয়তো কখনো কখনো জমায়েতে, আড্ডায় সেগুলো গাইতেন তারা। যারা সাহিত্যকে ভালোবাসত, তারা সেসব মুখস্থ করে রাখতেন। কবিতা বেঁচে থাকতো মানুষের মুখে মুখে, কণ্ঠে কণ্ঠে, মনে মনে। তাই কোন একটা কবিতা যদি একদিন মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেত, তা হারিয়ে যেত চিরকালের জন্যে!

আবারও প্রশ্ন, তাহলে চর্যাপদকে লিখিত অবস্থায় পাওয়া গেল কেমন করে?

এই পুস্তিকাটি কিন্তু বাঙলায় খুঁজে পাওয়া যায় নি! ১৯০৭ সালে পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেন চর্যাপদ। ব্যাপার হল, নেপালের ভাষা বাঙলা নয়। বাঙলা ভাষার কোন একটি সাহিত্যকে লিখিত রূপ দেবার জন্যে প্রয়োজন ছিল একটি নির্দিষ্ট বর্ণমালার, যা সেই সময়ে ছিল না। তাই আমরা এটা অনুমান করতে পারি, অন্ধকার সময়’র সাহিত্যকর্মগুলো কেউ লিখে রাখতে পারেন নি, এতদিনে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে।

যত যাই হোক না কেন, এই বিশ্বাসটা এরপরও ঠিক আসে না যে দেড়শ’ বছর ধরে কোনও একটি কবিতাও কোনভাবে লিপিবদ্ধ হল না!! এরপর থেকে তো ঠিকই বাঙলা সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, একের পর এক মঙ্গলকাব্য, পদাবলী– কেমন করে এসেছে, তা বেশ ভালোভাবেই জানতে পারি আমরা। ১৩৫০ সালের পর থেকেই মহা মহা কবিদের আগমন ঘটেছে নিয়মিতভাবেই। আমরা জানি, কেমন বড়ু চণ্ডীদাস নিয়ে এসেছেন তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এক কথায় বলতে গেলে, ‘অন্ধকার যুগ’ আমাদের কাছে এক রহস্য, বলা চলে বাঙলা সাহিত্যের কৃষ্ণগহ্বর।

এ রহস্য আর অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কোন কোন পণ্ডিত আবার ভিন্নরকমের কথা বলেন। তাঁরা বলেন, চর্যাপদকে যদি আমর বাঙলা ভাষা না বলি, তবে তো আর অন্ধকার যুগ বলে কিছুই থাকে না, বাঙলা সাহিত্যের সূত্রপাত তবে ১৪শ’ শতকের শেষের দিকে! কিন্তু চর্যাপদ যে বাঙলা নয়, তাই বা মেনে নিই কেমন করে! চর্যাপদ-এই যে প্রথম বাঙলা ভাষার অস্তিত্বের নিদর্শন পাই, তাকে পাশে সরিয়ে রাখব কেমন করে!

মধ্যযুগে আমরা পাই বাঙলা সাহিত্যের বিকাশের পরিচয়, যার জন্মের পরিচয় মেলে প্রাচীন চর্যাপদ-এ, মাঝখানে এক অন্ধকার পর্দা, যার আবির্ভাব ঠিক কেমন করে, কোথা থেকে – আমরা কেউ জানি না! যত যাই হোক না কেন, সে যুগের বাঙলা সাহিত্যের কোন প্রামাণ্য নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই না, এটা আমাদেরই ব্যর্থতা! এতে বাঙলা ভাষা বা সাহিত্যের কী দোষ! বাঙলা সাহিত্য আজ অবধি নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ!

এই সম্বন্ধীয় আমার আগের পোস্ট: আমাদের বাঙলা সাহিত্য

অনুজ সম্পর্কে

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে গেলে হয়ত লিখতে হবে - প্রথমত আমি রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ, দ্বিতীয়ত চিরন্তন সত্য, মৃত্যুর সাথে করি বসবাস... https://www.facebook.com/CoercedAnuj
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিহাস, বইপড়ুয়া, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to আমাদের বাঙলা সাহিত্য: অন্ধকারের দিনগুলি

    • অনুজ বলেছেনঃ

      উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাঙলা সাহিত্যের জগতে আগমণ হয় গদ্যের, বাঙলা সাহিত্যও মোড় নিয়েছিল আধুনিকতার দিকে।
      তখনকার সময়ে যে গদ্যের প্রচলন হয়েছিল, তাকে এক অর্থে বলা চলে নিটোল গদ্য। এরপর ধীরে ধীরে গদ্যের বিকাশ ও সুস্থিতির মধ্য দিয়ে আধুনিকায়নের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আজ আমরা যে বাঙলা সাহিত্যের স্বাদ পাচ্ছি, তাকে পুরোদস্তুর আধুনিক বলাই যায়। বাঙলা সাহিত্য এখন আধুনিক যুগ পার করছে… 🙂

      • ইকু বলেছেনঃ

        এখন মনে হয় প্রগতিশীল যুগ চলছে 😛 😛
        লেখা টি অনেক ভালো লাগলো … শুভেচ্ছা জানবেন 🙂

        • অনুজ বলেছেনঃ

          এক হিসেবে কিন্তু অতীত থেকে আজ পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তকেই প্রগতিশীল মুহূর্ত বলা চলে (যে কোন সাহিত্যেরই ক্ষেত্রেই ঠিক হবার কথা এটা)। এই যে আপনি এত কষ্ট করে মন্তব্য করেছেন, পাশে ইমোটিকন দিয়েছেন, এই ছোট্ট অংশটুকুকেও চাইলে প্রগতিশীল যুগের সাহিত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়! 😛 😛

          ধন্যবাদ, ভাইয়া। 😀 আপনাকেও শুভেচ্ছা। 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।