কেবল প্রধান প্রধান পাঁচটি শাখায় অস্কার পাওয়াই নয় , জনাথন ডেমি পরিচালিত ‘দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস’ ছবিটি ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত হলিউডের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে ক্রাইম থ্রিলার আর হরর ঘরানার আশ্চর্য সফল এক মিশেল তৈরি করে । জোডি ফস্টার , এন্থনি হপকিংস আর স্কট গ্লেন অভিনীত এই ছবিটি মূলত থমাস হ্যারিস রচিত একই নামের একটি বেস্ট সেলার উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ।
‘দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস’ ছবিটির পুরো ১১৮ মিনিট জুড়েই কেমন রুঢ় ভয়াবহতা অথচ প্রবল
সম্মোহনের এক জাল বেছানো যাতে করে দর্শক যা দেখতে চায় না তাও যেন দেখতে বাধ্য হয় । অপ্রকৃতিস্থ মনস্তত্ত্বের তলদেশ খুঁজে পেতে এ যেন নিরাসক্ত , নিরপেক্ষ এবং পূর্ণাঙ্গ এক অন্বেষণ । ছবিতে দেখা যায় সম্ভাবনাময় তরুণ এফ বি আই প্রশিক্ষণার্থী ক্ল্যারিস স্টারলিং কে নিযুক্ত করা হয়েছে হ্যানিবল লেক্টার নামে এক সাবেক মনোবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলার জন্য , যে কিনা পরিণত হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর নরখাদক সিরিয়াল কিলারে । জেলখানায় ওদের কথোপকথনের সময় আলো-আধারিতে যেন সৃষ্টি হয় এক পরাবাস্তব পরিবেশের , সেখানে হ্যানিবলকে মনে হচ্ছিল অন্য কোন গ্রহ থেকে যেন সে নেমে এসেছে । বস্তুত , হ্যানিবলের ছিল চিন্তা করার এক অপার্থিব অসাধারণ ক্ষমতা, আর এ জন্যই এফ বি আই এর বিহেভারিয়াল সাইন্স ইউনিটের কর্মকর্তা জ্যাক ক্র্যাফর্ডের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ওদের দুজনার গল্পের ছলেই বের হয়ে আসা তথ্য দিয়েই তারা আরেক সিরিয়াল কিলার বাফেলো বিলকে ধরতে পারবে । এই ছবিতে হ্যানিবল চরিত্রটি আসলে দ্বৈততায় পরিপূর্ণ , কখনও তাকে মনে হয় শান্ত,ভদ্র, মধুর ব্যবহারের একজন মানুষ , এই মানুষটিই সময়ে সময়ে আবার পরিণত হয় মানুষখেকো এক ভয়ঙ্কর দানবে । হ্যানিবলের অতিন্দ্রিয় ক্ষমতা তাকে সমর্থ করে তুলেছিল নিখুঁত ভাবে আত্মবিশ্লেষণ করতে যা কিনা ছবির দর্শকদেরও প্রেরণা যোগায় এক গভীর মনস্তত্ত্ব ধারণে ও লালনে । যেই হ্যানিবল জেলখানার প্রহরীদের মাংস চিবিয়ে খায় , তার কী প্রয়োজন ছিল ক্ল্যারিসের সাথে সহানুভূতিশীল হয়ে কথা বলবার ? আসলে এবসলিউট খারাপ মানুষ পৃথিবীতে নেই , তাই এক সিরিয়াল কিলারেরও ইতিবাচক দিক থাকতে পারে । যদিও কিছু কিছু জায়গায় হ্যানিবল তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় , কিন্তু ক্ল্যারিসের বুদ্ধিমান চালে পা দিয়ে সে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নানা তথ্য দিয়ে ক্ল্যারিসকে সাহায্য করে । মানব মনের সুমতি-কুমতির যুগপৎ উপস্থিতির প্রমাণ হতে পারত এটি । কিন্তু গল্পের সমীকরণ এত সহজ ছিল না ।
মানব মনের বিকৃতির চরম রূপও উঠে এসেছে এতে । আসলে , হ্যানিবল এর বিকৃত মনের উপভোগ্য খাদ্য ছিল কোন পেশেন্টের অতীতের বীভৎস ইতিহাস নিয়ে মনযন্ত্রনা । ক্রাফোর্ড যদিও ক্ল্যারিসকে নিষেধ করেছিল তার জীবনের কোন কথাই যাতে সে হ্যানিবলকে না বলে , কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বলতে হয়েছিল ছোটবেলায় বাবা মা হারিয়ে আত্মীয়ের বাসায় ভেড়ার কসাইখানার পশুহত্যার ভয়ঙ্কর দৃশ্যের কথা , যা জীবনেও ক্ল্যারিস ভুলতে পারেনি । এই তথ্যই হয়ত হ্যানিবলকে পরবর্তীতে নৃশংস করে তোলে এবং ভয়ঙ্কর হত্যালীলা চালিয়ে সে জেল থেকে পালায় । কিন্তু তার আগেই সে ক্ল্যারিসকে আকার-ইঙ্গিত-কাগজপত্রের চিহ্নের মাধ্যমে বাফেলো বিল সম্পর্কে জানিয়ে দেয় । এই তথ্য বিশ্লেষণ করেই ক্ল্যারিস শেষ পর্যন্ত বাফেলো বিলকে ধরে ফেলে । আশ্চর্য এই , এক সিরিয়াল কিলারকে ধরতে সাহায্য করল আরেক সিরিয়াল কিলার ।
নৃশংসতায় বাফেলো বিলও কম যায় না ,আসল নাম জ্যাক গর্ডন , চমক হল -সে ছিল ট্রান্সজেন্ডার । পুরুষ আর নারীর মাঝামাঝি থেকে সে পুরোপুরি নারী হয়ে যেতে চেয়েছিল, তাই নারীদের দেহের সত্যিকার চামড়া দিয়ে পোশাক বানানোর ভয়ঙ্কর এক আকাঙ্ক্ষা পেয়ে বসে তাকে । এই উদ্দেশ্যেই সিনেটরের মেয়ে ক্যাথেরিন কে বন্দি করে রাখে সে , কিন্তু অনুসন্ধান করতে করতে ক্ল্যারিস ততক্ষণে বাফেলো বিলের আস্তানায় পৌঁছে গেছে । সেখানে বেজমেন্ট থেকে ক্যাথেরিনকে উদ্ধার করে সে । বেজমেন্ট কী মানবিক অবনমনের প্রতীক ছিল ? কতোটা নিচে নামতে পারে মানুষ ! শেষ পর্যন্ত বাফেলোকে হত্যা করে ক্ল্যারিস । আর এরই সাথে শেষ হল শ্বাসরুদ্ধকর টান টান সময়ের , ক্যাথেরিনকে উদ্ধারের মাধ্যমেই ক্ল্যারিসের মনে শান্তি এসেছিল , যেমনটা ইঙ্গিত দিয়েছিল হ্যানিবল , তার অন্তর্দর্শন দিয়ে – শৈশবের কাতরাতে থাকা ভেড়াগুলোর নীরবতা, সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বসই এই শান্তির মূর্তিমান প্রতীক ।
এই ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য জোডি ফস্টার এবং এন্থনি হপকিংস দুজনেই বহুল প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন । ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে সামান্য বিতর্ক উঠলেও , সর্বকালের সেরা থ্রিলার মুভির তালিকায় অনায়াসেই জায়গা করে নিয়েছে‘দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস’ ।
-সাফির আবদুল্লাহ