নায়িকা ও মেলোড্রামার গপ্পো [সরব “মুভি থেকে নেয়া”- ২৪]

বিটিভিতে কেন যে নিয়ম করে সপ্তাহে দুই দিন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখাত!

 তা না হলে আমার মত অধমের মাথায় মুভি দেখার ভূত চাপত না। ‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়িঘোড়া চড়ে সে/ মুভি দেখা ভালো না/ সিনেমা হলে যেও না’- মন্ত্রবাক্য জপেই জীবন পার করতে পারতাম!

 

না ছিল প্রাইভেট টিউটর, না ছিল কোচিং এ পড়ার আগ্রহ। মফস্বল শহরে এসবের দৌরাত্ম্যও অতটা ছিল না। তাই শুক্র-শনিবার(কখনো বা বৃহস্পতিবার)  বিকেলটা আরামসে সিনেমার জন্য বরাদ্দ রাখি।  

 

একেই বুঝি বলে বোকা বাক্সে আচ্ছন্নতার বোকামি। ‘সীমানা পেরিয়ে’,’ ‘জীবন থেকে নেয়া’ও দেখি, আবার   ‘নাগ- নাগিনীর প্রেম’, ‘কাজের বেটি রহিমা’ ও আগ্রহ নিয়ে দেখি। তবে ঐ যে অধিকাংশ  সিনেমার শুরুতে নায়ক/নায়িকার বাপ বা মা ( অথবা উভয়ই) ভিলেনের হাতে শাহাদাত বরণ করেন সে আত্মাহুতির আগেভাগে আভাস পাওয়া মাত্র ( আহারে, আমরা দর্শকরা ঠিকই অনুমান করতে পারি,অথচ বেচারা-বেচারিরা পারেন না!) প্রায়শই এক দৌড়ে বারান্দায় পালাই আর দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখি যেন সেই দুঃখের সিনের টুঁ শব্দও  শুনতে না পাই !

 

সেই ছোট্টবেলা থেকেই তো বাংলা সিনেমার মনোযোগী দর্শক। তাই অনেক ছবিতেই প্রাকৃতিক নিয়মে  বড়লোক নায়িকার সাথে গরীব নায়কের প্রেম হবে,  দুষ্টু গুণ্ডাদের দৌড়ানি খেয়ে অবলা নায়িকা ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ করতে করতে নায়কের গায়েই উসঠা খেয়ে পড়বে , অতঃপর ‘ইয়া-ডিসুম-ঢিসুম’ –  নায়কের এহেন বীরত্ব দেখে নায়িকা হাবুডুবু খেয়ে তার প্রেমে পড়বে, মাঝখানে ফুলে-ফুলে-ঢলে-ঢলে নাচ-গান হবে, তারপর মিষ্টি প্রেমে ‘কাবাব মে হাড্ডি’ হয়ে নায়িকার বাবা দুষ্টু বাগড়া দেবে,এবার নায়িকার বাবার  বন্ধুর ছেলেই (যে নায়িকার হবু বর ও মেইন ভিলেন ) নায়িকাকে তার গুদাম- আস্তানায় নিয়ে যাবে,  আবারও ‘বাঁচাও,ছেড়ে দে শয়তান’ বলে বেচারি নায়িকা  হাঁক ছাড়বে,  হাজার মাইল দূরে থাকা বীর নায়কের কর্ণে সে ডাক পৌঁছানো মাত্রই সে তার তুফান বেগের বাইক নিয়ে ছুটে আসবে,  মহানায়ক আবারও দুর্ধর্ষ মারপিট  করবে কিন্তু ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ ডায়লগ নিয়ে পুলিশ বাহিনী চলে আসায় নায়িকার বাবার ভুল বুঝতে পারা ও অমর প্রেমের অমর প্রেমের অমর সমাপ্তি ঘটবে- নিপাতনে সিদ্ধ এত্তগুলা সূত্র কত সহজেই আত্মস্থ হয়ে গেল!   

 

কিন্তু দাঁড়ান-দাঁড়ান! এই যে প্রেম আর নাচ-গান করা, ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ হাঁকডাক করে নায়ককে আলোর  গতিতে  ভিলেনের আস্তানায় নিয়ে আসা- অধিকাংশ বাংলা মুভিতে শুধু এই বুঝি নায়িকার কৃতিত্ব? এই ভেবে হঠাৎ মনের গহীন কোণে সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি!   

 

সব ছবিতে অবশ্য এমন হয় না। এই যে ববিতা-শাবনুর আপারা অনেক সময়ই মুভির শেষভাগে ভিলেনদের টুকটাক ধোলাই দেন। তারপর মৌসুমি আপু ‘বাঘিনী কন্যা’ মুভিতে ভিলেনদের ওপর বদলা নেয়ার মিশনে নামলেন আর শেষমেশ শাবানা অ্যান্টি কি খেলটাই না দেখালেন! (দিতিরও এমন একটা ছবি ছিল)  আর ‘পালাবি কোথায়’ – আহ, সে তো আমার অনেক প্রিয় একটা মুভি ( ব্যাপক বিমলানন্দের ইমো হইবে ^_^ )  

 

ক্লাস নাইনে উঠতেই ঢাকায় আসলাম, এক সময় শুক্রবারে মুভি দেখা মাথায় উঠল। ( দুপুর তিনটার সময়ই কোচিং এ পড়া যে!) তবে ফাঁকফোকর পেলে ( ঈদের সময় বা ক্রিকেট খেলা থাকলে সন্ধ্যায় ছবি দেখায়)  ঠিকই আমার পুরাতন অভ্যাস বজায় রাখি। তবে কি না-

‘ছোট পর্দায় এত দেখি যবে

বড় পর্দায় দেখব কবে?’

 

ঠিকই তো, আব্বু-আম্মু নাকি ছোটকালে  সিনেমা হলে যেতেন, আমার তো কোনদিন যাওয়া হল না। তবে  এখন বাংলা সিনেমার কলিকাল চলে, মধ্যবিত্ত  দর্শকদের হলে যাওয়ার সেই চল বা পরিবেশ কোনটাই নাকি নেই। তবুও তো পত্রিকায় দেখি ‘মনের মাঝে তুমি’,  ‘মনপুরা’ মত ছবিগুলো সুপার হিট হচ্ছে, দর্শকরা আবারও প্রেক্ষাগৃহমুখী হচ্ছে, সিনেমা হলের সামনে গিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় ‘হৃদয়ের কথা’ ছবির পোস্টারখানা যেন আমার দিকেই দিব্যদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল (অথবা উল্টোটা!) । আর ‘ছায়াছন্দ’  অনুষ্ঠানে এসব হিট মুভির গান শুরু হলে তো কথাই নেই- মন আমার বসে না পড়ার টেবিলে!তবে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এর মত একটা সুন্দর মুভি হলে মুক্তি পাওয়ার দিনই টিভিতে দেখাল, দর্শক আর কষ্ট করে হলে যাবেই বা কেন!       

 

কলেজ জীবন  পার হল – আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে বাংলাদেশি থেকে কলকাতার  বাংলা মুভিতে এলাম। ঝকঝকে ছবি , স্মার্ট নায়ক-নায়িকাদের নাচ-গান, চলন-বলন ভালোই লাগে। আবার ওদের দু’একটা চ্যানেলে তো সারাদিনই সেসব সিনেমার ট্রেইলার আর গান চলতেই থাকে( ভাবি, আমাদের দেশে কবে সেই  চ্যানেল হবে!)। তবে বাসার কম্পিউটারে সফল নেট সংযোগ নিয়েই গুগল মামার সার্চের বদৌলতে এক অচেনা মুভি সাইটে দেখলাম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছবি ‘পিরিতির আগুন, জ্বলে দ্বিগুণ’। কিন্তু এ কী-  এক  মুভি দেখা শেষ না হতেই ৩০০ টাকার কার্ডের অক্কালাভ!  

 

অতঃপর ভার্সিটি জীবনে এসে  ল্যাপটপ ও পেনড্রাইভ নামক বস্তু লাভ এবং তার সদব্যবহার শিখলাম। পেনড্রাইভ মারফত  দেশি বা কলকাতাই মুভি নেয়া একসময় হলিউডে গিয়ে ঠেকল । ভাবলাম- এক ঢিলে দুই পাখি মারব-  মানে একদিকে বিশ্বখ্যাত মুভিও দেখব, অন্যদিকে ইংলিশ ভোকাবুলারির জাহাজও বনিব! কিন্তু পরে দেখি সে আশার গুড়ে বালি- কষ্ট করে যে সাবটাইটেল দেখি তাই ঢের,  অভিধানে মুখ  গুঁজে আবার মুভি দেখা যায় নাকি! এভাবেই ‘The Matrix’, ‘Back To the future’, ‘Inception’ ইত্যাদি দেখা হতে লাগল [ নিতান্তই শব্দার্থ জানার খায়েশ বা দরকার হলে গুগল/ ডিজিটাল ডিকশনারি তো আছেই!]      

 

এরই মাঝে মুভিপ্রেমী একদল সহপাঠিনীর কল্যাণে আমার অনেক দিনের বাসনা পূর্ণ হল । ঈদুল ফিতরে সবাই মিলে হলে গিয়ে দেখলাম ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ । এর আগে অবশ্য মহানায়ক  এজে -র ‘স্পীড’ আর  ‘খোঁজ দ্যা সার্চ’ যথাক্রমে টিভি ও ল্যাপটপের পর্দায় দেখা হয়েছিল। আর এবার তো খাট ভেঙে পড়া কি হার্ট বের করে আনা –  নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এই ব্যতিক্রমী ও হাস্যরসাত্মক চিত্রায়ন দেখে সকলেই  নিঃস্বার্থভাবে বিনোদিত হলাম। মনে হল- টিকিটের পয়সা উসুল!  পরবর্তীতে IMDb তেও একে খুশিমনেই ৯ রেটিং দিলাম।  (মেঘলা ওরফে বর্ষা আপা বারবার ভুল করায় ১ নম্বর কম, উনি যে আবারও অনন্ত ভাইকে ধোঁকা দেবেন না তার গ্যারান্টি কি!) । পরের ঈদে আবারও হলে গিয়ে দেখা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’, তারপর ‘ ভালোবাসা আজকাল’, ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ …   

 

এবার এল ‘অগ্নি’- প্রথমে পোস্টার, পরে টিজার আর ট্রেইলার তো ফেসবুকের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ল। আহা, কি দুর্ধর্ষ নায়িকা – চাক্কু নিয়েও তার  স্টাইলিশ  ফাইটিং,বাইক নিয়েও সে কী দর্শনীয় স্টান্ট   (  এমনটাই তো আমার  জেগে জেগে দেখা ছোটবেলার স্বপ্ন!),  তারই মাঝে আবার সুদর্শন নায়কের কণ্ঠে মিষ্টি রোমান্টিকতার আবাহন! একবার দেখে মন ভরে না, শতবার দেখে তর সয় না, ফেসবুকে পেইজ-ইভেন্ট খুলে বসে থাকি কিন্তু নানান অজুহাত আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ছবির রিলিজ বারবার পিছিয়ে যায়।শেষমেশ জানা গেল- ফেব্রুয়ারিতে ছবিটি মুক্তি পাবে- তার মানে আরও দেড় মাসের প্রতীক্ষা!    

 

প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে একদিন আবার কিছু  সহপাঠিনীর থাই-কোরিয়ান মুভিপ্রীতির কথা শুনলাম। সেই উচ্ছ্বাসের বশেই  পেনড্রাইভে একখানি থাই ও কিছু কোরিয়ান মুভি পুরে দেয়া হল। সভয়ে জানতে চাইলাম, ‘থাই- কোরিয়ান ভাষা কিচ্ছুই তো বুঝি না, মুভি দেখে কাহিনী বুঝব তো?!তারা এই বলে আশ্বস্ত করে-সহজ  ইংলিশ সাবটাইটেলের কারণে কাহিনী বুঝতে কোন সমস্যাই হয় না। তাই নো চিন্তা, দেইখ মুভি!

 

সেই থাই মুভি – A Little Thing Called Love – টিনএজ বালক-বালিকার মিষ্টি কাহিনী দেখে আমার মনেও অনেক মুগ্ধতা ভর করল। তাই এবার দেখা শুরু করলাম ওদের কালেকশনে থাকা যাবতীয় কোরিয়ান  মুভি- ‘Innocent Steps’, ‘My Little Bride’, ‘My Sassy Girl’ , ‘Daisy’, ’A Moment to Remember’ .. ( যা দেখি লাগে ভালো!) কিন্তু এই রে ‘My Sassy Girl’ ও ‘Daisy’ র  নায়িকা আবার ‘Windstruck’ নামের একটা মুভি করেছেন (wiki থেকে  জানলুম) – সেটা নাকি আবার ‘My Sassy Girl’ এর কিঞ্চিৎ প্রিকুয়েলের মত। সেই ভেবে ডাউনলোড করলাম এবং দেখা শেষে…

সেই Sassy নায়িকা ও মেলোড্রামা ঘরানার  তুমুল ভক্ত বনে গেলাম! এক দুর্দান্ত-আত্মবিশ্বাসী পুলিশ অফিসার  নায়িকা কাইয়ুংজিন যে কি না নিরীহ ও কিউট নায়ক মায়ুংয়োর জন্য জীবন বাজি রাখে ( সচরাচর তো উল্টোটাই দেখতাম!)আর তাই দেখে ‘অগ্নি’ দর্শনের আগেই আমার স্বপ্নের আরেক প্রস্থ পূরণ হয়ে গেল!   

 

শেষ কথাঃ

পরবর্তীতে বাধার আগল পেরিয়ে মুক্তির দ্বিতীয় দিনেই স্বপ্নময় সেই ‘অগ্নি’ দেখেছিলাম ( সে গল্প না হয় তোলাই রইল!)  আর সে অভিজ্ঞতা নিয়েই  ব্লগে প্রথম মুভি রিভিউ লিখি। কোরিয়ান মুভি তো  অর্ধশতাধিক দেখা হল- সবই যে ভালো লেগেছে তা নয়, কিন্তু দৃপ্ত নায়িকার পাশে নিবেদিত নায়ক,  দু’জন দুজনার সহযাত্রী, আবেগে ভর করে চলা জীবন-  সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নিল  রূপকথা মনে হয় ( এইসব ছাইপাশ মেলোড্রামার ভক্ত হয়ে তাদের বিখ্যাত থ্রিলারও দেখা হল কম!)  বেশ কিছু  জাপানিজ মুভিও দেখা হল, আর সেই প্রিয় sassy নায়িকার সব মুভি দেখা হল [মাঝেমধ্যে এমন সুপার-একটিভ নায়িকাদের মত আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার উদ্ভট চিন্তাও মনে ভিড় করে!]  , সাথে কিছু মুভি রিভিউ লেখার প্রয়াসও চলল।    

 

আচ্ছা, মুভি দেখা কি আসলেই ভূত ?  না কি একটা পোকা ?  

কেবলই টাইম পাসের মাধ্যম?  

মাথা থেকে একে ঝাঁটা মেরে বিদায় করে দিলেই কি যাবতীয় মুশকিল আসান?

থাকুক না মাথায় কিছু মুভি-পোকা (বা ভূত), চলুক কল্পরাজ্যের আঙিনাতেও কিঞ্চিৎ  বিচরণ! 🙂     

 

মূলত একবিংশ শতাব্দীর আগমনভাগে এসেই নব্য চেতনার জানান দেয়া কোরিয়ান মুভির আজ  বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি – হলিউডেও রিমেইক হয়, আর নিজের কথা বলতে- ‘ পোকামাকড় খায় আর আমার মত নাক বোঁচা’ এক সময় কোরিয়ানদের নিয়ে এর বেশি কিছু তো ধারণাতেই ছিল না!তার মানে  চলচ্চিত্র সত্যিই বিশ্বমঞ্চে  কোন জাতির  প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনেও তো অন্ধকার যুগ পার করে সুদিন আসি-আসি করছে, সব শ্রেণির মানুষ হলমুখী হচ্ছে- এমন কথা অনেক দিন থেকে শুনছি। তাহলে  “অনুকরণ নয়, আপন স্বকীয়তায়  বিশ্বমঞ্চে ভাস্বর হোক বাংলাদেশি চলচ্চিত্র” এমন শুভকামনা তো করতেই পারি। 🙂    

       ‘ লেখাপড়া করে যে-  

        মুভি দেখতে পারে সে,

       মুভি দেখা বেশ ভালো,

      পারলে সিনেমা হলে চল!’      

 

–      রিফাত কবীর স্বর্ণা

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চলচ্চিত্র-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।