১৯৯৮-৯৯ সালের দিকের কথা । একদিন বাসায় কিছু লোকজন এসে তার কতগুলো নিয়ে কি সব কাজকর্ম শুরু করে দিল । ইয়া মোটা কালো কালো তার কতগুলো । আমি তখন থ্রী কি ফোরে পড়ি, আর আপু মনে হয় এইট-নাইনে পড়ে । আমরা দুই ভাইবোন মহা আগ্রহ নিয়ে কাজকর্ম দেখতে লাগলাম । কিছুক্ষণ পর কাজ শেষ করে তারা চলে গেলে আব্বু ঘোষণা দিলেন যে আমাদের বাসায় ডিশলাইন নামক প্রযুক্তি এসেছে । আমরা ভাইবোন আবিস্কার করলাম যে এখন টিভিতে অনেকগুলো চ্যানেল । কোনটায় কার্টুন চলে, কোনটায় খবর দেখায়, কোনটায় গান-নাচ । আমাদের আনন্দ দেখে কে । বিল্ডিং এ তখন খালি আমাদেরই ডিশ লাইন ছিল । আব্বু ব্যাপারটা নিয়ে বেশ খুশি ছিলেন । আমিও অনেক খুশি, প্রথমত কার্টুন দেখার জন্য এখন সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয় না , আর বাকি বন্ধুদের বাবারা তাদের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে ডিশ নেয় না, আর আমি পড়াশোনা শেষ করে ডিশের লাইনে কার্টুন দেখি ।
ডিশওয়ালাদের একটা চ্যানেল ছিল । ওই চ্যানেলে ভিসিডিতে গান, নাটক , সিনেমা এসব দেখানো হত । এক বিকেলে ওই চ্যানেলে দেখলাম একটা ইংরেজী সিনেমা দেখাচ্ছে । পুরোপুরি ইংরেজী, বাংলায় কথা না । আমরা ভাইবোন আর আব্বু মিলে সিনেমাটা দেখতে লাগলাম, বিশাল এক জাহাজ বরফে বাড়ি খেয়ে উল্টে যাচ্ছে, মানুষরা জীবন বাঁচাতে চিৎকার করছে, নায়িকার চোখে পানি । তখন রোমান্স বুঝতাম না, জাহাজ উল্টে ডুবে যাচ্ছে এটাই আমার কাছে ইন্টারেস্টিং ঘটনা । সেই টাইটানিকই ছিল আমার দেখা প্রথম হলিউডি সিনেমা । ভিসিডি সেই চ্যানেলে অবশ্য সিনেমার সব দৃশ্য দেখায়নি । আরও একটু বড় হয়ে কাটছাট ছাড়া টাইটানিক দেখেছিলাম । তখন বুঝেছিলাম যে প্রেমের সিনেমার কেমন হতে পারে । সেই ভিসিডি চ্যানেলেই দেখেছিলাম স্পিলবার্গের JAWS । কি অসাধারণ একটা সিনেমা । সেই থেকে হলিউডি সিনেমা দেখার শুরু । এমনিতে সিনেমা দেখা বলতে বুঝতাম শুক্রবার বিকালে বিটিভিতে দেখা সিনেমা । ডিশ বাসায় আসার পরও অনেকদিন শুক্রবার আসলেই সবাই বসে যেতাম টিভির সামনে । ওমরসানী, সালমান শাহ, মৌসুমি, ববিতা, রাজ্জাক, শাবান, আলমগীর কেউ বাদ ছিল না । সিনেমার গানগুলো গুনগুন করে গাওয়া হতো । মাঝখানে একসময় শুক্রবার বিকেলের পরিবর্তে শনিবার রাতে সিনেমা দেখানো হতো । তখন দিনের বেলায় ঘুমিয়ে আর পড়াশোনা শেষ করে রাখতাম, যাতে রাতে সিনেমা দেখা যায় । বাংলা সিনেমা দেখার সেই দিনগুলি আজও বেশ মনে পড়ে । ওমর সানীর ডায়লগ এখনও আমার মনে আছে, বেশী হিট করা সিনেমাগুলোর কাহিনীও মনে আছে । মাঝে মধ্যে বিশেষ দিনগুলিতে ভাল ভাল সিনেমা দেখাতো, যেমন “জীবন থেকে নেয়া” , “আগুনের পরশমণি” , “সারেং বউ”, “ছুটির ঘন্টা” , “তিতাস একটি নদীর নাম” আরও কত কি । সেই ছেলেবেলায় দীপু নাম্বার টু দেখে কতরাতে যে স্বপ্ন দেখেছি যে পাহাড়ের কোন গুহায় বন্ধুরা মিলে গর্ত খুড়ে বের করছি কালো পাথরের মূর্তি ।
লেখা শুরু করেছিলাম হলিউডি সিনেমার কথা দিয়ে । সেই টাইটানিক কিংবা জ’স দেখার পর স্টার মুভিজ আর ভিসিডি চ্যানেলে দেখেছিলাম আরও কত সিনেমা, প্রিডেটর, হোম অ্যালোন এইসব । কার্টুন নেটওয়ার্ক চ্যানেলে সপ্তাহে একদিন কার্টুন মুভিগুলা দেখাতো, Land Before Time, Batman, Tom and Jerry Movie আরও কত কি । আরও একটু বড় হবার পর সিনেমা দেখার জন্য চ্যানেলের উপরই সবসময় নির্ভর করতাম না, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে সিডি কিনে কোন বন্ধুর বাসায় সবাই মিলে দেখতাম সিনেমা । স্পাইডারম্যান, জেমসবন্ড কিংবা একটু বড়দের সিনেমাগুলো বেশীরভাগই এভাবে দেখা । হ্যারিপটার তো আমি বড় হওয়ার সাথে সাথেই বড় হয়ে উঠল । এমা ওয়াটসনকে এখনও ছেলেবেলার বান্ধবী মনে হয় ।
হিন্দী ভাষাটা অত বুঝি না, হিন্দী সিনেমা দেখা হতো আপুর সাথে সিনেমা দেখতে বসে । ওইসব সিনেমার ব্যাপক মাল-মসলা । প্রেম, বদরাগী ভিলেন, গান, অ্যাকশন কি নেই তাতে? হিন্দী সিনেমা কমই দেখেছি । এখনও আমি অন্যদের চেয়ে এই দিকে অনেক পিছিয়ে । সবাই যখন একটা হিন্দী সিনেমা দেখে, আলোচনা-সমালোচনা করে বাসি করে ফেলছে, তখন আমি সেটা দেখতে বসি ।
হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা হয় কলেজে উঠে । মুসলিম হলে বন্ধুরা মিলে দেখতে যাই ওয়েলকাম নামক হিন্দী সিনেমা । কমেডি ধাঁচের সিনেমাটা সবাই মিলে দেখতে খারাপ লাগে নি । এরপর দেখেছিলাম থার্ডপারসন সিঙ্গুলার নাম্বার । এই সিনেমা সত্যিকার হলে দেখা হয়েছিল । সিনেমা হলের পরিবেশটাও সেবার প্রথম দেখার সুযোগ হয় । সিনেমার চলার সময় মানুষ বেশ আগ্রহ নিয়ে সিনেমা দেখে, নায়ক-নায়িকার কেমেস্ট্রিওয়ালা জায়গায় দর্শক চিৎকার দিয়ে ওঠে, জোকসের জায়গায় প্রাণখুলে হাসে, তবে দুঃখের দৃশ্যে কাঁদতে দেখিনি কাউকে । সিনেমা চলার সময় কেউ কেউ হঠাৎ করে আশেপাশের অন্ধকার জায়গায় টর্চের আলো ফেলতে দেখেছি, দর্শকসারিতেও নাকি অনেক সিনেমা চলে মাঝেমধ্যে তাই নাকি এই আলো-আধাঁরির খেলা । সিলেটে বেড়াতে গিয়ে সিনেমা হলে দেখতে গিয়েছিলাম “Heart Breaking Blow” নামক সিনেমা । সেদিনই সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল । পুরো পাঁচতলা সিনেমা হল হাউসফুল । আমরা উঠানামা করার সিড়িতে বসেছিলাম সবাই । সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা । অনন্ত জলিলের ডায়লগ শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ, বর্ষাকে দেখে মানুষের শিসে কান পাতা দায়, গানের সাথে সাথে নির্জন দ্বীপ থেকে পাতা ঢাকা শহরে চলে আসার দৃশ্য দেখে চোখের পানি আটকে রাখা যায় না । সেই সিনেমার কাহিনী, অভিনয় কিছুই ভাল না । কিন্তু সিনেমা দেখার পরিবেশটা ছিল চমৎকার । সেই কারণেই হয়তো আজও এটা আমার সিনেমা দেখার অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা । পরে আরও সিনেমা দেখেছি হলে গিয়ে । খুব মনে পড়ে গেরিলা দেখার ঘটনা । আমাদের সামনের সারিতেই ছিলেন এক ভদ্রমহিলা । নিয়ে এসেছিলেন তার ছোট্ট ছেলেকে । ছেলেটি প্রায়ই প্রশ্ন করছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী কি, রাজাকার কি, সিনেমায় এখন কি হচ্ছে এইসব । ওই মহিলা খুব আগ্রহ নিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন । একটু বিরক্ত হচ্ছিলেন না । আমার খুব ভাল লেগেছিল ব্যাপারটা । সিনেমা হল নিয়ে আক্ষেপও রয়েছে । প্রথম হতাশা, চট্টগ্রামে ভাল কোন সিনেমা হল নেই আর পরের হতাশা এখনও শাকিব খানের সিনেমা হলে গিয়ে দেখা হয় নি ।
আমার ছোটখাট সিনেমাখোর হয়ে ওঠা ভার্সিটি লাইফের শুরুতে । বন্ধু, ক্লাসমেট, রুমমেট সবার কল্যানে অসাধারণ সব সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছে । বুঝতে শিখেছি অভিনয়, ক্যামেরার কাজ, কাহিনী, ডিরেকশান এইসব ফ্যাক্টরগুলি । সুন্দরী নায়িকাদের প্রেমে পড়েছি । অনেক অনেক সিনেমা দেখা হয়েছে, আরও অনেক সিনেমা দেখা বাকি । মাঝখানে সিরিয়াল দেখতে গিয়ে সিনেমা দেখা কমে গেলেও বন্ধ হয়নি কখনোও ।
অনেকেই বলে জীবনটা অনেক কঠিন, সিনেমার কাহিনী এখানে মানায় না । সাই-ফাই সিনেমা গুলো বাদে আমার তো অত আলাদা মনে হয় না । আমাদের সবার জীবনই তো একেকটা সিনেমা । কোনটার ডিরেকশান ভাল, কোনটার খারাপ এই যা ।
– নাহিদ