সিনেমার মেকিং,ক্যামেরার কারিকুরি আর স্পেশাল ইফেক্টের বিষয়তো কিছুই বুঝিনা, তাই যে সিনেমায় ভালো একটা গল্প পাই সেইটাই নিজের কাছে অসাধারণ মনে হয়। আর গল্পের দিক দিয়া ইরানি সিনেমাকেই এখন পর্যন্ত আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে; নাকসিটকায়েন না মহাশয়! আগে সিনেমাগুলো দেখুন, তারপর না হয় সিটকাইলেন! সামান্য একজোড়াজুতাকে কেন্দ্র করে যে সিনেমা হতে পারে এইটাইতো চরম বিস্ময়ের ব্যাপার! অথচ ইরানি সিনেমায় তা হচ্ছে হরহামেশাই, এই রকম সাদামাটা বিষয় নিয়েই এখানে তৈরি হয় সিনেমার অসাধারণ আখ্যান।
মূলত বিশ্বময় আজ ইরানি সিনেমার যে উৎকর্ষতা এর পেছনে রয়েছেন আন্তর্জাতিক মানের কিছু সিনেমা ব্যক্তিত্ব।আব্বাস কিয়ারোস্তামি যে শুরুটা করেছিলেন মহসিন মাখমল্বাফ, জাফর পানাহি, আসগরফারহাদি, মাজিদ মাজিদি তাকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়।যাইহোক, মুগ্ধতার ব্যাপারখানা যখন চলেই আসলো তখন বলে ফেলায় বোধহয় উত্তম নতুন করে কি দেখে আবার এইমুগ্ধতা!
মাজিদ মাজিদির ‘দ্য চিল্ড্রেন অব হ্যাভেন’, ‘কালার অব প্যারাডাইস’, ‘দ্য সং অব স্প্যারোস’ এবং ‘বারান’ ইত্যাদি সিনেমা দেখে আগেই বহুবার মুগ্ধ হয়েছি(কেউ আবার মনে কইরেন না যে আমি মুগ্ধতা রোগে আক্রান্ত একব্যাধীগ্রস্থ মানুষ!, আপনি দেখুন; দেখবেন আপনার মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ আমার চেয়ে কোন অংশে কমতো হবেই না বরং বেশি-ই হবে বলেআশা রাখি!!);।
ইরানিয়ান প্রথম সারির পরিচালক মাজিদ মাজিদির চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘ফাদার’ সিনেমাটির জন্মসাল ১৯৯৬। সিনেমাটির নাম ‘ফাদার’ হলেও এর কেন্দ্রিয় চরিত্র কিন্তু ১৪ বছরের এক পিতৃহীন অনাথ অথচ দুর্দান্ত সাহসী এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এক ইরানের সাধারণ পরিবারের সন্তান মেহেরুল্লাহ। যে অকালে তার বাবাকে হারিয়ে মা ও ছোট বোনদেরভরণ পোষণের জন্য গ্রাম ছেড়ে ইরানের দক্ষিণ শহরের এক দোকান কর্মচারী হিসেবে চাকরী নেয়।
সিনেমার শুরুতেই দেখি সে কিছু টাকা জমিয়ে তার মা বোনকে দেখতে যাবে বলে কেনাকাটা করছে; এক পর্যায়ে সে তার নিজ গ্রামে পা রাখে। উবু হয়ে ঝর্ণার পানি পানকরার সময় তার বুক পকেটে রাখা তার বাবার এক মাত্র ছবিটি ভেসে যায়; পানিতে ভেসে যাওয়াছবিটির পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে মেহেরুল্লাহ। আমার মনে হয় ছোট্ট এই কাহিনীটি মূলত পরবর্তী অবস্থার ইংঙ্গিত মাত্র, নাও হতে পারে। কেননা, আমি এই জন্যই বললাম ছোট্ট এই ঘটনার পর শহর থেকে আসা মেহেরুল্লাহর প্রথমসাক্ষাৎ হয় বন্ধু লতিফের সাথে; তার কাছে মেহেরুল্লাহ শুনতে পায় যে তার মা এক পুলিশ অফিসারকে বিয়ে করে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। স্তম্ভিত মেহেরুল্লাহ বন্ধু লতিফকে আঘাত করে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটে। ফাঁকা বাড়ি পড়ে আছে, কেউ নেই; পারিবারিক স্মৃতি জেগে ওঠে তার। প্রচণ্ড নাখোশ হয় মেহেরুল্লাহ, সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। তার কাছে মনে হয় পুলিশ অফিসার কৌশলে সুখের কথা বলে এবং অর্থের লোভ দেখিয়ে তার মাকে বশ করেছে। ভেতরে ভেতরে তার মা’র প্রতিও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মেহেরুল্লাহ, তার বোধ হয় আর্থিক স্বচ্ছলতা আর সুখে দিনগুজরান করার জন্যই তার মাতার মৃত বাবার সংসার ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। সে এর সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য পরদিন পুলিশঅফিসারের বাড়িতে যায় , সাথে নিয়ে যায় শহর থেকে মা বোনের জন্য কিনে আনা জামাকাপড়ের পুটলি। চোখের সামনে পুলিশ অফিসারের সংসারে তার মা’কে দেখে আরো কষ্ট পায় সে,স্থির থাকতে পারে না। ছেলেকে দেখে মায়ের মাতৃত্ববোধ জেগে উঠে, তাকে কাছে আসতে বলে।কিন্তু মেহরুল্লাহ তার মা’র কাছে যায় না, বরং সাথে নিয়ে আসা জামা কাপড়ের পুটলিছুড়ে মারে। পুলিশের সংসার ছেড়ে তার সাথে চলে যেতে মা’কে বলে, যে টোমেনের (টাকা)জন্য সে চলে এসেছে সেই টোমেনও ছুড়ে মারে। বোনদেরকে সে সাথে নিয়ে যেতে চায়; পুলিশ অফিসারের সাথে তর্কে জড়িয়ে পরে। যে অর্থের লোভ দেখিয়ে তার মা’কে বিয়ে করেছে সেই অর্থেরবিনিময়ে হলেও সে তার মা বোনকে ফেরত চায়; পুলিশ অফিসারের দিকেও সে টোমেন ছুড়ে মারে।সে টোমান ছুড়েই ক্রোধেদৌরে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, ফিরেও তাকায় না। বন্ধু লতিফ ছুড়ে দেয়া সেই টোমানগুলিনিয়ে আসে;তারপর দেখা যায় মেহেরুল্লাহ আর লতিফ দুই বন্ধু মিলে তাদের বাড়ি সংস্কার করছে।এর মধ্যে হঠাৎ একদিন পুলিশ অফিসারের বাড়ি থেকে মেহেরুল্লাহর বোনদের খুঁজে পাওয়া যায় না, মেহেরুল্লাহর মা অস্থির হয়ে পড়ে। পুলিশ অফিসারের দ্বিতীয় সংসার হলেও সেপ্রত্যেককে নিজের আপন সন্তানের চেয়ে বেশি ভালবাসে। সেও খুঁজতে থাকে তাদেরকে;কিন্তু সে বুঝতে পারে এটা মেহেরুল্লাহ ছাড়া কেউ করেনি। তাই কোথাও কালক্ষেপণ না করে সোজা চলে যায় মেহেরুল্লাহর বাড়ি। পুলিশ অফিসারের আগমনের কথা বন্ধু লতিফের মাধ্যমে মেহেরুল্লাহ আগেই জানতে পেরে বোনদের লুকিয়ে রাখার জন্য মাটি গর্তকরা বাঙ্কার মতন একটিজায়গায় তাদের লুকিয়ে রাখে;কিন্তু বন্ধু লতিফ পুলিশ অফিসারের ধমকে সেই জায়গার কথা বলে দেয়। পুলিশ অফিসার মেহেরুল্লাহকে শ্বাসিয়ে যায়; ফলে সে আরো রাগান্বিত হয়ে উঠে। এক বৃষ্টির রাতে মেহেরুল্লাহ পুলিশ অফিসারের জানালার গ্লাস ঢিল ছুড়ে ভেঙ্গে ফেলে; সকালে অফিসারঘুম থেকে উঠে দেখে তার ফুলের বাগান তছনছ করে রেখেগেছে। এইবার সত্যি সত্যি অফিসারও ক্ষেপে উঠে, প্রবল ক্রোধে সে মেহেরুল্লাহকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু তাকে কোথাওখুঁজে পাওয়া যায় না। বন্ধু লতিফ জ্বরাগ্রস্থ কম্পমান মেহেরুল্লাহকে আবিষ্কার করে পুরাতন এক পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদের উপর; তৎক্ষণাৎ সে মেহেরুল্লাহর মা’কে খবর দেয়। পুলিশ অফিসার ক্রোধ ভুলে পরম মমতায় অসুস্থ মেহেরুল্লাহকে নিজের ছেলের মনে করে তার নিজের বাড়ি নিয়ে আসে। অসুস্থ ছেলে যাতে সুস্থ হয়েই তাকে দেখে আতঙ্কগ্রস্থ না হয়ে পরে সেই জন্য স্ত্রীর কাছে কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে হবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। মূলত সে তার নিজ কর্মক্ষেত্রেই থাকে। অন্যদিকে মা ছেলেকে যত্ন আত্তি করে সুস্থ করে তোলে। মা ছেলের সম্পর্ক আগের মতো ঋদ্ধতায় রূপ নিলো।
মা-বোনের সাহচর্যে মনে হয়েছিল মেহেরুল্লাহ সব ভুলে গেছে; কিন্তু পুনরায় পুলিশ অফিসার এসে উপস্থিত হলে মেহেরুল্লাহ প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভোগে, রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে অফিসারের রাখা কোমরবন্ধনী থেকে রিভলবার খুলে নিয়ে গুলি করতে চায়; কিন্তু ঘটনাচক্রে তা সম্ভব না হলে রাতের অন্ধকারে রিভালবার নিয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায় মেহেরুল্লাহ আর বন্ধু লতিফকে সাথে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে গ্রাম ছাড়ে মেহেরুল্লাহ। বন্ধু লতিফেরও শহরে গিয়ে প্রচুর টাকা ইনকাম করার ইচ্ছে বহুদিনের, এ গ্রামে হাড়খাটুনি কাজ করতে তার একটুও মন চায় না। মেহেরুল্লাহ আগের দোকানেই ফিরে যায়, মূলত এবারের যোগদান দোকান থেকে টোমান(টাকা) নিয়ে ভেগে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রিভালবারটি খুব সাবধানে সাথেই রাখে সে। অন্যদিকে পুলিশ অফিসার পাগলের মতো খুঁজতে থাকে মেহেরুল্লাহকে, থানা থেকে ছুটি নিয়ে সে তার মোটর বাইক নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে পথ চলে; ঘটনাচক্রে সমুদ্র পাড়ে লতিফকে ধরে ফেলে পুলিশ অফিসার। তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে মেহেরুল্লাহকে ধরতে গিয়ে সংঘটিতহয় ব্যাপক নাটকীয়তার। শেষ পর্যন্ত লতিফকে গ্রামের বাসে তুলে দিয়ে ছেলে মেহেরুল্লাহকে নিজের মোটরবাইকের সাথে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে গ্রামের পথে চলতে থাকে পুলিশ অফিসার। একপর্যায়ে হ্যান্ডকাফ খুলে দিলে মোটর বাইক নিয়ে ভেগে যেতে চায় মেহেরুল্লাহ;কিন্তু এইবার পুলিশ অফিসারকে ফাঁকি দিতে পারে না। পুনরায় ধৃত হয় সে।মরুভূমির মাঝখান দিয়ে চলেছে রাস্তা,আর সেই পথের সওয়ারি পিতাপুত্র চলছে মোটরবাইকে। হঠাৎ থেমে যায় তাদের দুই চাকার এই যানটি। ভড়কে যায় পুলিশ অফিসার। এই বিশালবিস্তৃত মরুপ্রান্তর দিয়ে নেই কোনো প্রাণের চলাচল।
যেহেতু এখন হন্টন পদ্ধতি ছাড়া কোনো উপায় নেই, তাই কিনারহীন মরুভূমির মাঝবরাবর হাঁটা শুরুর আগে পরস্পরকে হ্যান্ডকাফে আটকে এবং সাথে খুব সামান্যই জল ছিলো তা নিয়ে নেন। জনমানবহীন বালুকাময় মরুপ্রান্তর দিয়ে একজোড়া প্রাণ হেঁটে যাচ্ছে প্রায় অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে এলোমেলো দমকাহাওয়ায় তাদের আরো প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবেলা করতে হয়,ঘন তুষারপাতের মতো বালুর উড়াউড়িতে প্রায় অন্ধকার দেখায় সবকিছু। যে জল তারা সাথে নিয়ে এসেছিলো তাও শেষ। এমন অবস্থায় তাদের দুজনই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে উঠে, হাঁপিয়ে ওঠে তারা। মেহেরুল্লাহ টেনেহিঁচড়ে পথ চলতে পারলেও পুলিশ অফিসার একেবারে নেতিয়ে পড়ে। তার দ্বারা সামনে পথ চলা আর সম্ভব হয়ে উঠেনা। মরুভূমিতে প্রতিকূল এই পরিবেশে পিতা পুত্রের নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম সিনেমাটিতে অন্যমাত্রা এনে দেয়। জীবনের প্রতি আশা হারিয়ে পুলিশ অফিসার একপর্যায়েহ্যান্ডকাফ খুলে মেহেরুল্লাহকে মুক্ত করে দেয়, এবং চলে যেতে বলে; তার দ্বারা আরসামনে চলা অসম্ভব। যে মেহেরুল্লাহ একটু আগেও চিন্তা করেছে কিভাবে এই পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়, আর সে-ই এখন মুক্ত হয়েও নির্বাক হয়ে বসে আছে পুলিশ অফিসারের পাশে! কিছুক্ষণ কাঁধে করে, তারপর টেনেহিঁচড়ে নতুন বাবাকে সামনে নিয়ে যেতে থাকে সে।হঠাৎ দূরে উটের বিচরণ দেখতে পেয়ে সেখানে দৌড়ে যায়, এবং ছোট্ট একটি জলাশয়ের খুঁজপায় সে; নতুন বাবাকে বহু কষ্টে জলাশয়ের কাছে টেনে এনে জল সিটিয়ে দেয়। কিন্তু বাবার হুঁশ নেই, নিরাশ হয়ে জলে উবু হয়ে পড়ে মেহেরুল্লাহ; আমরা যারা ভাবতে বসেছিলাম যে পুলিশ অফিসার বেঁচে নেই; অথচ তখন স্বচ্ছ জলাশয়ে তাকে আমরা দেখি তার জীবনকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে। সিনেমার শেষের দিকে মাজিদ মাজিদির প্রায় সব সিনেমায় এই পোয়েটিক ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়। সিনেমার শেষতক দৃশ্যে দেখা যায় পুলিশ অফিসারের পকেটে থাকা একটি ছবি জলে ভাসতে ভাসতে মেহেরুল্লাহর মুখের সামনে এসে ধাক্কা লাগে; যেভাবে গ্রামেপ্রবেশের সময় মেহেরুল্লাহর পকেট থেকে ঝর্ণায় ভেসে তার মৃত বাবার ছবিটি হারিয়ে গিয়েছিল।মেহেরুল্লাহ ছবিটি হাতে নেয়; পরখ করে দেখে সে ছবিটি। পুলিশ অফিসারের কোলে তার বোন,পাশে দাঁড়ানো হাস্যোজ্বল মা। মূলত নতুনভাবে পরিবারসমেত নতুন বাবাকে খুঁজে পাওয়ার ইঙ্গিতদিয়েই শেষ হয় সিনেমা ফাদার।
ইরানের গ্রাম্য পটভূমিতে সিনেমাটির বিচরণ ও বিস্তার থাকলেও এর কাহিনী আর থিম একেআন্তর্জাতিকতায় সিক্ত করেছে; এছাড়াও অস্তিত্বের টানাপড়েন, নানামুখী সঙ্কট, জীবনসংগ্রাম আর নিটোল সমাজবাস্তবতা ইরানের প্রায় সব সিনেমায় উপস্থিত থাকে বলেই তা হয়ে উঠে সার্বজনীন।