পয়মন্তি এবং আমি: পর্ব ১

1

সন্ধ্যা নেমে আসছে। আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে থমথমে ভাব। আমি আর পয়মন্তি হেঁটে চলছি পার্কের ভেতর দিয়ে। কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরে আছে পুরো পথ। মৃদু বাতাসে ওর খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এলাম লেকের ধারে। ওকে খানিকটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমি বললাম,” চল, গাছের ছায়ায় একটু বসি”। পয়মন্তি কোনো কথা বলল না। আমরা গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলাম।

পয়মন্তির কথা বলছিলাম। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। স্কুল, কলেজে একসাথে পড়েছি। ওর আর আমার বাবার মাঝে ভীষণ বন্ধুত্ব। ঠিক তেমনি আমি ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। ছোটবেলায় একসাথে মাঠে খেলতে যাওয়া, একসাথে পুতুল খেলা, যখন তখন ঝগড়া করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকা, আড়ি কাটা, তারপর আবার বন্ধু হওয়া। ওর আর আমার মাঝে খুব সাধারণ কতগুলো মিল ছিল। যেমনঃ খাবারের রুচি, পোশাকের পছন্দ এগুলো সবসময় মিলে যেত। কেবল অমিলের জায়গাতে ছিল “মা”। ওর প্রথম মা অনেক আগে মারা গিয়েছিলেন। পরে ওর বাবা আবার বিয়ে করেন। নতুন মাকে ও কোনদিনও মা বা বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়নি। আন্টিকে আমার আবার খুবই ভাল লাগত। বাবা-মাকে নিয়ে যখন ওদের বাসায় বেড়াতে যেতাম, আন্টি আমাদের সাথে হাসিমুখে গল্প করতেন, মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়াতেন। আন্টির কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। তাই আন্টি পয়মন্তিকে খুব আদর করতেন। কেন জানি, পয়মন্তি আন্টিকে একেবারেই পছন্দ করত না। ওকে অনেক বার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ওর একটাই কথা, “তুই এসব বুঝবি না।”

url

পয়মন্তি আর আমি স্কুলে সবসময় একসাথে বসতাম। টিচাররা সবাই আমাদের চিনতেন। আমি পড়াশুনায় মোটামুটি ভালই ছিলাম। পয়মন্তি আবার মোটেও পড়াশুনা করতে চাইত না। কিন্তু পড়াশুনায় ভালো হলেও আমি এতটাই দুষ্টু ছিলাম আর এত বকবক করতাম যে আমার যন্ত্রণায় পুরো ক্লাসের অবস্থা বেগতিক হয়ে যেত। অন্যদিকে পয়মন্তি ছিল শান্ত। আমি যেমন হেড়ি গলায় জোরে জোরে কথা বলতাম, ও আবার ঠিক উল্টো ছিল। মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার সব কথা শুনত। দারুণ গান গাইতে পারত। দেখতেও অসাধারণ সুন্দরী ছিল। বেশ মনে আছে, আমরা যখন ৮ম শ্রেণীতে পড়তাম, তখন আমাদের বাসার পাশের গলিতে এক ছেলে ওর প্রেমে পড়েছিল। এমনকি প্রেম নিবেদনও করেছিল। আমারই সামনে ও ঝাড়ি মেরে বেশ পর্যুদস্ত করেছিল ওই ছেলেটাকে। আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। কারণ ওভাবে আমি কখনো ওকে রাগ হতে দেখিনি।

একবার হলো কি, পয়মন্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর মা আসল আমাদের বাসায়। তখন প্রায় রাত ৮ টা বাজে। আর কতই বা বয়স ছিল আমাদের। ১৫ তে পা রাখলাম আর কি। আমি তো খবরটা শুনে পাগলের মত এদিক-সেদিক ছুটলাম। পরে ওকে পাওয়া গেল ওর ছোট খালা রুমকি আন্টির বাসায়। এত দূরে ও একাএকা কেন গেল বুঝতে পারলাম না। ওকে যখন বাসায় নিয়ে আসা হলো তখন দেখলাম ওর গাল বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। আন্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। পয়মন্তি কাঁদছে? অসম্ভব! ওর মত শক্ত মেয়ে কাঁদতে পারে? আমি ওকে কত জিজ্ঞাসা করলাম, “বল তো কি হয়েছিল তোর? এভাবে হঠাৎ রুমকি আন্টির বাসায় একাএকা গেলি কেন? ওভাবে কান্নাকাটি করছিলি কেন?” ও কিছুই বলল না। আবার কাঁদতে শুরু করলো। সেদিন প্রথম বুঝলাম ও আমার সাথে সব কথা শেয়ার করে না বা করতে চায় না। কিছু না বুঝেই আমি ওকে কেবল সান্ত্বনা দিলাম।

পয়মন্তির বাবা মারা গেলেন শ্রাবণের কোনো এক রাতে। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা তখন ১০ম শ্রেণীতে পড়ি। পরের বছর এস এস সি দেয়ার কথা। এমন অসময়ে আঙ্কেল চলে গেলেন। পয়মন্তির সবচেয়ে আপন বন্ধু বলতে আঙ্কেলই ছিলেন। আঙ্কেলের ক্যান্সার ছিল। আগে থেকেই সবাই জানত। কেবল আমি জানতাম না। পয়মন্তি আমাকে কিছুই বলেনি। আসলে আঙ্কেলের ক্যান্সারের খবর শুনার পরই ও দৌড়ে রুমকি আন্টির বাসায় গিয়েছিল। এ কথাও পরে জানতে পারলাম।

পয়মন্তি আর আমি কলেজে উঠলাম। আগের মতই আমরা একসাথে পাশাপাশি বসতাম। কিন্তু তখন থেকে মনে হত ওর আর আমার মাঝে ব্যবধান আকাশ-পাতাল। ও এসএসসি তে খুব বেশি ভালো করতে পারেনি। তারপরও আমি ওকে সবসময় বন্ধু হিসেবেই ভাবতাম, প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা চিন্তাও করতাম না। একদিন ও হঠাৎ ক্লাসের ব্রেক টাইমে বলল, “তুই তো কত ভালো স্টুডেন্ট, আমার পাশে বসিস কেন? দীপা, রুবিনা ওদের পাশে বসলেই তো পারিস।” সেদিন ওর কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমিও বলেছিলাম, “তুই আমার পাশে বসতে চাসনা এইতো? কিন্তু তুই যাই বলিস, তোর মত ভালো বন্ধুটি আমি আর কখনো খুঁজে পাব না।” এই উত্তরের পিছনে কারণও ছিল। ও আমাকে সব কথা না বললেও আমি ওকে আমার সব কথা বলতাম। এমন অনেক কথা যা কাউকে না বলতে পারলেও ওকে বলতাম, আবার সবাইকে জানানোর মত হলেও ওকেই প্রথমে বলতাম।

একবার হল কি, কলেজ ছুটি হয়েছে। আমি আর পয়মন্তি রিকশা খুঁজছি। বাসায় যাব। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা রিকশা ঠিক করতে পারলাম। রিকশায় উঠতে গিয়ে দেখি আশেপাশে পয়মন্তি নেই। পরে রাস্তার ওপারে ওকে দেখলাম একটা ছেলের সাথে কথা বলতে।শুধু কথা বলছে না, রীতিমত হাসাহাসি করছে! তাই পয়মন্তি ডাকতে রাস্তার ওপারে গেলাম। কাছাকাছি আসতেই ছেলেটাকে চিনতে মোটেও দেরি হল না। ছেলেটির নাম অয়ন। এই পয়মন্তিকেই প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে যাকে কঠোর অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। আচমকা আমাকে দেখে মনে হল কিছুটা লজ্জা পেয়েছিল। তারপর পয়মন্তির দিকে মুচকি হেসে প্রস্থান করল। এরপর পয়মন্তির সাথে আরেকটা রিকশায় বাসায় আসলাম। কেন জানি, পথিমধ্যে আমাদের মধ্যে আর কোন রকম কথাই হল না। পাশাপাশি বসা দুটি মানুষ, কত বছরের চেনা, কত ভাল বন্ধু! অথচ হঠাৎ করে খুব বেশি অচেনা মনে হচ্ছিল। এ ব্যাপারটি নিয়ে পরে আর আমাদের মধ্যে কোন কথাবার্তাই হয়নি। হয়তো আমি চাচ্ছিলাম, পয়মন্তি নিজের থেকে কথাটি আমায় বলুক। কিন্তু ও যে ওর জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি নিয়ে আমাকে একেবারে অন্ধকারে ফেলে রাখবে তা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলাম?

যেমনটি আগে বলছিলাম, পয়মন্তি আমার কাছ থেকে অনেক কথা লুকাত। অবশ্য একজন মানুষ হিসেবে ওর ব্যক্তিগত বিষয় ও কার সাথে আলোচনা কিংবা শেয়ার করবে তাতে ওর পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আমার বাঁধ সাধল বন্ধুত্বের প্রশ্নে। আমি ওর বিষয়গুলো বুঝতাম। আন্টির সাথে ওর সম্পর্কের ফারাক নিয়ে আমি বরাবরই সচেতন ছিলাম। তাই বন্ধু হিসেবে ওর সমস্যাগুলো বা ওর আনন্দের মুহূর্তগুলোকে যদি কিছুটা ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম তাহলেও আমাদের বন্ধুত্বকে সার্থক মনে হত। তবুও অজানা কোন এক শঙ্কায় (হতে পারে সেটা বন্ধুত্ব হারাবার ভয়) আমি মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। ওর আর আমার মাঝে এই যে ব্যবধান, তা কিন্তু অয়নের কারণে হয়নি। বরং আরও অনেক ঘটনা ছিল যা বারবার প্রমাণ করেছে যেই পয়মন্তিকে আমি এত বছর চিনেছি সেই পয়মন্তি হয়তো হারিয়ে গেছে। যেন এক অচেনা আত্মা ভর করেছে আমার এই চিরচেনা বন্ধুটির উপর।

(চলবে…)

পাহাড়ি কন্যা সম্পর্কে

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বাস্তব ও কল্পনা আমার দৈনন্দিন জীবনের সহযাত্রী। জীবনকে ভালবাসি। অনেক স্বপ্ন দেখি, যদিও তা বাস্তব থেকে মাঝে মাঝে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। আমি বরাবরই রাশভারী প্রকৃতির মানুষ, স্বল্পভাষী কিন্তু হাসতে খুব ভালবাসি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to পয়মন্তি এবং আমি: পর্ব ১

  1. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    চলুক, পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।