বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর আগমন হয়েছিল খুব রাজসিকভাবে। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।
তিনি আর কেউ নন, তাঁর নাম সালমান শাহ। ৮৫-৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় “কথার কথা” নামে একটা অনুষ্ঠানে মিউজিক ভিডিওর মডেল হিসেবে মিডিয়াতে সালমান শাহ’র যাত্রা শুরু। যে মিউজিক ভিডিওতে সালমান শাহ মডেল হয়েছিলেন ঐ মিউজিক ভিডিও’র গানের শিল্পী ছিলেন হানিফ সংকেত স্বয়ং। এছাড়া কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেন তিনি। সালমান শাহ’র অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল বিটিভি’তে প্রচারিত “পাথর সময়” নাটকের মাধ্যমে। যদিও তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন না।
১৯৯৩ সালে আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড হিন্দি ছবি “কেয়ামত সে কেয়ামত তক”-এর স্বত্ব কিনে নিয়ে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে দিয়ে নির্মাণ করালো “কেয়ামত থেকে কেয়ামত।” রোমান্টিক জুটি হিসেবে শাবনাজ-নাইমের তখন ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু দুজনের কেউই সোহানুর রহমান সোহানকে সময় দিতে পারলেন না। ভাগ্যিস, দেন নি। দিলে সালমান শাহ নামের বাংলা চলচ্চিত্রের এই সুদর্শন নায়ককে আমরা কোথায় পেতাম? বর্তমানকালের সুঅভিনেত্রী মৌসুমী তখন জনপ্রিয় মডেল। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান নায়িকা হিসেবে বেছে নিলেন মৌসুমীকে। নায়িকা পাওয়া গেলেও নায়ক সমস্যা’র কোন সমাধান হচ্ছিল না। এমন সময়ই সোহানুর রহমান সোহানের সাথে পরিচয় হল এক তরুণের। তরুণের নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। পরিচয়ের কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন এই তরুণই হবে তাঁর সিনেমার নায়ক। এই ইমনই পরবর্তীকালের সালমান শাহ। কোন জনপ্রিয় নায়ক বা নায়িকা নয়, একদম আনকোরা দুজনকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আধুনিক রোমিও-জুলিয়েটের গল্পে সিনেমাটা নির্মাণ করার মধ্যে ঝুঁকি ছিল ১৬ আনা। সালমান শাহ- মৌসুমী জুটি বাজিমাত করলেন প্রথম মুভিতেই। কেয়ামত থেকে কেয়ামত হয়ে গেলো বাংলা সিনেমার ইতিহাসেই অন্যতম সুপারহিট ছবি।
এর পরে সালমান শাহ বা মৌসুমী কাউকেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” সুপার হিট হওয়ার পরে এই জুটিকে নিয়ে যে আকাশসম প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ হয়েছিলো সামান্যই। সালমানের আর মাত্র ৩টি ছবিতে নায়িকা হিসেবে ছিলেন মৌসুমী। স্নেহ, অন্তরে অন্তরে আর দেনমোহর। মৌসুমী জুটি গড়ে তোলেন সমসাময়িক আরেক নায়ক ওমর সানি’র সাথে। আর অন্যদিকে সালমান জুটি গড়েন নায়িকা শাবনূরের সাথে। ৪ বছরের অভিনয় জীবনে সালমান শাহ যে ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তার ১৪টিতেই নায়িকা ছিলেন শাবনূর। শাবনূরের সাথে তাঁর রসায়ন এতই জনপ্রিয় ছিল যে বাস্তব জীবনেও তাঁরা জুটি এইরকম একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথমেই বলেছিলাম সালমানের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিলো নাটকের মধ্য দিয়ে। “নয়ন” নামের একটি নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। নাটকে, টেবিলের উপরে হাত প্রসারিত করে আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে ছুরি দিয়ে গাঁথার একটা দৃশ্য ছিল। শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র সালমান শাহ’র কারণে এই দৃশ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় কিশোর-তরুণদের ক্রেজ হয়ে গিয়েছিলো টেবিলের উপরে হাত প্রসারিত করে আঙ্গুলের ফাঁকে ছুরি গাঁথা। এতোটাই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। এমনকি তিনি যেদিন মারা যান, শোনা যায় সারা বাংলাদেশে ২১ জন মেয়ে এই খবর শুনে আত্মহত্যা করে। বিশ্বাস করতে পারেন? ২১ জন!
সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি তাঁকে খুন করা হয়েছিলো টা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। মৃত্যুর এতদিন পরেও তাঁর অধিকাংশ ভক্ত মনে করেন তিনি খুন হয়েছিলেন। এ ধারণার পিছনে কারণও আছে যথেষ্ট। এমনিতেই সালমান শাহ’র সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সামিরা’র সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। তার উপরে এক অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীর সাথে সালমানের বিরোধ ছিল প্রকাশ্য। মৃত্যুর পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছিলো সালমান আত্মহত্যা করেছেন। এই রিপোর্ট সালমানের পরিবার তো বটেই, ভক্তরাও কখনো মেনে নেয় নি।
কিন্তু তাতে কি কিছু আসে যায়? সালমান আত্মহত্যা করুন অথবা তাঁকে খুন করা হোক, তিনি কি আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন? মাত্র ৪ বছরের ক্যারিয়ারেই তিনি যে ঝড় তুলেছিলেন বাংলাদেশের সিনেমায় সে ঝড় থেমে গেছে অনেক আগেই। এখন সিনেমার বাজেট অনেক বেশি কিন্তু মান বাড়ার বদলে কমেছে অনেক। সালমান শাহ থাকলে বাংলা সিনেমা কোথায় যেতো কে জানে। অনেক কিছু হতে পারতো। কিন্তু হয়নি কিছুই। সালমান শাহ’র ভক্তদের এই আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবনই ।
আগামী ৬ই সেপ্টেম্বর সালমান শাহ্’র ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৮টা ব-ছ-র কেটে গেলো। কিন্তু আরেকজন সালমান শাহ আর আসলেন না।
—— ইমতিয়াজ আজাদ