আশ্চর্য প্রদীপ [সরব “মুভি থেকে নেয়া”- ২২]

বছর কয়েক আগে ঈদের সময়ে একটা নাটক দেখেছিলাম।

যতদূর মনে পড়ে, নাটকটার কাহিনী ছিল অনেকটা এইরকমঃ আজিজুল হাকিম কোন এক অফিসে ছোট চাকরি করে। স্ত্রী বিজরি বরকতুল্লাহ আর এক ছেলেকে নিয়ে তার পরিবার। সংসারে দারিদ্র্য থাকলেও সুখ ছিল পুরোমাত্রায়। এমন অবস্থায় আজিজুল হাকিম একদিন রাস্তায় একটা প্রদীপ কুড়িয়ে পান। প্রদীপটা ছিল আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। প্রদীপ থেকে বের হয় এক আধুনিক জ্বিন। এরপরে আজিজুল হাকিমের সংসারে প্রাচুর্য আসে ঠিকই, কিন্তু সুখ দূর হয় চিরতরে।

সত্যিকথা বলতে নাটকটা দেখে আমি খুবই বিস্মিত এবং অভিভূত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের নাটক এতো এগিয়ে গেছে! বাংলাদেশের পরিচালকরা এখন এইরকম কনসেপ্ট নিয়ে নাটক বানাচ্ছেন?

গত সপ্তাহে “আশ্চর্য প্রদীপ” নামে একটা ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখলাম। ভারতীয় বাংলা সিনেমা শুনেই নাক সিঁটকাবেন না যেন। টালিউডে প্রচুর ভালো সিনেমা নির্মিত হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। সিনেমাটা দেখার পরে বুঝতে পারলাম “আশ্চর্য প্রদীপ” এবং কয়েক বছর আগে যে নাটকটা দেখেছিলাম দুটোই জনপ্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “ আশ্চর্য প্রদীপ ” নামের গল্প থেকে নির্মিত হয়েছিল।

যাক সে কথা। “আশ্চর্য প্রদীপ” সিনেমায় ফিরে আসি। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্পের কথা সবারই মনে আছে আশা করি। প্রদীপ ঠিকই আছে কিন্তু পাল্টে গেছে সময়। এই একবিংশ শতাব্দীতে সবাই যখন যে যার মত ব্যস্ত, তখন আশ্চর্য প্রদীপের কথা কে ভাবতে যাবে। অনিলাভ গুপ্তও ভাবেননি। অনিলাভ গুপ্ত এক কোম্পানির  সেলসম্যান। স্ত্রী ঝুমুর গুপ্ত ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। মধ্যবিত্ত পরিবারের চিরকালীন যে সমস্যা, সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় না হওয়া তা তাদের পরিবারে চরমভাবে বিদ্যমান। এমন অবস্থায় অনিলাভ গুপ্ত অফিস থেকে ফেরার পথে একটি প্রদীপ কুড়িয়ে পান। প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসে দৈত্য, যে কিনা তার প্রভুর যে কোন জাগতিক ইচ্ছেপূরণ করতে সক্ষম। তারপর? তারপরের উত্তরের জন্য আপনাদের সিনেমাটি দেখতে হবে।

কাস্টিং-এর ব্যাপারে যদি বলি, কাস্টিং এর চেয়ে ভালো হতে পারতো না। আপনাদের কি “কাহানি” মুভির বব বিশ্বাসকে মনে আছে? ওই যে একজন মাঝবয়সী কন্ট্রাক্ট কিলার। বব বিশ্বাসের চরিত্রে অভিনয় করা সেই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ই এখানে অনিলাভ গুপ্ত। কন্ট্রাক্ট কিলারের চরিত্র থেকে একজন নিরীহ সেলসম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করতে যে পরিমাণ অভিনয়ের দক্ষতা দরকার শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় তার চাইতে বেশিই দেখিয়েছেন বলে আমি মনে করি। সত্যি কথা বলতে টালিউডে এই মুহূর্তে যে কজন ভালো অভিনেতা আছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। আর দৈত্যের চরিত্রে রজতাভ দত্ত রনি’কে কি বলবো? এক কথায় অসাধারণ। টাক মাথার স্যুট পরা এক দৈত্য, ঠোঁটে তার অদ্ভুত এক হাসি আর মিহি ফ্যাঁসফেসে গলায় “আমি আপনার আজ্ঞাবহ দাস। বলুন আপনার কি চাই?” এই জিনিস রজতাভ দত্ত ছাড়া সম্ভব ছিল না। রজতাভ দত্তের ব্যাপারে একটা কথায় বলতে হয়, তার মত স্বতঃস্ফূর্ত অভিনেতা খুব কমই আছে। মুভির একটা বড় অংশজুড়ে ছিলেন এঁরা দুজন। মাঝে একটা সময় আমার মনে হচ্ছিল এরা বোধহয় পাল্লা দিয়ে অভিনয় করছেন। ঝুমুর গুপ্তের চরিত্রে ছিলেন শ্রীলেখা মিত্র।এক মুখরা, লোভী মহিলার চরিত্রের জন্য পারফেক্ট চয়েস। অন্যান্য চরিত্রে যারা ছিলেন তাঁদের অভিনয়ের সুযোগ তেমন ছিল না, তবুও সেটুকুর মধ্যেই তাঁরা যা করেছেন, বেশ ভালো।

পরিচালক অনিক দত্তের এটা মাত্র দ্বিতীয় মুভি। প্রথম মুভি ছিল “ভূতের ভবিষ্যৎ।” ভূতের সিনেমা যে শুধু ভয়ের না হয়ে কমেডি জনরা’রও হতে পারে তা এই মুভি দেখলে ভালো মত বোঝা যায়। মাত্র দুটি মুভিতেই তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি থাকতেই এসেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হল যে কোন বিষয়কে তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। তিনি নতুন এক ট্রেন্ড চালু করেছেন, ছন্দে ছন্দে কথা বলা। যেমন আশ্চর্য প্রদীপ মুভিতে দৈত্য, অনিলাভ গুপ্তকে বলে,

“টোকিও,দুবাই
নিউইয়র্ক,সাংহাই
খুলবেন দপ্তর
যেখানেই চাই।”

পরিচালক অনিক দত্ত যে শুধুমাত্র মজা করার ছলে গল্প বলেন তাই নয়, বরং এর মাঝে তিনি দেখিয়ে দেন  কঠিন কোন সত্যও। এখানেই অনিক দত্তের সার্থকতা। প্রত্যেক সিনেমাতেই পরিচালক একটা গূঢ় মেসেজ দিতে চান। কিন্তু হাস্যরসের মাধ্যমে কঠিন সত্য উপস্থাপন করাটা যেকোনো পরিচালকের জন্যই অত্যন্ত শক্ত কাজ। বলতেই হচ্ছে অনিক দত্ত তাতে পুরোপুরি সফল।

কিন্তু আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো?মুভির একটা সময়ে দৈত্যরূপী রজতাভ দত্ত অনিলাভ গুপ্তকে বলে, “রূপকথার গল্পে সবটা লেখা থাকে না, স্যার।”

আসলেই তো। রূপকথা’র গল্পে কি সবটা লেখা থাকে? রূপকথার গল্পের শেষে “অতঃপর তাঁহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো”, বাস্তবে কটা গল্পে এরকম দেখা যায়?

শেষ করা যাক, এই মুভিরই আইটেম গানের একটা অংশ দিয়ে। যেটা আমাদের জীবনেরই এক প্রতিচ্ছবি।

“আরও আরও আরও চাই,
আরও আরও আরও চাই
আরও ভালভাবে চাই বাঁচতে।”

—–ইমতিয়াজ আজাদ

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চলচ্চিত্র, বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to আশ্চর্য প্রদীপ [সরব “মুভি থেকে নেয়া”- ২২]

  1. Nafeez বলেছেনঃ

    শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এর সেই টাইপ ফ্যান আমি……..এই লোকটা অভিনয়ের জগতে আসলেই একজন জিনিয়াস…….পরিচালক অনিক দত্তের কাজগুলো হয় বেশ ইন্টারেস্টিং………হাস্যরসের মাঝে সিরিয়াস বিষয় তুলে আনেন…….ভূতের ভবিষ্যতের পর পরিচালকের আশ্চর্য প্রদীপ মুভিটাও বেশ লেগেছে………দারুণ রিভিউ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।