তার সাথে আমার প্রথম কথা কোন এক শীতের হিমহিম সকালে । সারা কলেজ তখনও লেপের তলা থেকে ওঠেনি । সিড়ি দিয়ে নামার সময় সেইদিনের সেই প্রথম কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে । প্রকৃতি সম্ভবত বিচিত্র খেলা খেলতে পছন্দ করে । তাইতো ডিসেম্বরের সেই সকালে ভিন্ন মেরুর দুটি মানুষের মধ্যে সে কিছু একটার বীজ বুনে দিল । আমরা অল্পস্বল্প কথা বলতাম ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে । কখনো কখনো মুঠোফোনের দুই প্রান্ত থেকে । হাজারো ফ্রী মেসেজ চালাচালি করেও আমরা যেন এক সেন্টিমিটার কাছে আসতে পারিনি । শীতকালে পরিচয় বলেই হয়তো শীতল একটা দূরত্ব সবসময়ই থেকে যেত । আমি সবই মেনে নিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম জীবনটা তো এমনিই । কত মানুষের সাথে দেখা হবে, কথা হবে । একদিন সেই মানুষেরা চারপাশ থেকে হারিয়েও যাবে । কিন্তু যখন তার কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা চলে এলো তখন বুঝতে পারি দুবছর আগে বোনা সেই বীজ কি প্রবল পরাক্রমে বেড়ে উঠছে । আমি বিদ্রোহ করতে চাইতাম, সব ভেঙ্গেচুরে ফেলতে চাইতাম শুধু তার পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার জন্য । কিন্তু মনের কথাগুলো তাকে বলা হয়ে উঠতো না, শুধু নীরব একটা কষ্ট মনে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াতো । অনেকগুলো মাস পেরিয়ে যখন আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখা শুরু করেছি তখনই প্রকৃতি আবার তার খেলার চাল দিল । একটা প্রশ্ন, তার একটা উত্তর যেন নতুন করে আমাকে জীবনটা দেখার সুযোগ করে দিল । সেই সময় আমার মনে হচ্ছিল সামনের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, নিষ্ঠুর বাস্তবতা কত ভয়ংকর ভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে । আমি বুঝতে পারছিলাম প্রকৃতির এই খেলায় আমার হার প্রায় নিশ্চিত । তবে আমি বেশীক্ষণ এইসব নিয়ে ভাবি নি, তারপর শুধুই অনুভব করতে চেয়েছি ছোট্ট ছোট্ট সুখের সময়টুকু । একসাথে হাঁটার প্রতিটা পদক্ষেপ, পাশাপাশি বসে ভাগ করা প্রতিটা নিঃশ্বাস, হাতে হাত রেখে দেখা সূর্যাস্তের প্রতিটি আলোক রশ্মি আমি উপভোগ করতে চেয়েছি । যখন কাছাকাছি ছিলাম তখন আমরা নিজেদের দূরত্বটা কমানোর চেষ্টা করি নি । আর এখন যখন কয়েকশ কিলোমিটার লম্বা একটা সরলরেখার দুই প্রান্তের দুটি বিন্দুর মত আমরা দুটি প্রাণী, তখন এক সেন্টিমিটার কাছে আসার জন্য মুঠোফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা, লোহার মত শক্ত বেঞ্চে পিঠ সোজা করে বসে শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরে আসি, কাউন্টারে ঝগড়া করে চাকার ওপর বদখত সিটের টিকেট কাটি, কনকনে শীতের রাতে আকাশের চাঁদের দিকে তাকাই অন্যজনও হয়তো একই সময়ে মুখ তুলে চেয়েছে এই ভেবে । আমরা শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছি এই আশাতেই যে যদি মিরাকল বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে যেন দুজন একসাথেই সেটা দেখে যেতে পারি ।
ছোট্ট দুজন বালক-বালিকার মাঝে পরিচয় হয় একসাথে স্কুলে পড়তে গিয়ে । দুজনেই চুপচাপ স্বভাবের, ভালবাসে বই পড়তে । অল্প সময়েই তারা হয়ে ওঠে একে অপরের প্রাণের বন্ধু । কিন্তু নিয়তির ইচ্ছা ছিল অন্যরকম । জীবিকার কারণে তাদের দুজনের পরিবারকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শহরে আস্তানা গাড়তে হয় । বালক-বালিকার বুকের কান্না চিঠির পাতায় সাজিয়ে তোলা ছাড়া আর কিছুই হয়তো করার ছিল না । দুই শহরের দুই প্রান্ত থেকে লেখা চিঠিগুলো পড়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে না তারা, হঠাৎ হঠাৎ দেখাও হয়তো হয়, কিন্তু সে দেখা হওয়াটা যেন নতুন করে দূরে থাকার কষ্টটা মনে করিয়ে দেয় । এমনি করেই তারা আরও বড় হয়ে ওঠে । অনেকগুলো বসন্ত পার করে, অনেক মানুষের সাথে গল্প করে, অনেক স্বপ্ন চিঠির পাতায় সাজানোর চেষ্টা করে তারা একসময় ফিরে আসে সেই পুরোনো শহরে । চেরী ফুলের পাপড়ি গুলো কি আবার তাদের চারপাশে তুষারের মত ঝরবে?
প্রথম গল্পটা আমার নিজের জীবনের গল্প । আর পরের গল্পটা জাপানী অ্যানিমেশন সিনেমা ফাইভ সেন্টিমিটার পার সেকেন্ড এর গল্প । দুটা গল্পের মাঝে হয়তো কোন মিল নেই কিন্তু অর্ধযুগ আগের আমার সেই স্মৃতিগুলো আবার নতুন করে যেন ফিরে আসলো । সত্যিই তো, সময় আর নির্মম বাস্তবতার কাছে কত সহজেই না আমাদের স্বপ্নগুলো ম্লান হয়ে যায় । তারপরও আমরা নানাভাবে সেই স্বপ্নের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই ।
সিনেমাটা বের হয় ২০০৭ সালে । দৈর্ঘ্য মাত্র ৬৩ মিনিট । তিন পর্বে একটি ছেলের গল্প উঠে এসেছে । সিনেমার মিউজিক আহামরী কিছু না, প্লট বেশ ভাল । অ্যানিমেশন যেহেতু অভিনয় নিয়ে কথা বলার কিছু নেই । গ্রাফিক্স চমৎকার, হাই রেজুলেশনে দেখলে ভাল লাগবে । সবকিছু মিলিয়ে ড্রামা ধাঁচের সিনেমা । মুভিটা ভাল না খারাপ সেটা বিচার করতে যাচ্ছি না, শুধু বলতে পারি সিনেমাটা দেখে নিজের জীবনের চাপা পড়ে থাকা কিছু অনুভূতি নতুন করে আবিস্কার করলাম, বারবার মেলানোর চেষ্টা করলাম গল্পের চরিত্রের কাছে থেকে আমি কোন দিক থেকে ভিন্ন, নিজেরই একটা ছায়া যেন পর্দায় আবছাভাবে চোখে পড়ল ।
নাম- নাহিদ