বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনে আসার পর খাবারের রুটিন পাল্টে গিয়েছিলো অকল্পনীয় রকমে। সকালে নাস্তা করা হতো না দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। ফলাফল গ্যাস্ট্রিকের গেঞ্জাম আর কারণ ছিল প্রয়োজন অথবা অপ্রয়োজনে রাত জাগা। প্রয়োজন এর প্রধান কারণ ছিল পড়ালেখা, আর অপ্রয়োজনের কারণ একাধিক- আড্ডা দেয়া, রাত করে শহিদুল্লার পুকুর পাড়ে আর কার্জনে ঘুরা, সিনেমা অথবা টিভি সিরিজ দেখা। ভালো খারাপ যেই কাজই করি না কেন ঘুমাতাম ফজরের পর। সারা রাত জেগে থাকার কারণে মাঝরাতে একবার খাওয়া লাগতো। এই খাওয়ার টাইমটা ছিল অদ্ভুদ। রাত দুইটা থেকে তিনটার দিকে। কপাল ভালো ছিল যে আমাদের একুশে হলের সামনে সারা রাত দুইটা দোকান খোলা থাকতো। ভাত পাওয়া না গেলেও পরোটা সব সময় পাওয়া যেতো। রাত জাগার সাথে সাথে রাত করে খেতে যাওয়াটাও পরিণত হল অভ্যাসে।
হলের সামনের ওই দোকানে কাজ করতো একটা পিচ্চি ছেলে। প্রায় রাতেই খেতে গেলে ও পরোটা আর ডাল ভাজি আগায় দিতে আসতো। হোটেলের অন্য কর্মচারীরা মাসের ১৫ দিন দিনে আর বাকি ১৫ দিন রাতে ডিউটি করতো। কিন্তু, ওই ছেলেটা পাক্কা ৩০ টা দিনই রাতে ডিউটি করতো। একদিন ভাবলাম যে এই কারণটা নিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করবো। ওই রাতে ওর সাথে আমার কথোপকথন ছিল এমনঃ
আমিঃ এই ভাইয়া, শোন?
পিচ্চিঃ কি ডাইল লাগব আরও?
আমিঃ নাহ। তোমার নাম কি?
পিচ্চিঃ রাজা।
আমিঃ তুমি কি সবসময় রাতে ডিউটি করো?
রাজাঃ হ।
আমিঃ সারা রাত ডিউটি করলে কত দেয়?
রাজাঃ হুদা রাইতের লইগা ৫০ ট্যাকা।
আমিঃ বয়স কত?
রাজাঃ কেউ কয় ৮ বছর, কেউ কয় ১০ বছর।
আমিঃ রাতে ঘুমাও না কেন তুমি? এক সময় গিয়ে সরির খারাপ করবে।
রাজাঃ রাইতে ঘুমাইলে স্বপন দেহি। ভয় লাগে। তাই ডিউটি করি।
আমিঃ কি স্বপ্ন দেখো?
রাজাঃ আমার আব্বায় আমি অনেক ছোট থাকতেই অনগরে ফালায় দিয়া চইলা গেছে। আমি আম্মার লগে থাকতাম। আম্মায় অসুখে মইরা যাওনের পর নানী ঢাকাত পাডায় দিসে। ঢাকাত আসার পর রাইতে ঘুমাইলেই আম্মারে স্বপ্নে দেহি। হেয় আমারে ডাকে হের কাছে যাইতে। খুব ডর লাগে।
কথপোকথন আর বেশি দূর আগায় নি ওই রাতে। ওই ছেলেকে সাহায্য করা বলতে আমি আর আমার বন্ধুরা হয়তো ৫ টাকা ১০ টাকা টিপস দিতাম। মাঝে মাঝে কাছে ডেকে কথা বলতাম। এর বেশি কিছু না। কারণ এর চেয়ে বেশি কিছু করার সাধ্য কিংবা ক্ষমতা আমাদের কারোই ছিল না। আমরা না কেউ পারবো তার মাকে তার কাছে ফিরিয়ে আনতে, না পারবো তাকে তার মার কাছে পৌঁছে দিতে, না পারবো স্বপ্নে তার মাকে তাড়িয়ে দিতে, না পারবো এই রাজাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।
সমগ্র সিস্টেমটাই যে গোলমেলে! তাই নিজেদের এত-শত অপারগতাকে ইগনোর করে জীবন চালিয়ে নিতে হচ্ছে। ‘রাজা’রা কিন্তু জীবনের কাছে অনেক বেশি কিছু আশা করে না; চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিকেশে ব্যাস্ত থাকা, না পাওয়ার বেদনায় কাতর আমরাই হই!
তখন সেকেন্ড-ইয়ারের মাঝা-মাঝি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীরে সামনের দিকটায় বসে একদিন দপুরে খিচুড়ি খাচ্ছিলাম; একটা ছেলে(পোশাক দেখে বুঝতে এক মুহূর্ত দেরী হবে না ও পথশিশু!) এসে খিচুড়ি খেতে চাইলো, আমার কাছে আরেকপ্লেট খিচুড়ি কিনে ওকে খাওয়ানোর মত টাকা ছিল না আর থাকলেই যে খাওয়াতাম তা জোর দিয়ে বলতে পারছি কই!( অত ভালো আমি নই; ইচ্ছে করে নিজের মত করে অনেক কিছুই করতে- পারি না। ‘আড়ষ্টতাগুলোই’ যেন সেটাকে ‘স্বীয়-অপারগতা’ নামক শালীন অজুহাতে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে! জানি, এ সমস্যা অন্তর্নিহিত আমার মতো আরো অনেকের মাঝেই…)
চামচ চারেক খিচুড়ি অবশিষ্ট ছিল প্লেটে। সাধতেই এমন আগ্রহ করে ছেলেটা খাওয়া শুরু করেছিল…ভাইয়া, লোকমা তিনেক খাওয়া খিচুড়ি খাইয়েই একজন মানুষের নির্ভেজাল, নির্মল হাসি দেখা যায়, খুব খুশি করা যায় বোধয় আপনার-আমার এই দেশটাতেই!
আমরা কেউ পারবো না রাজাকে তার মার কাছে পৌছে দিতে কিংবা রাজার মাকে তার মা’র কাছ ফিরিয়ে আনতে কিন্তু আমরা তো পারি রাজাকে সাথে নিয়ে একদিন সবাই মিলে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ গানটা গাইতে। কল্পনার কিশালয়ে খুব সহজে এটা ভেবে নেয়া যায়! কিন্তু বাস্তবে? কঠিন হাজির হয় আবার সেই শালীন অজুহাত- ‘অপারগতা’! মানসিক শান্তি খুঁজি যে ওটা ভেবে…কিন্তু নিশ্চিত বাস্তবে সেটা করা গেলে, অনেকগুলো টিপস পেলে রাজা যতটা খুশি হয়, সবার মুখে সেই গানটা শুনলে, গানটা গাইলে- কম খুশি হবে না। এতে ভালোবাসার বড্ড কাঙ্গাল…
আমি অল্প কথায় মন্তব্য লিখতে পারি না; লেখা শুরু করলেই ফুলে-ফেঁপে বড় হয়ে যায়। (তবে এক্ষেত্রে সুবিধা আছে, সামনের দিনে মন্তব্য না করলেও সমস্যা হবে না- চারটা মন্তব্য করার মত ATP খরচ ইতোমধ্যে হয়ে গেছে! 😛 )
সরবে স্বাগতম ভাইয়া ! :welcome: :love:
ইতিবাচক লেখার প্রয়াশ চলতে থাকুক 😀
তোমার দীর্ঘ কমেন্ট এর জন্য ধন্যবাদ
সরবে স্বাগতম।
লেখাটা ভালো লাগল ভাইয়া।
আমার একটা রিলেভেন্ট জিনিস মনে পড়ল,
A man was strolling down on the beach one evening when he chanced upon another man picking up stranded, half-dead starfish from the beach and throwing them back into the ocean. Bewildered he asked this man, “There are so many of these stranded star fish. You’ll never be able to save them all. What’s the point of wasting your time like this?”
The other man did not stop throwing the starfish back into the sea. He merely replied, “But I just gave this starfish back its life..and this one..and this one..and this one..”
And that is the very same reason why we are social activists. Because we just helped this person and this person and this person and this person.
And it makes all the difference in the world.
আপনার এই লেখা এটাই মনে করিয়ে দিল। নিয়মিত লিখুন ভাই।
ধন্যবাদ ভাইয়া, সময় নিয়ে অনুরপ একটা ঘটনা শেয়ার করার জন্য।