এইবারের এইচএসসি-২০১৪ সালের পরীক্ষার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র খোঁজ খবর রেখেছেন যারা তারা জানেন এবং তাদের অধিকাংশই একমত হবেন যে এইবারের এইচএসসি পরীক্ষা নানা ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। “প্রশ্নপত্র ফাঁস” নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কিছুটা হলেও তাদের মন্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কিন্তু যখন “ভর্তি পরীক্ষা”র মত বিশাল একটা সময়ে এই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে তখন সবাই প্রায় নিশ্চুপ। চোখের সামনে দিয়ে ঘটে যাচ্ছে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর স্বপ্নের গণহত্যা, একই সাথে নীতিবোধেরও কি নয়?
প্রথমেই আসা যাক “প্রশ্নপত্র ফাঁস” বিষয়ে। এই বছরের এইচএসসি পরীক্ষা কলঙ্কিত হয়ে থাকবে এই অধ্যায়ের জন্য। ইংরেজি, পদার্থ, গণিত এবং রসায়ন, গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো বিষয়ের প্রশ্ন পত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল এবং ঢাকা ও রাজশাহী বোর্ডে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এমনকি ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি পরীক্ষা স্থগিতও করা হয় এই অভিযোগের ভিত্তিতেই। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় এইবারের পরীক্ষা গত সববারের সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে দূর্নীতির দিক থেকে।
এইবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক,
গত ১৩ই আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। কিছু বোবা পরিসংখ্যান তুলে ধরছি-
“এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭৫.৭৪%। যা ২০১৩ সালের তুলনায় ৪% বেশী। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফলের তুলনা করি-
খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্পষ্ট যে ঢাকা বোর্ডের শতকরা ১০ শতাংশ বেড়ে ৮৪.৫৪% হারই মূলত এবারের সামগ্রিক পাসের হার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রন করেছে। সম্ভবত বাংলাদেশে পরিসংখ্যান কথা বলতে পারে না। তাই এক চোখ দিয়ে দেখলেই এ ফলাফলকে ভালো বলা সম্ভব। আসলে আঞ্চলিকভাবে এবার ফলাফল খুবই খারাপ হয়েছে। আর এর কারণ খুঁজতে খুব বেশী দূরে যাওয়া প্রয়োজন নেই, “প্রশ্নফাঁস” !
এবার প্রযুক্তিবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদার বিষয়ে আরেকটা তথ্য দেই। ঢাকা বোর্ডে ইংরেজীতে এবারের পাসের হার ৯২.৫৯%। যা ২০১৩ সালে ছিলো ৮২.৪৩%। রসায়নে এবারের পাসের হার ৯৬.৬১%। যা গত বছর ছিলো ৮০.৯৫%। পদার্থে পাসের হার ৯৩.৬৬%। এসবই যে আসলে প্রশ্নফাঁসের সমন্বিত ফলাফল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ বিষয়গুলোতে ঢাকা বোর্ডের এ পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে প্রযুক্তিবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢাকা বোর্ডই নেতৃত্ব দিবে। এক চোখ দিয়ে না তাকিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করলে আসলে “স্বপ্ন” গনহত্যা দেখতে পাচ্ছি আমরা!
একটু লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট যে, যে সকল জেলায় ফেইসবুকের ব্যবহার যত, এবারের ফলাফলের সফলতা সেই দিকেই। আজকে সারা দেশে অনেক ছাত্র পাওয়া যাবে যারা বারো বছর স্বপ্ন লালন করেছে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়বে। কিন্তু আজকে সেই ছেলেগুলো হয়তো পরীক্ষাই দিতে পারবে না! একটা কথা না বললেই নয়, প্রশ্ন পত্র পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন আকাশচুম্বী তেমনি প্রশ্ন পত্র পায় নি অথবা পেয়েও নীতিবোধের কাছে হেরে যায় নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম না। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে মেইল করা নীতিবান সেই মেয়েটিই হয়তো আজকে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে নি। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগতে পারে কিন্তু কথা ফেলে দেওয়ার মত না। পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল যে সেটা এততাই কঠিন ছিল যে যেই ছেলেটি বা মেয়েটি প্রশ্ন পত্র পায় নি তার পক্ষে ওটা সলভ করে তথাকথিত জিপিএ পাঁচ পাওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল। তাই বলাই যায় যারা প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তারাই এখানে ভালো ফলাফল করেছে।
এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের নীতিবোধের শিক্ষার শুরুতেই দুর্নীতির রাস্তায় হাঁটতে উৎসাহিত করবো? যেই শিক্ষার্থী প্রশ্ন পত্র পেয়েও নিজের নীতিতে অটল থেকেছে আজ তাঁকে আরেকজন নীতির কাছে হেরে যাওয়া শিক্ষার্থীর কাছে হেরে যেতে হবে। কারণ বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রধানতই দেখা হয় পদার্থ ও গণিতের জিপিএ। এখন কি ঐ নীতিবান ছেলে কিংবা মেয়েটি আত্মদহনে ভুগবে কেন সে প্রশ্নপত্র হাতের কাছে পেয়েও নিল না? এই প্রভাব কি পরবর্তী প্রজন্মে পরবে না? সে কি এর পরে নীতির প্রশ্নে নীতিবান থাকতে পারবে? অথবা এর পরের জেনারেশন কি এখান থেকেই শিক্ষা পেয়ে যাবে না যে নীতি যেখানে বিসর্জন দেওয়াই সাফল্যের মাপকাঠি সেখানে নীতিবোধ খুব গৌণ একটা বিষয়?
আমরা জানি আমাদের পরিধি খুব সীমিত। আমরা চাইলেও হয়ে যাওয়া “ভুলঃ পরীক্ষাকে শুধরাতে পারবো না কিন্তু তার মানে কি এই যে আমরা ভুল বারবার করতে থাকবো? বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট কিংবা চুয়েট তো চাইলেই পারে এই শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে। এখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সার্কুলার দেওয়া হয় নি। এখনও চাইলে ভর্তি পরীক্ষা কমিটি পুরো বিষয়টি নিয়ে আরও ভাবতে পারে। অথবা বলতে পারি আমরা তাদের ভাবতে বাধ্য করতে পারি। অনলাইনে ইভেন্ট পেজ খুলে একাকার করে নয় বরং তাদের কাছে ম্যাসেজ পৌছে দিয়ে, তাদেরকে ভাবতে অনুরোধ করে যেন ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যে ন্যূনতম যোগ্যতা তারা নির্ধারণ করবেন সেটা যেন গ্রামের অনেক দিক থেকে সুবিধা বঞ্চিত এবং নীতিবান কিছু ছেলে মেয়ের জন্য গলার কাঁটা না হয়ে যায়। তাদের স্বপ্ন আর নীতির মৃত্যুর কারণ না হয়ে যায়।
প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই স্তরে পরীক্ষা নিতে পারে। প্রথমে প্রাথমিক একটা যাচাই হলো, এরপর তাদের নিজস্ব নিয়মমত ভর্তি পরীক্ষা। অথবা চাইলে যেহেতু এইবার গণিত দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয় নি সুতরাং সেই বিষয়ের নম্বরও তারা সংগ্রহ করে যাচাই করে নিতে পারেন। কিন্তু যদি তারা পূর্বের যে যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল তাই দিয়েই যোগ্যদের বেছে নিতে চায় তখন অনেক ছাত্রের জন্য সেটা অন্যায় হয়ে যাবে। তাদের নীতিবোধের গলা টিপে মেরে ফেলা হবে। এটা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য সুখকর হবে না। তখন শিক্ষা আবার কলুষিত হয়ে যাবে। দেশসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়া অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর নামের পেছনে একটা কলঙ্ক রয়ে যাবে, এমনকি এরই মাঝে যারা সঠিক উপায়েও ভর্তি হবে তারাও ভুল না করেও দোষী হয়ে যাবে। আর এই পুরো বিষয়টার দায়ভার বর্তাবে আমাদের উপর। ওরাই আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে। বলবে সময় ছিল কিছু করার জন্য, কেন করলেন না? কেন আমাদের কথা ভাবলেন না? আমাদের নীতিকে তো আপনারাই বিক্রিত হয়ে যেতে দেখলেন, আপনারাই দোষী। আমরা কি পারবো এই দায় এড়াতে? এখনও সময় আছে, সব নষ্ট হয়ে যায় নি। বুয়েট সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ করছি আপনারা একটু সোচ্চার হোন, শিক্ষাবিদদের কাছে কাছে বলছি আপনারা একটু এইদিকে নজর দিন। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের সাথে অন্যায়টাকে রুখে দিন। তাদের স্বপ্নের, নীতিবোধের হত্যায় শামিল না হয়ে ওদের বাঁচিয়ে তুলুন। আমরা পারি, চাইলেই পারি।
তথ্য সূত্রঃ
১) প্রথম আলোঃ
http://epaper.prothom-alo.com/index.php?opt=view&page=1&date=2014-08-14
http://www.prothom-alo.com/education/article/290821/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%BE-%E0%A6%AB%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%BE-%E0%A6%A2%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A7%9F
২) কালের কন্ঠঃ
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/08/14/116869
http://www.ekalerkantho.com/?archiev=yes&arch_date=14-08-2014
খুবই সময়োপযোগী একটা লেখা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবার ভর্তির ব্যপারে নতুন করে ভাবতেই পারে।
কিছু পরিবর্তন হবে মনে হচ্ছে:
ভাওতে>>ভাবতে
উচ্চতর গণিত>>গণিত দ্বিতীয় পত্র
ঠিক করে দিলাম ভাইয়া, ধন্যবাদ। 😀 পারলে তোমাদের বুয়েটে আড়ি পেতে শোনা গ্রুপ বা বুয়েটের স্যারদের, প্রশাসনকে জানাও। ১৪ ব্যাচের জন্য ভালোই হবে হয়তো।
Ar koto???? 🙁