চলচ্চিত্রঃ অ্যা শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ (১৯৮৮) [সরব “মুভি থেকে নেয়া”- ১৫]

স্কুলজীবনের শেষ দিকে,হটাৎ করেই অসংখ্য বান্ধবীর ভিড়ে জনৈক বান্ধবীর একটু একটু করে আলাদা হয়ে যেতে থাকা,স্যারের মার খেতে খেতে একজোড়া অনুসন্ধিৎসু চোখে অন্য আরেকজোড়া চোখ দেখে ফেলল কিনা ?তার সন্ধান করা,অথবা আরো বড় পরিসরে বলতে গেলে কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিনেই কারো চোখে আটকে যাওয়াএবং ফলশ্রুতিতে ছেলেটিরও,মেয়েটির কোন রঙের জামার সংখ্যা বেশি,মোট জুতো জোড়ার সংখ্যা,সবকিছুই মুখস্ত হয়ে যায়………জীবনের অতলান্ত থেকে উঠে আসা অপরিচিত এই অনুভুতিগুলো একটা বয়স পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিভিন্ন আঙ্গিকে,ভিন্ন ভিন্নভাবে, রঙ চড়িয়ে আসে!আচরণগত পরিপক্কতা অথবা অপরিপক্কতা কিংবা স্পর্শের মুখরতায় নতুবা সংসারের রামধানু দেখে,আমরা এক এক সময় একেক ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হই,তাই বলে অনুভুতিগুলোর দৌড়াত্ম যে খুব একটা কম তা কিন্তু নয় ।

মানব সভ্যতার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ধরনের অন্তর্নিহিত,অস্পষ্ট উপলব্ধিগুলোকে সেলুলয়েডে ধারণ করার কথা অনেকবারই উঠে এসেছে ,কিন্তু আমার দেখা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিপূর্ণ এবং সফল চলচ্চিত্র, ১৯৯৮ সালে নির্মিত পোলিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিজস্টফ কিয়েসলোস্কির “অ্যা শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ”. ৮৬মিনিটের এই দৃশ্যপটে তিনি অনায়াসেই এমন এক ইতিহাস বলে গেছেন যেখানে জন্ম থেকে জন্মান্তরে পৃথিবীর শুরু থেকে শেষতম মানুষটির ও অবদান ছিল এবং থাকবে ।দর্শক তাকে মেলে ধরবার একরত্তি আকাশ সিনেমাটার কোন না কোন অংশে পেয়ে যাবেন,তিনি একজন আনন্দিত মানুষ হবেন,পুলকিতময় আনন্দে তার ব্যর্থতার ইতিহাসে সাময়িক যবনিকাপাত ঘটবে।তথাকথিত প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং পোষ্টমর্ডানিজমের ঘেরাটোপে বন্দী না থেকে, ঐ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে থাকা একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলোর যে চিত্র সিনেমাটার ভেতর দিয়ে আমাদের মানসপটে ফুটে উঠে তা শিল্পের বিচারে জীবনেরই দর্পণস্বরূপ।

চলচ্চিত্রের আবহ শুরু হয় টমেকের স্বপ্নের ভেতর দিয়ে।সুনিপুণ মিউজিক্যাল টোন এবং দৃশ্যকল্পের নাটকীয়তা সাময়িকভাবে আমাদের মোহগ্রস্ত করে।ফ্রানজ কাফকার ম্যাজিক রিয়েলিজমে ভর করে “মেটামরফোসিস”এ গ্রেগর সামসার ঘুম ভেঙ্গে মহাপতঙ্গে পরিণত হবার ঘটনায় পাঠক যেভাবে বিস্মিত হয়,ঠিক তেমনি ঘোর কাটার আগেই আমরাও টমেকের স্বপ্নে অংশীদার হই।টমেক তার বিপরীত টাওয়ার ব্লকে থাকা ত্রিশোর্ধ চিত্রশিল্পী মাগদার প্রতি একধরনের “মোহগ্রস্ত ভালোবাসা “অনুভব করে।মোহগ্রস্ততা একটা পর্যায়ে এসে অবসেশনে পরিণত হয়। আলবেয়ার ক্যামুর “দ্যা আউটসাইডার” এর চরিত্র “মিয়ারসো” এর সাথে টমেকের চিত্রণশৈলী অনেকটা ধাপে ধাপে থেকে খাপে খাপে মিলে যায়।টমেক স্বপ্নের ভেতরেই মাগদার ফ্ল্যাটে ঘুরে বেড়ায়,তার তুলি হাতে ক্যানভাসে এক একটি আঁচড় দেয়ার আগমূহুর্তে তন্ময় হয়ে যাওয়া,সবকিছুই টমেক কে অতিমাত্রায় আন্দোলিত করে। সে বাস্তবে একটা বাইনোকুলার এনে তার ঘর থেকে সোজাসুজি বিপরীত টাওয়ার ব্লকে থাকা মাগদার ফ্ল্যাট বরাবর সেট করে।এ ধরনের “পিপিং মেকানিজমে”ভর করে হলিউডে “রিয়ার উইন্ডো”নামে আরেক বিখ্যাত হিচককিয়ান থ্রিলার এর জন্ম হয়েছিল।

মানসিকতাটা অনেকটা “ইচ্ছে হয় প্রিয় মানুষটির মাথার উপর একটা সিসি টিভি ক্যামেরা বসিয়ে দেই” এর মতন,যাতে তার প্রতিটি নিঃশ্বাস,                দীর্ঘশ্বাস,স্বপ্নালু বড় বড় চোখ,অবাক হয়ে আচম্বিতে ফিরে তাকানো,আনমনে চুল সড়ানো,কোন কিছুই আমার দৃষ্টিগোচর না হয়।তার সবকিছুতেই যেন আমার অংশীদার হওয়া লাগবে!ব্যাপারটা বোধকরি মোহগ্রস্ততার পর্যায়ে সবথেকে বেশি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশযুদ্ধ পরবর্তীকালে পোল্যান্ডের আর্থ সামাজিক অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার দিকে ইঙ্গিত করে কিয়েসলোস্কি প্রতিটি শুটিং লোকেশন সাজিয়েছিলেন। টমেক সরকারি পোষ্ট অফিসে কাজ করা একাকী এবং নির্বিকার একজন মানুষ।সেই সুবাদে মাগদা মানি অর্ডার নোটিশের খোঁজ নিতে পোষ্ট অফিসে যায়।কিয়েসলোস্কি মাগদার পোষ্ট অফিসে ঢোকা এবং টমেকের সাথে ক্ষুদ্র কথোপকোথনে বিস্তর এক সাইকোলজিক্যাল ডগমা তুলে এনেছেন।যেই মানুষটিকে দেখার জন্য এত আকুতি,রুমের ভেতর বাইনোকুলার সেট করা,সেই যখন মাত্র এক হাত সামনে, নিঃশ্বাসের দূরত্বে,যাকে ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেখা যায়,সেই মাগদার দিকে, টমেক একবারও সরাসরি তাকাতে পারেনি।সমাজের সবচেয়ে বড় মাস্তান অথবা ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট ছেলেটিও কিন্তু প্রথমদিকে প্রিয় মানুষের সাথে চোখাচোখি হবার ইতস্ততায় দিকবিদিকশূন্য হয়।সেই ধারাবাহিকতায় টমেক অন্য আরেক ক্লায়েন্টের কাগজপত্র বের করে দেবার অহেতুক ব্যস্ততা দেখায়।প্রকৃতিগতভাবেই নারীরা এইসকল ক্ষেত্রে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করে থাকে বিধায় মাগদা যখন টমেকের কাছে, নোটিশ এসেছে কিনা জানতে চায়,তখন টমেক জানায় ,কোন নোটিশ আসে নি। প্রতিবারই টমেক ,মাগদাকে এক নজর দেখার জন্য অ্যাড্রেস বক্সে ভুয়া নোটিশ রেখে আসত।

টমেক,মাগদার কাজ শেষে ফ্ল্যাটে প্রবেশের সময়টাতে এলার্ম দিয়ে রাখত এবং বাইনোকুলার দিয়ে তার রুমে ঢোকা থেকে শুরু করে সবকিছুই অবলোকন করত।ফ্রেশ হবার পর মাগদার কিঞ্চিৎ খোলামেলা স্বল্প বসনেও টমেক চোখ সড়িয়ে নিত না। চলচ্চিত্রটিতে হরমোনাল এই ব্যাপারগুলো কোন রকম অতিরঞ্জন এবং স্বর্গীয় প্রলেপ ছাড়াই,সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে ।সাংস্কৃতিক শ্রেণীসংগ্রাম ভালোবাসার উপাখ্যান কে এক এক সমাজে এক এক ভাবে তুলে ধরে ।সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় যখন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম তখনও টমেক চোখ সড়িয়ে নেয় না ,সে বাইনোকুলারের পাশে কফির মগ নিয়ে বসে।এই সকল শুদ্ধতম অনুভুতিগুলো, সংকুচিত হয়ে যাবার বোধটুকুই,বোধকরি ফ্রয়েডিয়ান লিবিডো,সাইকো -এনালাইসিস দিয়ে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় ।

টমেক অন্যপ্রান্তে বসেও মাগদার খাবার শুরু করা পর্যন্ত অপেক্ষা করত। দূরত্ব ব্যাপারটা নিমিষেই ম্লান হয়ে যায়।মাগদা তখন ও জানত না যে একজন মানুষ তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করে।টমেক আগবাড়িয়ে কিছু বলার চেয়ে এই ব্যাপারগুলোতেই এক দন্ড শান্তি বা আশ্রয়ের জায়গা খুঁজে পেয়েছিল ।সেদিক দিয়ে মাগদা জীবন সম্পর্কে একটু ভিন্নমত পোষণ করত।তার ধ্যান ধারনাতে প্লেটোনিক ভালোবাসার থেকেও শরীরবৃত্তীয় চাহিদা হিসেবে যৌনতা প্রাধান্য পেত,তাই ফ্ল্যাটে তার বয়ফ্রেন্ডের আগমন ঘটত।সেদিন তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রারম্ভেই টমেক বাইনোকুলার থেকে চোখ সরিয়ে নেয় কিন্তু দ্বিতীয় দিন ইমারজেন্সিতে ফোন করে বলে যে মাগদার ফ্ল্যাটে গ্যাসের লিকেজ হয়েছে এবং লোকজন সেখানে গেলে তাদের কার্যকলাপে বাঁধার সৃষ্টি হয় ।মাগদা ইমারজেন্সির লোকজনদের বলে যে কোন লিকেজ নেই এবং কে ফোন করে তাদের জানালো তা ভেবে কিছুটা অবাক হয়।আমরা এখানে খুব সহজেই টমেকের মাঝে একজন ঈর্ষিত প্রমিকের আচরণ খুঁজে পাই,কিন্তু যেহেতু তখনও তাদের সম্পর্ক দুদিক থেকেই প্রতিষ্ঠিত নয় তাই ব্যাপারটাতে বোধকরি প্রেমের তকমা লাগানো উচিত হবে না ।তবুও স্বরোপিত অধিকার ব্যাপারটাতে  কিছুটা অশীদারিত্ব আসলেই যেমন মানুষ ঈর্ষা বোধ করে ঠিক তেমনটি টমেকের ক্ষেত্রেও ঘটে।আদিম সমাজে আত্মরক্ষার কৌশল আয়ত্ব করতে গিয়ে   “আমিত্ব”নামক বিশেষনটির অবশিষ্ট অংশ এই “ঈর্ষা” রূপে মানসিকতায় এখনো রয়ে গেছে ।

টমেক মানসিকভাবে কিছুটা বিষন্ন হয়ে পড়ে এবং এই বিষন্নতার পরিমান,যেই সমাজ ,সংস্কৃতিকে ঘিরে মানুষ বেড়ে উঠে তার উপর নির্ভর করে বিধায়, এই দৃশ্য দেখার পরও সে অবসেশন ,ভালোলাগা,ভালোবাসা যাই বলি না কেন,তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে নি ।মাগদার ফ্ল্যাটে মিল্ক ডেলিভারি দেয়ার লোকটির অনুপস্থিতিতে ,টমেক শুধুমাত্র মাগদাকে একনজর দেখার জন্যই মিল্ক ডেলিভারির কাজ নেয় !সেই সময় টমেক ফ্ল্যাটের নিচে অ্যাড্রেস বক্সে মাগদার নামে আবারো অহেতুক মানি অর্ডারের নোটিশ রেখে আসে ,কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি আগের চেয়ে তিক্ত রূপ ধারন করে।মাগদা যখন সুপিরিয়র কারো কাছে আসল ঘটনা জানতে চায় তখন তারা জানায় যে নোটিশ তারা পাঠায় নি,মাগদা তাদের সুনাম নষ্ট করার জন্য এগুলো করেছে ,এই কথা শোনার পর মাগদা রাগে ,ক্রোধে অফিস থেকে বেড়িয়ে যায় ।টমেক প্রচন্দ রকমের অনুতপ্ত হয় এবং রাস্তায় বের হয়ে মাগদার পিছু নায়!সে নোটিশগুলো দিত এটা শোনার পর মাগদা প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয় এবং পেছন ফিরে চলে যেতে থাকে তখনি টমেক বলে উঠে, গত রাতে তুমি কাঁদছিলে কেন?যেটা মাগদা ছাড়া আর কারো জানার কথা নয় , কেননা গতরাতে সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বাকবিতন্ডা করে ফ্ল্যাটে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।এ কথা শুনে মাগদা ফিরে তাকায় এবং টমেকের কাছ থেকেই আবিষ্কার করে সে গত একবছর ধরে তাকে দেখছে!

টমেকের ভাবলেশহীন ঠান্ডা জবাবগুলো এবং পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলা মিউজিক্যাল টোন, এক মহাকাব্যিক পরিবেশের সৃষ্টি করে।দর্শকের এই অবর্ণনীয়,অব্যক্ত অনুভূতি যেন হাজার বছর ধরে প্রচলিত এবং পরিচিত এক অভিসংহার!তারপর দৃশ্যপটে যে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে তা হল,মাগদা রাতেরুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে তাকে ফোন করার জন্য ইঙ্গিত করে,এবং আমাদের সিনেমার নায়ক টমেক যে তখন ও মাগদার দিকে বাইনোকুলার সেট করে রাখবে ,সে ব্যাপারে মাগদা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল।টমেক যথারীতি ফোন করে এবং বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখে যে মাগদা রিসিভার তুলে নিয়েছে !

অতঃপর এমন একটি ঘটনার অবতারণা হয় ,যার জন্য তন্ময় হয়ে থাকা দর্শক কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না। মাগদা তার বিছানা টেনে জানালা বরাবর আনে এবং দরজা খুলে তার বয়ফ্রেন্ডকে ডেকে আনে।তারপর টমেক দেখে যে ,মাগদা তার দিকে ইশারা করছে এবং বলে ওই দালান থেকে একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ।মাগদার বয়ফ্রেন্ড নিচে নেমে গিয়ে পোষ্টম্যান বলে ডাকাডাকি শুরু করে এবং ফলশ্রুতিতে টমেক বেরিয়ে আসে,এবং বয়ফ্রেন্ডটি তাকে আঘাত করে বসে ।টমেক কোন পাল্টা জবাব দেয় নি ,কেননা কিয়েসলোস্কি টমেক চরিত্রটি খুবই সাদাসিদে এবং ভাবলেশহীনভাবে, গভীর আবেগ দিয়ে চিত্রিত করেছেন !

ঠোঁটের দিকে কিঞ্চিত কাঁটা অবস্থায় টমেক পরদিন মিল্ক ডেলিভারি দিতে মাগদার দড়জায় কড়া নাড়ে।দরজা খুলে টমেকের অবস্থা দেখে মাগদার কিছুটা ভাবোদয় হয় ,নতুবা এটা কোন ভাবোদয় নয়,অতিমাত্রায় অসহায় মানুষের প্রতি হয়ত শোষণ তার সক্ষমতা হারায়।মাগদা সরাসরি জানতে চায় ,টমেক তুমি কি চাও? “কিস”,মেক লাভ”এগুলো ?টমেকের কাছ থেকে উত্তর আসে, “না”।মাগদার এইসব প্রশ্ন এবং আচরণে টমেক মারাত্মকভাবে আহত হয়,কারন টমেকের অনুভূতিগুলো মাগদার কাছে কোন অর্থবহন করে না।টমেক যখন বলেছিল “আই লাভ ইউ” তখন মাগদার সোজাসাপ্টা জবাব ছিল “নো সাচ থিং একজিস্ট” ।ঘটনার ভয়াবহতায় দিকবিদিকশূণ্য হয়ে টমেক দৌড়ে ছাদে উঠে যায় এবং দুহাতে বরফের টুকরো নিয়ে দুকানে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ আগে শোনা কথাগুলো সহ্য করতে পারছিল না বলে ,মেটাফরিক্যালি সে তার কানকে অবশ করে দিতে চায়। বিকারগ্রস্ততা কিছুটা স্বাভাবিক হলে টমেক ,মাগদাকে তার সাথে আইস্ক্রিম খাবার আমন্ত্রণ জানায়,দূর্ভাগ্যবশত ওইদিন পার্লারে আইস্ক্রিম না থাকায় টমেক কফির অর্ডার দেয় ,কিন্তু পরবর্তীতে মাগদা রেড ওয়াইনের অর্ডার দিলে টমেক ও তাতে পরিবর্তন করে নেয়।মাগদা সাথে একটি সুতো বাঁধা লাটিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।তার ধারনা লাটিমের ঘূর্ণন দেখে সে মানুষের ওই মুহূর্তের প্রকৃত ভাবনা বলে দিতে পারে।এমন অনেক নিছক,ভিত্তিহীন ব্যাপার মানুষ শুধু শুধুই মেনে নেয়ার অভিনয় করে আনন্দ পায়,মাগদার ব্যাপারটাও তাই।সে টমেকের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে তার উপর কিছুক্ষণ লাটিম ঝুলিয়ে বলে উঠে “ইউ কেয়ারস মি”।

সিনেমাটা দেখতে গিয়ে দর্শক টমেক কে পু্রোপুরি “ইন্ট্রোভার্ট” এবং মাগদাকে “এক্সট্রোভার্ট” হিসেবে চিত্রিত করবেন।কিন্তু কিছু কিছু ইন্ট্রোভার্ট চরিত্রে ব্যক্তিত্বের এমন মিশেল হয় যে একধরনের ছুঁয়ে দেখা শ্রদ্ধাবোধ জন্মে।টমেক চরিত্রটি কোনরকম অতিরঞ্জন ছাড়া ঠিক এমনভাবেই চিত্রিত!

আইসক্রিম পার্লার থেকে বের হয়ে মাগদা,বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা একটি বাস দেখে প্রমোদ গুনে ,যদি তারা বাসটিতে উঠতে পারে তাহলে তারা দুইজনই মাগদার ফ্ল্যাটে যাবে।এতদিন দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখা ঘরের আসবাব,ক্যানভাসে লেগে থাকা শেষ তুলির আঁচড়,প্রতিটি পলেস্তারা,ফটো অ্যালবাম,সবকিছু দেখতে দেখতে একধরনের অন্যমনস্কতা ভর করে টমেকের উপর। অন্যদিকে মাগদা যখন ফ্রেশ হয়ে আসে তখন ও তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল টমেক শুধুমাত্র তার প্রতি শারিরীক আকর্ষন বোধ করে,মানবিক অনুভূতিগুলোর ব্যাপারে সে অতটা      ওয়াকিবহাল নয় ।তাই মাগদা স্লিপিং গাউন পরে সোফায় বসে থাকা টমেকের নিঃশ্বাসের দূরত্বে এসে তাকে সিডিউস করার চেষ্টা করে।তখন মাগদার প্রশ্নটা ছিল অনেকটা এরকম “ডিড ইউ ডু ইট হোয়াইল পিকিং অন মি” ? টমেক উত্তর দেয় “ইয়েস সামটাইমস বাট নট নাউ”।মাগদা আবার বলে উঠে “হোয়েন অ্যা ওমেন ওয়ান্টস অ্যা ম্যান,শি ইজ ওয়েট ইনসাইড,আই এম ওয়েট নাউ”।এই বলে সে টমেকের হাত দুটো নিয়ে তার উন্মুক্ত শরীরে স্পর্শ করায়,ইনডিটেলস বলতে গেলে ,অনেকটা আবেগঘন পদ্ধতিতে সিডাকশন ঘটায়।টমেক আর সহ্য করতে না পেরে মাথা নিচু করে ফেলে,মাগদা ব্যাপারটাকে মিসইন্ট্রাপিট করে এবং বলে উঠে “অল রাইট দিস ইজ হোয়াট ইউ কলড লাভ,দেয়ার ইজ অ্যা টাওয়েল ইন দ্যা বাথ,ক্লিন ইউরসেলফ”।টমেক ,মাগদার এই আচরণে মারাত্মক আহত হয় এবং এক মুহূর্তেই তার এত দিনের সিঞ্চিত অনুভূতিগুলো ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়।মাগদা জানালা দিয়ে তাকে দৌড়ে চলে যেতে দেখে।পরমুহুর্তেই মাগদার সত্যিকারের বোধ এবং অনুভূতি জাগ্রত হয়।সে ভাবে, যে কিনা এতটুকু শরীরবৃত্তীয় উস্কানির পরেও নিজেকে মেলে দেয় নি,তাহলে তার ভালোবাসার বোধটুকু নিশ্চয়ই খুব সাধারনভাবে অসাধারন।মাগদা একটা প্ল্যাকার্ড এ লিখে ”আই এম সরি,প্লিজ কাম ব্যাক”এবং তা টমেকের জানালা বরাবর ধরে থাকে ।কিন্তু টমেক রুমে ঢোকেই বাতি নিভিয়ে দেয়।তারপর টমেক ওয়াশ রুমে গিয়ে রেজর থেকে ব্লেড খুলে হাতের শিরা কেটে ফেলে,এবং বাথটাবের পানি লাল বর্ণ ধারণ করে ,সে অচেতন হয়ে পড়ে ।অতঃপর টমেকের ল্যান্ডলেডি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ।

যেই মুহূর্তে টমেক দৌড়ে মাগদার ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে যায় ,ঠিক ঐ তাৎক্ষণিক মুহূর্তেই মাগদা চূড়ান্তভাবে টমেকের প্রেমে পড়ে,তার প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ থেকে এক চিরস্থায়ী ভালোবাসার জন্ম নেয়,তাকে হারানোর ভয়ে অসহায় বোধ হতে থাকে।দ্রুতবেগে ধাবমান অশ্ব যেমন খাদের কিনারা থেকে উঠে আসতে চায়,তেমন ভাবে মাগদাও টমেক কে ফিরে পেতে চায়।

সেলুলয়েডে কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক করলে আমরা দেখতে পাব ,যেদিন মাগদা তার জনৈক বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে রুমে ফেরে এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে,মানসিকভাবে দিকবিদিকশূণ্য হয়ে  মিল্কের বোতল উল্টে ফেলে দেয়,সেদিন ও অল্প কিছু দূরে অজান্তেই তার দুঃখের ভাগীদার হয় আরেকজন,টমেক ছুরি দিয়ে তার হাত রক্তাক্ত করে।প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা এবং অবসেশন থেকে নিঃসৃত আচরণগুলো সুস্থ মস্তিষ্কে পাগলামি বলে মনে হলেও,সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ এই আচরণগুলোই করে আসছে।সিনেমাটায় কোন লজিক্যাল কনক্লুশনে না যেয়ে,মানুষের আচরণগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে।

মাগদা হন্য হয়ে পোষ্ট অফিস,মিল্ক ম্যান,ল্যান্ডলেডির কাছে টমেকের খোঁজ করে।এভাবে প্রতিদিন সে টমেকের ছোট্ট জানালাটায় চোখ রাখে।প্রকৃতি এবার মাগদার হাতে বাইনোকুলার তুলে দেয় ।এই বুঝি ফিরে এল টমেক,এভাবে একদিন প্রতীক্ষা এবং অনুশোচনার অবসান হয়।ফিরে আসে টমেক,কিন্তু তখনও জানালা ঢাকা থাকে পর্দায়।মাগদা টমেকের ব্যান্ডেজ করা হাতটি নিজের হাতে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।টমেকের টেবিলে রাখা বাইনোকুলারে চোখ রেখে মাগদা তার ফ্ল্যাটের দিকে তাকায়,এবং সেই দিনের দৃশ্যটি দেখে,যেখানে প্রচন্ড কষ্টে মাগদা দরজা ঠেলে ফ্ল্যাটে প্রবেশ প্রবেশ করল এবং টেবিলে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে,কিন্তু পাশ থেকেই আরেকটি হাত পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাইনোকুলার একটু বামে সড়ানোর পর একটি মুখই শুধু দেখা যায়,টমেক এবং শুধুই টমেক!এখানেই নাটকীয়ভাবে ,অনেক কিছু ইঙ্গিতপূর্বক সেই মহাকাব্যিক ৮৬ মিনিটের শেষ হয় ।

সিনেমার দৃশ্যকল্প বা স্ক্রিনে সরাসরি যা দেখানো হয়েছে ,তার চেয়ে বড় অংশ যা ঐভাবে দেখানো হয়নি ,সেখানেই রয়ে গেছে সিনেমার প্রকৃত আবহ,ব্যপ্তি এবং পরিণতি।খুবই সংবেদনশীল মাত্রা নিরীক্ষ ব্যাপারটি দর্শকের অনুধাবন শৈলীর কাছে অনেকাংশে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।আমাদের ভালোবাসা নামক মহীরুহের এমন বাস্তব ধর্মী ,জীবনমুখী উপাখ্যান সিনেমার ইতিহাসে সত্যি বিরল।এখানে যেমন টমেকের হরমোনাল যৌন অনুভূতি বাদ পড়েনি ,তেমনি আবেগের জায়গাটুকু ও সিংহাসন পেয়েছিল।পরিশেষে বলতে হয়,সিনেমাটি শিল্পের বিচারে অনন্য হবার অন্যতম প্রধান আরেকটি কারন হলো ,অসাধারন সব মিউজিক্যাল টোন এর ব্যবহার যা কিনা নিস্তব্ধ অথবা ডায়ালগের অনুপস্থিতে প্রতিক্ষেত্রেইতখনকার ভাষা হয়ে উঠে অন্যদিকে সিনেমাটোগ্রাফিতে আলো ছায়ার খেলায় এমন একটা ঘোর তৈরী হয় যে নিজেকে সিনেমার একটি চরিত্র বলে ভুল হয়।আশা করি সবারই ভালো লাগবে ।

 

বিঃদ্রঃ  কিছু কিছু কথোপকথন এবং শব্দ পুরোপুরি ইংরেজীতে দেবার কারন,আমার কাছে মনে হয়েছে ,যথার্থ বাংলা শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না এবং যথার্থ বাংলা পরিভাষার অনুপস্থিতিতে ডায়ালগগুলো তার তীক্ষ্ণতা,প্রাচুর্যতা এবং পরিবর্ধনশীলতা হারাবে ।

 

 

সাখাওয়াত হিমেল ,

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চলচ্চিত্র-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।