নুহার সাথে আমার কখনো সামনাসামনি দেখা হয় নি, কখনো আমি শুনি নি নুহার কথা, কখনো দেখি নি ওর হাসি, এমনকি জানিও নি নুহা ছিলো।
“মা, তুমি কক্সবাজার চলে এসেছ। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো তোমার প্রিয় কক্সবাজার। আমার কথা যেন বুঝতে পারছিল ও। গুলিতে তার ডান চোখটা বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার চিৎকার শুনে সে বাঁ চোখ দিয়ে তাকাল। তখন যেন সারা দুনিয়াকে দেখে নিয়েছিল ওই একটি চোখেই, এক তাকানোতেই। শেষ পর্যন্ত চোখ খোলা রেখেই আমাদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় আমার প্রিয় সন্তান। আমার হৃদয়ের টুকরো।”
তরুণ ভাইঃ
তরুণ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প কিছুদিনের। আমাদের ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র ছেলেগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্টে গিয়েছিলো এক ইন্ডাস্ট্রিতে। তারপর একটা সেমিনারের ব্যাপারে তাদের সাথে কথা বলতে যেয়ে প্রথম পরিচয় হয় তরুণ ভাইয়ের সাথে। খুব বেশি না, ২-৩ মিনিটের কথা, তাতে করে যা টের পেয়েছিলাম মনে হয়েছিলো, মানুষ হতে হলে এমনই হতে হয়, হাশিখুশি, মজার একটা মানুষ, খুব সত্যি কথাগুলো অবলীলায় বলে দেন, রাখঢাকের কিছু নেই………
অফিসের হাজারো কাজের মাঝে অল্প একটু সময়ের জন্য হলেও ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যেতাম, কথা হতো ফটোগ্রাফী নিয়ে, আরো হাজারটা ফাজলামি, হাসি ঠাট্টা, ঠিক বেঁচে থাকার দিনগুলো পার করে দেবার মতোই আড্ডা! দিনটা এখনো মনে আছে, শুক্রবার, আগের দিন জানলাম তরুণ ভাই বেড়াতে যাচ্ছেন সপরিবারে…কক্সবাজার! অসাধারণ কিছু সময় কাটাবেন……
শুক্রবার সকাল, বরাবরের মতো একটু দেরি করে ঘুম ভাঙলো, মুঠোফোনে মেসেজ এসেছে একটা, মেসেজটা খুলে কিছুক্ষণ হতবাকের মতো তাকিয়ে রইলাম……
সাদামাটা অক্ষরে লিখা আছে ভয়ঙ্কর কিছু কথা, তরুণ ভাইয়ের পিচ্চি নুহা, আমাদের নুহা……হ্যাঁ, আমাদের নুহাই, নুহা এখন একলা কেউ না, এখন আশেপাশের সবগুলো বাচ্চার মাঝে আমি নুহাকে, নুহাদের দেখি, কী দোষে জন্মালো ওরা এমন একটা দেশে, যেখানে আমরা ওদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারি না, আমি এখন কোন শিশুকে বলতে পারি না, অনেক বড়ো হও, অনেক বড়ো, এই দেশের সবাই যেন তোমাকে এক নামে চিনে, বলতে বড়ো ভয় হয়, নুহাকেও যে সবাই এখন এক নামে চেনে, এমন করেই……
খুব বোকার মতো একটা কাজ করেছিলাম, ফেসবুকে লগইন করে অনেকক্ষণ নুহার ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমি জানি না ওর নাম নুহা, আমি জানি না ওর হাসিটা কত সুন্দর, আমি জানি না ও হাসলে ওর গালে টোল পড়ে কিনা, শুধু জানি ও এখন আর নেই, আর কিছু না। হঠাৎ করে খুব বেশি একলা মনে হলো নিজেকে, যখন একজন বাবা নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখে নিরাপদ ভাবতে পারেন না নিজেকে, তখন কিসের জন্য আমাদের দেশের নেতারা আস্ফালন করে বেড়াবে দেশের আইনশৃংখলার উন্নতি হয়েছে, আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক শান্তিতে আছি……অভ্যাস হয়ে গেছে অনেক কিছুই, রোজকার খবরের কাগজে পড়ি, ট্রাক দুর্ঘটনায় এতো জনের মৃত্যু, ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মারা, ছাদ থেকে ইট পড়ে মারা যাওয়া……নতুন কিছু হলো নাকি……তবু এই ছবিটা আমি কখনো দেখতে চাই নি, তরুণ ভাইকে এমন করে দেখবো আমি কখনো কল্পনা করি নি…
তরুণ ভাইয়ের চোখের জলে কি ছিলো আমি জানিনা, জানতেও চাই না, শুধু এটুকু জানি, সেই ঘাতক ডাকাত আজো ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে পশুর মতোই, আরো একটি শিকারের খোঁজে, আরো কোন নুহাকে খুঁজে বের করতে, আজো সে খেয়েছে, শান্তি মতো ঘুমিয়েছে……শুধু আমরা পারি নি, বুকের মাঝে পাথর বেঁধে তরুণ ভাইকে দেখেছি অফিসে আসতে, আমরা কথা বলেছি সাধারণভাবেই, শুধু একটা সত্য উচ্চারণ না করেই, কিছু একটা নেই, কোথাও কেঁউ নেই।
হঠাৎ কখনো কোন একটা অনুষ্ঠানে তরুণ ভাই আর আমার সাথে নুহার পরিচয় করিয়ে দেবেন না, আমি নতুন করে আর নুহা নামের কারো চাচ্চু হতে পারবো না। আমার ক্যামেরায় নুহার আর একটামাত্র ছবি তোলা কখনো হবে না……
তবু এখনো হঠাৎ হঠাৎ টের পাই, নুহাই আমাদের খুব তীব্র একটি সত্য বুঝিয়ে দিয়েছে, নিজের খুব আপনজনকে খুব আঁকড়ে ধরেও আমরা কেউ ঠিক বেঁচে নেই, আমাদের মাথার উপর কোন ছাদ নেই, আমাদের কেউ দেখে রাখবার নেই। আমাদের দেখে রাখবার মত সেই কাউকে তৈরি করতে হবে আমাদেরই, একটা প্রশাসনকে আমরা তখনই বিশ্বাস করতে পারবো যখন সেটা তৈরি হবে আমাদেরই মত কিছু রক্তমাংসের মানুষ দিয়ে, কিছু দানব আর উদাসীন গন্ডার দিয়ে না। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেই ডাকাত ধরা পড়েছে, এখনো ফাঁসি হয়নি, হবে কিনা জানি না, হলেও সেই ফাঁসিতে কিসের পাপমোচনে হবে আমি জানি না।
তবু সেই রাস্তায় কোন নিরাপত্তা নেয়া হয় নি, হবে কেন, সেখানে তো আর কোন মন্ত্রীর কেউ হারিয়ে যায়নি, সেখানে হারিয়েছে আমাদের খুব যত্নে রাখা একটা মুক্তো……
অন্য কারো তো কিছু না……
আমরা মানববন্ধন করবো, আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবো, আমরা একটা কথাও বলবো না, আমরা একটা বারের জন্যও স্লোগান দেবো না, আমরা রাজপথে গাড়ি ভাংচুর করবো না, আমরা হরতাল দেবো না, শুধু বলবো, আমাদের এই চোখের পানিতে যদি কোন সত্য থাকে, তবে সব পাল্টাবে, নতুন করে একটা বাংলাদেশে আবার নতুন করে নুহা হাসবে……
🙁
এই লেখায় কী কমেন্ট করব আসলে?
শুধু বলবো, আমাদের এই চোখের পানিতে যদি কোন সত্য থাকে, তবে সব পাল্টাবে, নতুন করে একটা বাংলাদেশে আবার নতুন করে নুহা হাসবে……
আমাদের এই অবস্থা বদলাবে এই বিশ্বাসটুকু রাখতে হবে 🙂
লেখাটা ছুঁয়ে গেছে, শৈশব।
নুহা- আমাদের ভালোবাসার নাম, আমাদের পরম আদরের শব্দ। নুহাকে নিয়ে কিছু বলার মত ভাষা আমার কাছে নেই।
শুধু চাই, এই পৃথিবীর নুহারা ভালো থাকুক। অন্তত আমরা যেন বেঁচে থেকে সেরকম একটুকরো পৃথিবী ওদের দিয়ে যেতে পারি, ভালোবাসার পৃথিবী। আমরা চলে গেলেও সেই পৃথিবীর পরিধি বাড়বে নিশ্চয়। বাড়তেই হবে, নুহাদের জন্য, নুহামনির জন্য।
পুরো লিখাটাই একটা ঘোরের মধ্যে থেকে লিখা, সেদিন অফিসেই তরুণ ভাইয়ের এই ছবিটা দেখেছিলাম, অনেক কষ্টে গলার কাছের কান্নাদ দলাটাকে আটকেছিলাম,কখনো যদি নুহারা আমাদের প্রশ্ন করে, কি দিয়েছি আমরা তাদের, কি জবাব দিবো?? জানিনা…
জবাব দিতে গেলে জবাব তৈরি করে নিতে হয়। এলোমেলো করে দিলে আর নম্বর পাওয়া যায় পরীক্ষার খাতায়? জবাব তৈরি করার সময় এসেছে, যে যেভাবে যতটুকুনই পারি, ওদের জন্য ভালো একটা কিছু তৈরি করতেই হবে। হতাশ হতে আর ইচ্ছে করে না। হতাশ হলে আর উদ্যম থাকে না। নুহাদের জন্য আমাদের লড়াই আমাদেরকেই লড়তে হবে।
আমি হাজার চেষ্টা করেও এই লেখার জন্য কোন মন্তব্য খুঁজে পাব না।
সেটাই হয়তো আমার পরম পাওয়া!
“অভ্যাস হয়ে গেছে অনেক কিছুই, রোজকার খবরের কাগজে পড়ি, ট্রাক দুর্ঘটনায় এতো জনের মৃত্যু, ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মারা, ছাদ থেকে ইট পড়ে মারা যাওয়া……
……..তবু এখনো হঠাৎ হঠাৎ টের পাই, নুহাই আমাদের খুব তীব্র একটি সত্য বুঝিয়ে দিয়েছে, নিজের খুব আপনজনকে খুব আঁকড়ে ধরেও আমরা কেউ ঠিক বেঁচে নেই, আমাদের মাথার উপর কোন ছাদ নেই, আমাদের কেউ দেখে রাখবার নেই।”
সত্যিই তো! নিজের খুব আপনজনকে আঁকড়ে ধরেও কি আমরা নিরাপদ আছি?
অনেক কিছু নিয়েই ভেঙ্গে পড়ি, আবার দাঁড়াই, নিজেকেই নিজে টেনে তুলি, আর তো কেউ নেই আমাদের হাত ধরে নিয়ে যাবার……