১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ নাট্যকার জে বি প্রিস্টলি লিখেছিলেন ‘অ্যান ইন্সপেক্টর
কলস’ নামের একটি নাটক। যে নাটকটি জনপ্রিয়তার কারনে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে
পড়ে। বর্ণনাময় একটি পরিবারের গল্পকেই কেন্দ্র করে এই নাটকটি তার ডালপালা
ছড়িয়ে ছিল। নাট্যকার অজিত গঙ্গোপাধ্যায় এই নাটকটির অনুকরণে রচনা করলেন
নাটক “থানা থেকে আসছি”। পরিচালন হিরেন নাগ এই নাটকটি থেকে প্রথম সিনেমা
তৈরি করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে কলকাতার মঞ্চে শ্যামল সেন এর মঞ্চায়ন করেন।
পরবর্তিতে ২০১০ সালে সারন দত্ত আবারো বড় পর্দায় নিয়ে আসেন এই সিনেমাকে
এবং এটি তার পরিচালনায় প্রথম সিনেমা।
১ঘন্টা ৪০ মিনিটের এই সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন, পাওলি দাম, রুদ্রনীল ঘোষ,
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, আলকনন্দা রায়, শ্রাবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, দুলাল
লাহিড়ী এবং সব্যসাচী চক্রবর্তী। সঙ্গিত পরিচালনায় জিৎ গাঙ্গুলী,
চিত্রগ্রাহক-সৌমিক হালদার। মারফিউস মিডিয়া ভেনচার্স প্রাইভেট লিমিটেডের
ব্যানারে এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ২৯ জানুয়ারী ২০১০ খ্রিঃ।
কাহিনীসংক্ষেপঃ
“থানা থেকে আসছি” সিনেমাটির নাম শুনলেই বোঝা যায় কোন ঘটনার সূত্রপাত
নিয়েই চিত্রায়িত হয়েছে সিনেমাটি। বর্ষার জলে ভেজা সন্ধ্যে সেই সাথে
বস্তির চা দোকানের পাশে সন্ধ্যে সঙ্গিতের আয়োজন এরকম দৃশ্যপট দিয়েই
সিনেমাটির শুরু। বস্তির তরুনী সন্ধ্যা মন্ডলের চোখে জল বিষণ্নতার ছাপ আর
মুখের মেঘভার ভাবের কারনে বোঝা যায় করুণ ভাবনায় সে জর্জরিত। একই সাথে
শহরের অন্য প্রান্তে ধন্যাট্য ব্যবসায়ী অমরনাথ মল্লিকের মেয়ের এনগেজমেন্ট
অনুষ্ঠান চলছে। এই দুটোর দৃশ্যের মাঝেই বস্তির ঘরে থাকা সন্ধ্যা মন্ডল
ব্লেড দিয়ে হাতের রগ কেটে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।
অপরদিকে অমরনাথ মল্লিকের এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান শেষ হলে পরে হঠাৎ হাজির হয়
পদ্মপুকুর থানার ইন্সপেক্টর তিনকড়ি হালদার। একই রুমে তখন আলাপচারিতায়
ছিলেন অমরনাথ মল্লিক ও তার স্ত্রী সুতপা মল্লিক যিনি একজন সমাজ সেবি।
নিবেদিতা নামে মেয়েদের একটি সংঘটন চালান, মেয়ে রিনিতা, ছেলে অরিন যিনি
পেশায় একজন সিনেমা পরিচালক এবং তাদের হবু মেয়ে জামাই রজত দত্ত।
ইন্সপেক্টর তিনকড়ি হালদার সবিনয়ে জানালেন আজকের এই আনন্দঘন অনুষ্ঠানে
একটি বিষয় তিনি বলতে এসেছেন। সন্ধ্যা মন্ডল নামে পাশের বস্তির একটি মেয়ে
সুইসাইড করেছেন এবং মৃত্যুর পূর্বে একটি ডায়েরি রেখে গেছেন। যে ডায়েরিতে
এই ঘরে থাকা প্রত্যেকটা সদস্যের নাম লেখা রয়েছে। কথাটা শুনে প্রথমে সবাই
একটু হকচকিয়ে যায় এবং প্রত্যেকেই অস্বীকার করেন কেউ তারা সন্ধ্যা মন্ডল
নামে বস্তির কোন মেয়েকে চেনেন না। তারা হাই সোসাইটির লোক তাদের সাথে
বস্তির কারো কোন সংযোগ থাকতে পারে না। রজত দত্ত বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে
তিনকড়ি হালদারের উপর ক্ষিপ্ত হন। তিনকড়ি হালদার সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ
করতেই এখানে এসেছেন বলেন জানান। সিনেমার পরের দৃশ্য থেকে গল্পে মূল রহস্য
উন্মোচন হতে থাকে।
জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে তিনকড়ি হালদার সন্ধ্যা মন্ডলের ছবিটি অমরনাথকে
দেখাতেই তিনি চমকে উঠেন। রেবা মিত্র নামে তার অফিসে এই মেয়েটি কাজ করতো।
একদিন রাতে সহকর্মীকে অফিসের অন্য এক অফিসার কর্তৃক লাঞ্ছিত হতে দেখে
অভিযোগ করেন। কিন্তু সেই অভিযোগ কার্যকর না হয়ে উল্টো তার আয় রোজগারের
উপায় এই চাকরীটিও চলে যায়। অন্যায় হজম করে নিরপরাধ তরুনীকে চাকুরী থেকে
বরখাস্ত করেও তিনি অনুশোচনা বোধ করেন না।
তারপর মেয়ে রিনিতা সেনকে সন্ধ্যা মন্ডলের ছবি দেখাতে তিনিও চমকে উঠেন।
এবং স্বীকার করেন তিনিও এই মেয়েকে চেনেন। কোন একদিন শপিং মলে ড্রেস চেঞ্জ
রুমে এই মেয়েটির হাত থেকে কাপড় পরে দেখার সময় পাশের সেলসম্যান বলেছিলেন
রিনিতার চেয়ে এই মেয়েটির শরীর অনেক সুন্দর। সেই ক্ষোভে অভিযোগ করে
রিনিতা। এবং সন্ধ্যা মন্ডলের ২য় চাকুরীটিও চলে যায়।
হবু জামাই রজত দত্তকে যখন সন্ধ্যা মন্ডলের ছবিটি দেখানো হয়। তিনিও চমকে
যান! কারন তিনি এই মেয়েকে একদিন বখাটে ছেলেদের হাত থেকে বাচিয়ে নিজের
অফিসে চাকুরী দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে এই মেয়েটিকেই ভোগ করবার জন্য তার
হাতে টাকা গুজে দিয়েছিলেন। যার ফলাফল ৩য় বারের মতো চাকুরী হারায় সন্ধ্যা
মন্ডল।
৩য় বারের মতো চাকুরী হারিয়ে মনে আরো একটু সাহস আসে সন্ধ্যা মন্ডলের।
বেচেঁ থাকার তাগিদে নিজেকে আবারো এনে দাড় করার যুদ্ধে। সিনেমার এক্সট্রা
হিসেবে যোগ দেন অরিন মল্লিকের সিনেমায়। আবারো লাইম লাইটে চলে আসেন
সন্ধ্যা মন্ডল। প্রেম জমে উঠে অরিন মল্লিকের সাথে এবং বিয়ে করবেন বলে
প্রতিশ্রুতিও দেন। তারপর হঠাৎ একদিন বার্লিনের চলচিত্র উৎসবে অরিন চলে
গেলে সন্ধ্যা মন্ডল আবারো পরাজিত হয় সমাজের মানবতার কাছে।
এই দৃশ্যপট অবধি গল্পটা দুর্দান্ত ফরিঙ হয়ে উড়ছিল তারপর শেষ বয়ানে সুতপা
মল্লিকও স্বীকার করেন একদিন এই সন্ধ্যা মন্ডলকে তিনি অপমানিত করে তাড়িয়ে
দিয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল এই, সে এসেছিল অরিন মল্লিকের সাথে তার
সম্পর্কের কথা জানাতে। সুতপা মল্লিক চরম দুর্ব্যবহার করে উচ্চ বিলাসীদের
মানবতা কি হতে পারে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। শেষবারের মতো অপমানিত হয়ে
সন্ধ্যা মন্ডল যখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘরে ফিরছিলেন তখন ছিলেন
সন্তানসম্ভবা।
শেষ দৃশ্যে দেখতে পাই তিনকড়ি হালদার কারো উপর সমন জারি বা হাতকড়া না
পড়িয়ে ডায়েরিটা রেখে চলে যান। ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে দেখা যায় সেখানে কিছু
লেখা নেই। এবং খবর নিয়ে জানা যায় তিনকড়ি হালদার নামে কোন ইন্সপেক্টর ও
নেই। এই বিষয়টাকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করে সুতপা, রজত এবং অমরনাথ কিন্তু
বিবেকের দংশনে অরিন ও রিনিতা নিজেদের দোষারোপ করে। শেষ পর্যায়ে রিনিতা
বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় রজতকে এবং সেই মুহূর্তেই খবর আসে পাশের মেছো
বাজার বস্তিতে কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে এবং পুলিশ এই দিকেই আসছে।
সিনেমার কথকতাঃ
সিনেমার বেশ কিছু অংশে ও শেষান্তে রবীন্দ্রনাথ, ঋত্বিক ঘটক এবং
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের দুর্দান্ত কিছু কবিতার লাইন সিনেমার গল্পটাকে
প্রস্ফুটিত করেছে। অভিনয়ে পরমব্রত আর শ্রাবন্তি ব্যানার্জির সামান্য
দুর্বলতা ছাড়া বাকী সবার অভিনয় পারফেক্ট। দুর্দান্ত টানটান গল্পই
দর্শকদের শেষ অবদি নিয়ে যাবে। এছাড়া সিনেমার দৃশ্যপটে কোন নতুনত্ব নেই।
বস্তির মেয়ের বস্তি টাই কিন্তু অদৃশ্য। রগেরগে শয্যা দৃশ্যটি সিনেমার
কিছুটা অংশকে ফ্যাকাসে করেছে। যে দৃশ্যটি না থাকলেই বোধ হয় ভালো হতো। এমন
পারিবারিক একটি সিনেমায় বেশ আপত্তিকর।
মোটাদাগে কিছু মেসেজ পেতে পারি এই চলচ্চিত্র থেকে। যেমন-টাকা পয়সা মানে
খারাপ, বড়লোক মানে খারাপ। মানে যেরকম সরলীকরণ হয় আর কি? পরস্পরের
কুকর্ম নিয়ে পরিবারের সদস্যরা যখন বিতর্কে লিপ্ত তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে
কুকুরে ঘেউ ঘেউ, বড্ড বেশি হয়ে গেল না। প্রাসঙ্গিক হতে পারে জটিল-কুটিল
এই সময়ে বিবেকের মর্ম । শয্যা ও ধর্ষন দৃশ্য দুটি অন্যভাবে দেখানে যেতো।
এই দৃশ্য দুটি চলচ্চিত্রের পরিচ্ছন্নতাকে নষ্ট করেছে। মূল চরিত্রের
সন্ধ্যা মন্ডলের ব্যাকুলতা সনাতন নিয়মের মতোই চললো। সে কখনো প্রতিবাদী
হতে পারেনি। সিনেমার দর্শক হয়তোবা খানিকটা প্রতিবাদী হবার আশা করে। মদের
অজুহাতে ধর্ষণ দৃশ্যটার এতটা ব্যাপ্তিকাল না হলেও চলতো। সিনেমায় আয়নার
সামনে বিবেক দাড়িয়েও বিদ্রুপের হাসি গেসে গেলো পরিচালক তাতে নতুন কোন
রুপের অবতারণা করতে পারেননি। পরিশেষে শেষ অংশের পারিবারিক ঝগড়ায়
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কুকুরের আস্ফালনের শব্দ দেবার কোনই প্রয়োজন ছিলনা।
যারা সিনেমার গল্পে ডুবে থাকতে চান বা কখনো কখনো বিবেককে নিয়ে যন্ত্রনায়
পড়ে যান তারা দেখতে পারেন “থানা থেকে আসছি” আশাকরি ভালো লাগবে।
-সকাল রায়
উপমা/বিশেষণ ব্যবহারে দূর্বল মনে হয়েছে।
যতি চিহ্নের ব্যবহার এবং অনুচ্ছেদ আলাদা করাবার ব্যাপারটাও চোখে লেগছে। ভাষার গাঁথুনি খুব শক্ত নয়।
মুভি রিভিউ হিসেবে পরিচালক আর চিত্রগ্রাহকের পারদর্শীতার ব্যাপারে দুয়েকটা সরাসরি মন্তব্য আশা করেছিলাম, অন্তত এই মুভির ক্ষেত্রে।
আর অনেকগুলো বাক্যই বেশ পরিচিত বলে মনে হল। কেন?
যাই হোক, শুভ কামনা! 🙂