চাক দে ইন্ডিয়া- খেলার চেয়েও বেশি কিছু [সরব “মুভি থেকে নেয়া”- ২৬]

ভারত-পকিস্তানের হকির ফাইনাল ম্যাচ। স্টেডিয়ামে টানটান উত্তেজনা। দর্শকেরা অধীর হয়ে জয়ের অপেক্ষায় আছে। পাকিস্তান ১-০ গোলে এগিয়ে আছে, খেলা শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই, তাহলে কি ভারত হেরে যাবে? ক্যাপ্টেন কবির খান সহ বাকিরা জানপ্রান দিয়ে খেটে যাচ্ছেন একটি গোলের জন্য, অথচ লাভ হচ্ছে না। এমন সময়ই বিধি বাম! ভারত একটি পেনাল্টি করার সুযোগ পায়, এই একটি সুযোগের খুব দরকার ছিল । কিন্তু সুযোগের সঠিক ব্যাবহার করবেন কে? এই ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন কবির খান নিজে, তিনি নিজেই স্ট্রোক করার দায়িত্ব নিলেন, সবাই আশান্বিত হল , দলের বাকি সব প্লেয়ার, কোচ এমনকি দর্শকেরাও। কিন্তু না, শেষরক্ষা আর হল না। গোল মিস করলেন কবির খান, সবার স্বপ্ন এক মুহূর্তে ভেঙ্গে গেল। ম্যাচ শেষে নিয়মমাফিক খেলোয়াড়েরা একে অপরের সাথে হাত মেলালেন। পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন এর সাথে হাত মেলালেন ভারতের ক্যাপ্টেন কবির খান। এই হাত মেলানোর একটি ছবি প্রকাশিত হল গণমাধ্যমে। অন্য কেও হাত মেলালে সমস্যা হত না, কিন্তু যার নামের শেষে “খান” পদবী আছে, তার হাত মেলানোতে ক্ষেপে উঠল পুরো দেশ! নিশ্চয় কবির খান টাকা খেয়ে ইচ্ছে করে ম্যাচ হেরেছেন, নাহলে এটা তো জেতা ম্যাচ ছিল! এই অপবাদ বিশ্বাস করতেও কারো তেমন বাঁধল না, কারণ একটাই, নামের শেষের “খান” পদবী, কবির খান মুসলমান। তার যেই দেশে জন্ম সেই জন্মপরিচয়ের চেয়ে তার ধর্মের পরিচয় হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেল- তার এত বছরের ক্যাপ্টেনসি, এত বছরের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাধনা কেও মনে রাখল না। বাধ্য হয়ে নিজের মাকে নিয়ে নিজের বাড়ি ত্যাগ করলেন কবির খান। বাড়ি ত্যাগ করার মুহূর্তে দেখলেন মহল্লার একজন তার বাড়ির দেয়ালে “বিশ্বাসঘাতক” কথাটি লিখে দিয়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না কবিরের, এতদিনের পরিশ্রমের আর ভালোবাসার ফল এই? কষ্টের জন্যই সম্ভবত মাকে বললেন “আপনি না দেখতে চাইলে না দেখবেন, কিন্তু আমাকে সব দেখতে হবে, সব!”

 

৭ বছর পড়ের ঘটনা, কবির খানের ভাষায় বলতে গেলে “৭ বছর তিন মাস ১৪ দিন” পড়ের ঘটনা। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল উইমেন হকি টীম এর জন্য একজন কোচ দরকার, কিন্তু কাওকে পাওয়া যাচ্ছে না, কেও রাজি না, ভাবটা এমন “মেয়েদের আবার কীসের হকি?!” স্পন্সর ও পাওয়া যাচ্ছে না, “মেয়েদের” খেলা বলে কথা! এই সময় এগিয়ে এলেন সেই কবির খান। মনে তার প্রত্যয় একটাই, এই টিমকে ওয়ার্ল্ড কাপ জেতাবেন তিনি, তার সাথে হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার করবেন। কিন্তু যেই মেয়েদেরকে সিলেক্ট করা হয়, তারা আগে থেকেই একজন আরেকজনের সাথে বিভিন্ন ছোটোখাটো ইস্যুতে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে, খেলা তো পড়ের কথা! নিজের ইগো রক্ষায় তারা এতটাই ব্যস্ত যে দেশের জন্য যে খেলতে হবে, বিজয়কে ছিনিয়ে আনতে হবে, সেটা তারা ভুলতে বসেছে। কবির খানকি পারবে তাঁদেরকে “দেশ” মনে করিয়ে দিতে? তিনি কি পারবেন বিজয়ের সাথে তার হারানো সম্মান ছিনিয়ে আনতে?

 

এই হল চাক দে ইন্ডিয়া সিনেমার কাহিনী। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার পরিচালক হলেন শিমিত আমিন, কাহিনী লিখেছেন জয়দীপ সাহানি। কবির খান চরিত্রে প্রথমে সালমান খানকে অফার করা হলেও তিনি এই চরিত্র পড়ে আর করেননি। পরিচালক এর পড়ে শাহরুখ কাহ্নের কাছে যান, নিরাশ করেননি তাকে কিং খান। প্রায় ১১ জন নতুন অভিনেত্রীর সাথে শাহরুখ খান সম্ভবত নিজের জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয়টি করেন। নিজের প্রচলিত রোম্যান্টিক ইমেজ থেকে একেবারে বাইরে এসে একদম আলাদা ধরনের কিছু করে তিনি দর্শক থেকে সমালোচক সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। শিমিত আমিনের দারুণ ডিরেকশন, দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সবার অভিনয়ের জোরেই এটি সে বছরের প্রায় সবকটি পুরস্কার জিতে নেয়।

চাক দে ইন্ডিয়াকে বেশিরভাগ মানুষ শুধু স্পোর্টস সিনেমা বলে পাড় পেতে চায়। কিন্তু আসলেই কি এটা শুধু খেলার সিনেমা? সম্ভবত না। এই সিনেমা নারীর ক্ষমতায়ন এর উপর প্রত্যক্ষভাবে জোর দেয়। সমাজে নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করে- নারী হয়ে ঘর সংসার ছেড়ে খেলতে আসলে নারীকে কতটুকু ঝামেলা পেড়িয়ে আসতে হয়, তা আমরা ক্যাপ্টেন “বিদ্যা” এর ক্যারেক্টারটা দেখলে বুঝতে পাই।

প্রীতি নামের আরেকটা ক্যারেক্টার আছে, যার সাথে ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টীমের একজন প্লেয়ারের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা। কিন্তু এই ক্রিকেটারের কাছে হকি “ডাংগুলি” খেলার চাইতে বেশি কিছু না। প্রীতি যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি তো তোমার ক্যারিয়ার এর কথা চিন্তা করো, তাহলে আমার ক্যারিয়ার এর কি হবে? হবু স্বামী জবাব দেয়, “কোন ক্যারিয়ার? It’s a stupid game!” হকি ভারতের জাতীয় খেলা হওয়া সত্ত্বেও কিছু মানুষ এখনও হকিকে কোন দৃষ্টিতে দেখে তা বেশ ভালভাবেই বোঝা যায়।

শুধু তাই না, মানুষ হিসেবে যে আমরা কতটা ধর্মান্ধ এখনও, সেটাও এই সিনেমা দেখায়। শুধুমাত্র ধর্ম এক হওয়ার কারণে একজন নিরপরাধ খেলোয়াড়ের জীবনের সমস্ত কৃতিত্বকে ভুলে গিয়ে আমরা তাকে “বিশ্বাসঘাতক” এর তকমা দিতে এতটুকুও দেরি করি না। সাথে এটা বলতেও আমাদের বিবেক কাঁপে না- “এই ধরনের মানুষদের পার্টিশনের এর সময়ই ( দেশ বিভাগ) দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত ছিল!”

 

এই যে এত ছোট ছোট থিম একটি সিনেমাতে পরিচালক প্রবেশ করিয়েছেন, তাতে কিন্তু চাক দে ইন্ডিয়া কে তিনি ভজঘট অয়াকিয়ে ফেলেননি। অব থিমের দারুণ মিক্সিং এর পড়ে একটি থিমই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে, তা হল “দেশপ্রেম”। শাহরুখ খান চিৎকার করে বলেন, “এই টীমের জন্য আমার সেই ধরনের প্লেয়ার আগে চাই যারা সবার আগে ইন্ডিয়ার জন্য খেলবে!” সিনেমার শেষে ইন্ডিয়া টীমের জয়ের পড়ে জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে শাহরুখ এর কান্নার দৃশ্য যে কাওকে আবেগপ্রবণ করে তোমার জন্য যথেষ্ট, সেই দৃশ্য ভোলার নয়।

 

চাক দে ইন্ডিয়া অসাধারণ এক সিনেমা, এই সিনেমা দেশপ্রেমের সিনেমা, নারীর জয়ের সিনেমা, হারানো সম্মান ফিরে পাবার সিনেমা। শুধু খেলা নয়, এই সিনেমা খেলার সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু।

নাম- সৈয়দ নাজমুস সাকিব

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চলচ্চিত্র, বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।