একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করা যাক?
“যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এক সৈনিক পালিয়ে আসলো। সবাই বলতে লাগলো- শেষ পর্যন্ত কাপুরুষের মতো পালিয়ে এলে?
মানুষটা কিন্তু জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট মুন্সিগঞ্জে তার জন্ম। ভানুর বাবা মা দুজনেই ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতেন- ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারে ব্রিটিশ বিরোধী যেকোনো মনোভাব এমনকি কথা বলাও এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তা না মেনেই মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে আস্তে আস্তে ভানু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে ঢাকার বেশিরভাগ অনুশীলন সঙ্ঘের ‘আরএসপি” নামে একটি বামপন্থি দল গঠন করেন যাতে ভানু যোগ দেন। কিন্তু এই রাজনীতিই কাল হল তার জন্য। ১৯৪১ সালে তার বিরুদ্ধে “হুলিয়া” জারি হলে দেশ বিভাগের অনেক আগেই তিনি ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। সেখানে গিয়েও চুপ করে বসে থাকেননি- সেটা সম্ভবত তার রক্তেই ছিল না। ৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ছেলেবেলা থেকেই ভানুর মন ও মননে এক আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই দীনেশ বাবু যখন ব্রিটিশ গোলামদের হাতে মারা যান, ভানু কিছুটা হলেও ভেঙ্গে পড়েন। এই কারণে বিধাতার উপরে বেশ ক্ষোভও ছিল তার, দীনেশের মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- “ভগবান! তোমার লীলা বোঝা ভার! একটা ব্যাপারে তোমার উপরে আমার ভীষণ রাগ- তুমি আত্মার নিজস্ব কোন শক্তি দিলেনা কেন? দিলে দীনেশদার আত্মা এখনকার বাকসর্বস্ব, অসৎ রাজনীতিওয়ালাদের মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলতেন!”
ব্যক্তি ভানুকে নিয়ে অনেক কথা হল, এবার শিল্পী ভানুর দিকে আসা যাক। ১৯৪৬ সালে “চন্দ্রগুপ্ত” নামে একটি নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং সবার নজরে আসেন। এরপরেই যাত্রা শুরু বিভূতি চক্রবর্তীর “জাগরণ” দিয়ে। তবে শোনা যায়, তার শুরুটা নাকি আরও আগেই হয়েছিল, ষষ্ট শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তিনি “রনবির” নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রে তার অনুপ্রেরণার নাম ছিল “চার্লি চ্যাপলিন”। টালিগঞ্জের তার বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ত চ্যাপলিনের এক বিশাল ছবি। সম্ভব হলে প্রায় প্রতিদিন “গ্রেট ডিক্টেটর” দেখতেন, “গোল্ড রাশ” দেখে ভয়াবহ কষ্ট পেয়েছিলেন। “লাইমলাইট” দেখে বাড়িতে এসে কেঁদেছিলেন।
ভানুর জীবনের একটি বিশেষ সিনেমা হল “যমালয়ে জীবন্ত মানুষ”। একটু খুলে বলা যাক- ভানুকে মৃত ভেবে দুই যমদূত তাকে যমালয়ে নিয়ে যান। সেখানে ঘটনাক্রমে ধর্মরাজের সিংহাসনটি দখল করেন তিনি। এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি ধর্মের বিধান সংস্কার শুরু করেন। মানুষের পাপ পুণ্যের হিসাব যারা রাখেন তাঁদের মাঝে একজন হলেন বিচিত্রগুপ্ত। তার সাথে কথোপকথনের সময় মানুষের আয়ুর বিধান নিয়ে ভানু বলেন- “কি আমার বিধানরে! সুন্দর ফুটফুটে শিশু,মায়ের কোল উজ্জ্বল করে আছে, সে মরে গেল! ২০ বছরের জোয়ান ছেলে , দেশের আশা ভরসা-তার অকালে মৃত্যু! আরে বাবা, অকাল মৃত্যুই যদি হবে, জন্মাল কেন তাহলে?” এরপরেই বিচিত্রগুপ্তকে নিয়ম পরিবর্তন করে ভানু লিখতে বলেন, “লেখ, একশ বছরের আগে কোন মানুষের মৃত্যু হবেনা। আপনারা নিজেরা অমর হয়ে থাকবেন- আর মানুষের বেলায়? যতোসব! না না, শুধু বেঁচে থাকবে না।… লেখ, অদক্ষ বা পঙ্গু হয়ে নয়, মানুষ বেঁচে থাকবে মানুষের মতো হয়ে!”
বস্তুত এটা সিনেমার সংলাপ হলেও, সাম্যবাদী ভানুর মনের কথাই ছিল এটা- মানুষ বাঁচবে মানুষের মতো। যমালয়ের এই কৃত্তিম ভানুই ছিলেন “মানবালয়ের” প্রকৃত ভানু। বলাবাহুল্য- এটাও কিন্তু ছিল কমেডি সিনেমা। কিন্তু কমেডির রূপ বিভিন্নরকমের হলেও, তার উদ্দেশ্য সর্বত্র ও সর্বদা এক- ব্যাঙ্গের অস্ত্র দিয়ে অন্ধকার, অত্যাচার ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই- ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এই জিনিসটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।
অভিনেতা হিসেবে ভানু প্রতিষ্ঠিত ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হলেও, তিনি কখনও বদলে যান নি। তবে তার এই সচ্ছলতাও কিন্তু সবসময় ছিল না, টালিউড সিনেমার সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে প্রযোজকদের বিরুদ্ধে আর অভিনেতাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি- এ কারণে টানা পাঁচ বছর তাকে “ব্ল্যাক লিস্টেড” করা হয়, কোন কাজ পাননি তিনি। কাজ পেলেও করবেন কীভাবে? কারণ জীবনে একটি কাজই শিখেছিলেন তিনি- অভিনয়!
ব্ল্যাক লিস্টেড করেও কেও দমাতে পারেনি ভানুকে, যাত্রাদল নিয়ে গ্রামে গঞ্জের মাঠে মাঠে যাত্রা করে বেড়াতেন তিনি। বেশ কয়েকটি কৌতুকের এ্যালবামও আছে তার, যার প্রথমটি বের হয় ১৯৪৩ সালে, নাম ছিল “ঢাকার গাড়োয়ান”। এভাবেই আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি, কোন কিছুই তাকে থামাতে পারেনি, এমন একজন শিল্পী তিনি যিনি কারো কাছে হার মানেননি। কেও তার উপরে প্রভুত্ব খাটাতে পারেনি, নিজেকে নিজের মত করেই উপস্থাপন করেছেন তিনি। কাজের মধ্যে থেকেই ১৯৮৩ সালের৪ মার্চ কলকাতায় পৃথিবী ত্যাগ করেন তিনি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছেন, “পূর্বসূরির প্রতি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা, সমসাময়িকের প্রতি এমন দ্বিধাহীন, ঈর্ষাশূন্য স্বীকৃতি আর কয়জন শিল্পীর মাঝে দেখত পাই?”
ছোট্ট এক লাইনের এই বাক্যটির আড়ালে কতটা বেদনা, কতটা আফসোস, কতটা জীবনদৃষ্টি লুকিয়ে আছে, তা হয়তো কেবল ভানুই জানতেন। ভাঁড় ভেবেই লোকে হয়তো তাকে এখন ভুলতে বসেছে- ইতিমধ্যে বেশভালভাবে ভুলে গেছেও বলে মনে হয়। বাঙালি জাতি বলে কথা- নিজের প্রতিভার কথা মনে রাখার মতো স্মরণশক্তি তার নেই, তাই আরেকটি ভানু জন্মায় নি বাংলায়, জন্মাবেও না। তবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদানকে, তার শৈল্পিক সত্তাকে, তার ব্যক্তিসত্তাকে, তার চিন্তাকে,হাস্যরসের মাধ্যমে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামকে কেও অস্বীকার করতে পারবে না, অস্বীকারের “ভান” করেও “ভানুকে” অস্বীকার সোজা না।
:welcome:
চমৎকার লেখনী। লেখকের শুভ কামনা। 😀
চমৎকার লেখনী! বেশ ভালো লেগেছে!
:clappinghands:
বাঙলা সিনেমার জগতে হাস্যরসের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রদ্ধাঞ্জলী!