অবশেষে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাঃ চোর পালালেই কি আমাদের বুদ্ধি বাড়বে? এক্সপার্টদের ৭ মন্তব্য

[একপ্রকার অনাড়ম্বরেই রাষ্ট্রের আইনসভায় পাস হয়ে গেল জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪। পত্রিকায় পত্রিকায়  সম্পাদকীয় হলো, পূর্ণপ্রস্থ কলাম লেখা হলো, দুর্মুখেরা বললো কয়েক ঘন্টায় করা আইন, সুমুখেরা বললো, কয়েক ঘন্টা নয়, কয়েক মাস (বিখ্যাত সরকারী) ওয়েবসাইটে ঝুলিয়ে রাখা, প্রচার নিয়ন্ত্রণের লাইন। কিন্তু, এককথায় বললে যা হয়, চোর পালিয়েছে। তো, এখন বুদ্ধিতো বাড়বেই। তথাপি সুশীল গোষ্ঠী/বুদ্ধিজীবি, মার্জিত ইংরেজীতে বললে যাদেরকে বলা যায় এক্সপার্ট, তাদের মতামতগুলো একসাথে করে দেখার জন্যই এই ক্ষুদ্র লেখা। এই এক্সপার্টদের কথা সরকারের কতটা কানে তোলা দরকার, সে আগামীকালের কথা। কিন্তু, রাষ্ট্রের প্রজা হিসাবে আমাদের সচেতনতা, গণতান্ত্রিকতার নিরিখে কিছু ছাপ ফেলতে পারে এ আশা তো করতেই পারি। ]

কাগজপত্রে সম্প্রচার কমিশন স্বাধীন এবং সংবিধিবব্ধ সংস্থা হিসেবে বিবেচিত হলেও একে মেনে চলতে হবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিবের সই করা নির্দেশ। কারণ, এ নীতিমালায় উল্লেখ নেই অথবা অন্য কোনো নীতিমালা বা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালায় সিদ্ধান্ত প্রদান করবে। ” – ৯ আগস্ট ২০১৪, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ (সমকালীন প্রসঙ্গ- দৈনিক সমকাল) ((http://www.samakal.net/2014/08/09/77626))

সম্প্রচার নীতিমালাকে ‘হুকুমনামা বা নিষেধাজ্ঞা’ হিসেবে অভিহিত করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে। দেশে যখন কোনো জরুরি অবস্থা নেই, সামরিক শাসন নেই, তখন এ ধরনের নীতিমালা অবিশ্বাস্য। গণমাধ্যম জনগণের শেষ ভরসার জায়গা, যেখানে কম হলেও সরকারের সমালোচনা হয়। ((www.samakal.net/2014/08/12/78481))

 সম্প্রচার নীতিমালার খসড়া নিয়ন্ত্রণমূলক! আইনজ্ঞ শাহদীন মালিকের মতে, এ ধরনের ধারার ফলে আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে। তিনি বলেন, `কোনো বক্তব্য শুধু সত্য কিংবা মিথ্যা হওয়ার কারণে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিধান প্রায় দেড়শ` বছর ধরে সব সভ্য দেশে আইনব্যবস্থা থেকে বিলোপ করা হয়েছে। আইনের অসীম প্রয়োগের কারণে এটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। নীতিমালায় এসব থাকলে আইনের অপপ্রয়োগই ফিরে আসবে। ((http://www. banglanews24. com/fullnews/bn/222358.html))

প্রস্তাবিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, এই নীতিমালা দিয়ে সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ((http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/281977 ))

সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নীতিমালাটাকে দেখছি ঘোড়ার আগে গাড়ি তৈরি করার মতো। কমিশন না করে নীতিমালা তৈরি হয় কিভাবে? আগে কমিশন গঠন করতে হবে। সেটা প্রয়োগে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আলোচনা করতে হবে। আমি সাধারণভাবে এটাই বুঝি। সম্প্রচার নীতিমালায় যে সব ধারা দেয়া হয়েছে ওই সব ধারা কি চিন্তা ও উদ্বেগ থেকে দেয়া হয়েছে আমরা বুঝি।

    সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদকে ((সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদ:
(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।)) রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী যে সব কথা বলেছেন আমার বিবেচনায় তা সঠিক ব্যাখ্যা নয়। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আটটি বিষয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আটটি বিষয়ের বাইরে পার্লামেন্ট বা অন্য কারও ক্ষমতা নেই যাতে তারা বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে। সম্প্রচার নীতিমালার যে খসড়া আমরা তা সংবিধান নির্দেশিত আটটি বিষয়ের বাইরে। মন্ত্রিসভার এখতিয়ারবহির্ভূত। সংবিধান তাদের এ বিষয়ে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তারা তার অপব্যবহার করছেন। তবে এগুলোর প্রয়োগ অনেক সময় খুবই কষ্টকর এবং একই সঙ্গে বিব্রতকর হবে। এ জন্য জনমনে যাতে কোন ধরনের সংশয় সৃষ্টি না হয় ওই ধরনের নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নীতিমালায় যত বেশি কথা থাকে তত বেশি সমস্যা তৈরি হয়। শব্দ কম থাকলে তা হতো গণতন্ত্রের জন্য ভাল। পুরো নীতিমালাটি পড়লে বোঝা যায় তা ১৯৭১ সালের স্পিরিটের বিরুদ্ধে যায়। ওই সময় আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম পাকিস্তানের নানা বিধিনিষেধের কারণে। কি বলা যাবে কি বলা যাবে না তা ওই সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এ নীতিমালার কারণে আমার মনে হয় পাকিস্তানের ওই ধারা ফিরে এলো।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান বলেন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা যারা তৈরি করছে তাদের জ্ঞান ও মেধা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা, গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী কোন মানুষ বা সরকার এ ধরনের নীতিমালা তৈরি করতে পারে না। কেউ এ নীতিমালাটি বিবেকের তাড়নায় করেছে এটা বলা অসম্ভব। নীতিমালাটি পক্ষপাতদুষ্ট। এদেশের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে নীতিমালাটিকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এ ধরনের নীতিমালা নষ্ট করে দেয়।

    রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বলেন, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার একটি কমিশন গঠনের কথা বলেছে। কিন্তু ওই কমিশনের কোন বিচার করার ক্ষমতা থাকবে না। কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা সরকারই নেবে। এতে আসল ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকবে। এরপর মিডিয়ার স্বাধীনতা বলতে আর কি থাকে? ((http://mzamin.com/details.php?mzamin=MzU2NDE=&s=Mg== ))

ডেইলি স্টার বলছে The government move to strictly monitor and regulate the media, we are afraid, will ultimately turn out to be a sword of Damocles hanging over it. We are deeply concerned about the extremely dangerous line the government is taking to muzzle the media. ((http://thedailystar.net/proposed-broadcast-policy-35892))

The approach of the policy is not supportive but controlling. We want a policy that ensures freedom of expression. But, unfortunately, this policy gives the government freedom for repression. –Fahmidul HAQ teaches Mass Communication and Journalism in Dhaka University. ((http://www.thedailystar.net/op-ed/policy-supports-doesnt-control-36554))

————

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই থাকে নীতিমালা। নীতিমালার সংকলন ও সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকতে হয় সরকারের বাইরের এক্সপার্টদের।

জ্ঞানচোর সম্পর্কে

সেই কবে জেগেছিলাম, বিলিয়ন বর্ষী নক্ষত্রের আলোয়, ডিরাকের সমুদ্রের পাড়ে। অবাক কৌতুহল নিয়ে গেলাম বহুদুর। তারপরও সহসা বুঝি, নিজে আমি,নিছক পড়ে থাকা ঝিনুকের খোলসে সোনালী অনুপাত খুঁজে বেড়াই। পড়ে থাকো তুমি, মহা সমুদ্র।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, বিবিধ, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।