ক্লাসিক কি? সময়ের আবর্তে যার রং-রুপ-গন্ধ বিকৃত হয় না বরং কালের পরিক্রমায় যা হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয়, আরও বর্ণীল, হয়ে ওঠে সমহিমায় ভাস্বর। তেমনই এক টাইমলেস ইটালিয়ান ক্লাসিক ‘La Megleo Gioventu’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইটালিয়ান এক পরিবারের ২ ভাই এর জীবন-দর্শন আর তাদের চারপাশের মানুষদের উপজীব্য করে চার-দশক ব্যাপ্তি নিয়ে ১৯৬০-২০০০ সালের সমসাময়িক সমাজ ব্যাবস্থা এবং এই সময়ের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালবাসা আর হর্ষ বিষাদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত ২ পর্বে সমাপ্ত এক মহাকাব্য। ড্রামা জনরে’র এই মুভি তাই শুধুই আরেকটি নিছক মুভি নয় বরং সমালোচকদের দৃষ্টিতে সময়কালীন সময়ের অন্যতম সেরা অনন্য এক সৃষ্টি।
মুভি শুরু হয় ৬০ এর দশকের শুরুতে ২ ভাই ‘নিকোলা’ আর ‘মাত্তেও’ এর উত্তাল জীবনের সূচনা দিয়ে। এক ভাই আবেগী, আবেগতাড়িত তার জীবনের সব সিদ্ধান্ত, আরেক ভাই এর পা থাকে সব সময় মাটিতে। কিন্তু আবেগী ভাই এর পাল্লায় পড়ে এক ভাগ্যহীনা মানসিক প্রতিবন্ধী তরুণীকে উদ্ধার করতে গিয়েই প্রথম তাদের পরিচয় হয় জীবনের রুঢ় কঠিন বাস্তবতার সাথে, শুরু হয় তাদের ছুটে চলা জীবন। রোম থেকে নরওয়ে-তুরিন-পালেরমো-ফ্লোরেন্স হয়ে আবার রোমে ফিরে আসা নিরন্তর ছুটে চলার এই সময়ে কালের পরিক্রমায় তাদের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সমকালীন দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি আর সমাজ ব্যাবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের। কেউ যেমন তার নিজস্ব দর্শনের জন্য নিজের পরিবারকে ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি, আবার কেউ সব বাধাকে তুচ্ছ করে ভালোবাসারজন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি। উচ্ছাস কাব্যের মাঝে বেদনার নীলে রাঙানো এক সময়ের প্রতিচ্ছবি যেন এই ছবি। চলার পথ একেকজনের একেক দিকে চলে গেলেও সময়ে সময়ে আবার তারা এসে মিশেছে এক মোহনায়। প্রিয় কাউকে অকালেই হারানোর বেদনা যেমন এখানে আছে, তেমনি না চাইতেই পেয়ে যাওয়ার মত মিরাকলও আছে। ফ্লোরেন্সের ‘৬৬ এর বন্যা, মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন বা চরমপন্থি টেরোরিস্ট গ্রুপ রেড ব্রিগেডের উত্থানের মত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো একদিকে যেমন তুলে ধরা হয়েছে তেমনি এর প্রভাবে বদলে যাওয়া জীবনের সুক্ষ পরিবর্তনগুলোও সুনিপুনভাবে উঠে এসেছে চরিত্রগুলোর মাঝে। আগের প্রজন্মের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে নিজের শিকড়কে জানা, নিজেকে জানা তথা আত্ম পরিচয় উদঘাটনের মাঝেই যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিরন্তর হাত বদলে চলা ক্লান্তিহীন এই ব্যাটন।
মুভির পছন্দের দিকের কথা বলতে চাইলে প্রথমেই আসতে হয় এর কাহিনী এবং চিত্রনাট্যে তে। চার দশকের কাহিনীর চিত্রায়ন হয়েছে নিখুঁত ভাবে ইতিহাসের আলোকেউপজীব্য করে। মুভির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক তাই এর ক্যারেক্টার বিল্ড-আপ। প্রতিটা চরিত্র যেন বাস্তব জীবনের মতই কমপ্লেক্স, তাদের চরিত্রগুলোর বেড়ে ওঠা, পছন্দ-অপছন্দ বা ভালোলাগা বা না লাগার পেছনের কারণগুলো উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। মুলত ইটালিয়ান টিভি এর জন্য নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে ৬ ঘণ্টা দীর্ঘ এই মুভিকে রিলিজ দেয়া হয় ২ পর্বে ‘কান চলচ্চিত্র উৎসবে’ প্রদর্শনের মাধ্যমে। বারতুল্লোচ্চির মহাকাব্যিক Novecento এর পরবর্তী সময়ের কাহিনী নিয়ে নির্মিত বলে প্রথমে একে ‘Novecento part-3’ বললেও সবদিকদিয়েই অগ্রজকে ছাড়িয়ে গেছে তা অনেক আগেই। নিরন্তর বয়ে চলা সময়ের স্রোতের সাথে এগিয়ে চলেছে এই মুভি আর শেষ হয়েছে অনন্ত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের হাতছানির মধ্য দিয়ে। শেষ মানেই শেষ নয় বরং চক্রাকারে চলতে থাকা আমাদের জীবনের শুরু দিয়েই যেন শেষ হয় সময়ের অন্যতম সেরা এই ছবি। তাই মুভির দৈর্ঘ্য নিয়ে কাউকে কখনও নালিশ করতে শুনিনি বরং ৬ ঘণ্টার বদলে যদি তা ৯ ঘন্টাও হত তবুও মুভিটি দেখতে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ভর করত বলে মনে হয় না। অসংখ্য মুভির ভীড়ে অল্প কিছু মুভি থাকে যাদের রেশ কাটানো কখনো সম্ভব হয় না বরং আমাদের চিন্তা চেতনার মাঝে অবচেতন ভাবে তাদের ছাপ রেখে যায় প্রতিনিয়ত। ‘La Megleo Gioventu’ এমনি এক ছবি। জীবনকে দেখুন, জানুন, শিখুন আর উপভোগ করুন, এক জীবনে এর চেয়ে বেশী চাওয়ার কিই বা থাকে !
—-ফজলে রাব্বী আসিফ