পাঠ অভিজ্ঞতাঃ অ্যালেক্স হ্যালির ‘রুটস'[অনুবাদঃশিকড়ের সন্ধানে-গীতি সেন}

অ্যালেক্স হ্যালির ‘রুটস’ কি ঠিক উপন্যাস নাকি এক বংশের লতিকাগাঁথা অথবা ক্রীতদাসদের ইতিহাস?বইয়ের বাংলা অনুবাদের ভূমিকায় অম্লান দত্ত যেমনটা লিখেছেনঃ “উপন্যাস বললে গ্রন্থটির প্রতি সুবিচার করা হয় না।পুরাণ যেমন একই সঙ্গে কাব্য এবং প্রাচীন ইতিহাস,আলোচ্য গ্রন্থটিও সেইরকম।এই যুগে মহাকাব্য লেখা সম্ভব কিনা সেটা বিতর্কিত প্রশ্ন,কিন্তু হেলির ‘রুটস’ বইটিতে পাওয়া যায় আধুনিক মহাকাব্যের স্বাদ”।‘শিকড়ের সন্ধানে’ এক স্বাধীনচেতা,ঐতিহ্যপ্রেমী ক্রীতদাস কৃষ্ণাঙ্গের মর্মন্তুদ কাহিনী।দাস ব্যবসার নিষ্ঠুর চিত্র আর শ্বেতাঙ্গ মালিকদের নির্মম আচরণের এক জীবন্ত বর্ণনা।’শিকড়ের সন্ধানে’ বইটা আসলে শুধুই শিকড় খোঁজার গল্প নয়।সেই সাথে প্রতিরোধ,পূর্বপুরুষের প্রতি ভালোবাসা আর ক্রীতদাস প্রথার নির্মমতারও গল্প।উপনিবেশকতার শিকার কোন এক সুদূর আফ্রিকান কুন্তা কিন্তে হয়ে উঠেন একান্ত আপন একজন।অসহায় ক্রীতদাস আর তাদের পরিণতি পড়লে মনটাই খারাপ হয়ে যায়।না জানি এই উন্নত সভ্য দেশগুলোর চোখ ধাঁধাঁনো ঐশ্বর্যের নিচে কত পরিবার হারানো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের রক্ত,ঘাম আর আর্তনাদ লুকিয়ে আছে।

অ্যালেক্স হ্যালি তাঁর বইয়ের শুরুতেই আমাদের নিয়ে যান পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়া উপকূলের ছোট্ট গ্রাম জুফ্রেতে।যেখানে অমেরো ও বিন্টা কিন্টে দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নিচ্ছে পুত্রসন্তান।এই নবাগত শিশুর নাম রাখা হয় তার পূর্বপুরুষ কুন্টা কিন্টের নামানুসারে।কুন্টা বড় হতে থাকে।শিখতে থাকে প্রকৃতি আর নিজেদের মান্ডিকা উপজাতির কাছ থেকে।অদ্ভুত সেই সমাজ।এই উপজাতি একই সাথে ইসলাম ধর্ম ও আফ্রিকার লৌকিক আচারপ্রথা পালন করে।আফ্রিকা মানেই আমাদের কাছে যেন একদল অর্ধনগ্ন ক্যানিবাল বিচিত্র সব পালক পড়ে আর রঙ মেখে আগুনের পাশে নৃত্য করছে।কিন্তু আসলেই কি তাই?কুন্তা বড় হতে থাকে।সেখানকার সামাজিক নানা আচার আর পারিপার্শ্বিকতার সাথে পরিচিত হতে থাকি আমরা।কুন্তারা আমাদের মত স্কুল-কলেজে ফিজিক্স-কেমেস্ট্রি-বায়লজি পড়ে না ঠিক,তবে নিজেদের গোত্রীয় পাঠশালায় শিখে কিভাবে আফ্রিকার মাটিতে বেঁচে থাকতে হয়।কিভাবে পরিবার আর সমাজের দায়িত্ব নিতে হয়।আরও শিখে ইসলাম ও কোরআন। বাবা-মা আর ছোট ভাইদেরকে নিয়ে ভালোই দিন যাচ্ছিল কুন্তার।কিন্তু একদিন ঢাকের কাঠ খুঁজতে গিয়ে ধরা পড়ে ‘সভ্যজগতের’ ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের হাতে।প্রতিরোধের সব চেষ্টা চললেও নির্মমতার সবটা দেখিয়ে জাহাজে করে কুন্তার যাত্রা শুরু হয় ‘সভ্য’ পৃথিবীর পথে।এমন অমানবিক ভাবে হয়ত পশুও পরিবহন করা হয় না।ওয়েস্টার্ন বইগুলোতে আমরা যেমনটা পড়ে থাকি,তেমনি ক্রীতদাসদের পিঠেও লাল গনগনে লোহা দিয়ে ব্র্যান্ডিং করা হত।ডেকের দুঃসহ নরকতুল্য পরিবেশে যোগাড় করা ক্রীতদাসদের অনেকেই সেই জাহাজেই প্রাণ হারান।তারপর মহান আমেরিকার মাটিতে নেমে মালিকের কাছে বিক্রি হওয়া।সেথায় নিজের পৈতৃক নাম রাখবারও আর সুযোগ মিলে না।কুন্তার নাম হয়ে যায় মালিকের রাখা নাম ‘টবি’।সাথে ক্রীতদাসের মালিকের নামের পদবিও যুক্ত হয়।

কিন্তু মুক্ত বাতাস আর পশ্চিম আফ্রিকার এক স্নেহময় গ্রামীণ সমাজ ও নৈসর্গিক পরিপার্শে যার বেড়ে উঠা,সে কেন অন্যের দাস হয়ে থাকবে?পালাবার চেষ্টা করতে কুন্তা।যতদিন শক্তি ছিল পালাবার অবিরত চেষ্টা করে কুন্তা।প্রতিবারই ধরা পড়ে আর সহ্য করে অমানুষিক নির্যাতন।অবশেষে মালিকের কুঠারের আঘাতে পায়ের পাতার অর্ধেকটা হারিয়ে ‘মুক্তি’ চিরতরে হারায় কুন্তা।

অঙ্গহানি হলেও প্রতিরোধ শেষ হয় না কুন্তার।নিজের মেয়ে কিসিকে শুনায় আফ্রিকার নিজের গ্রামের গল্প।তার হারিয়ে আসা কৈশোর আর বাবা-মা,ভাইবোনদের গল্প।আশপাশের সবকিছুর নাম শিখায় নিজেদের উপজাতির ভাষায়।সব বাধা আর বিপত্তি এড়িয়ে মেয়েকে বড় করতে চায় এক ঐতিহ্য সচেতন নারীতে।কিন্তু কুন্তার যে ভাগ্য খারাপ!প্রেমিকের জন্য জাল মুক্তিপত্র লিখে দিয়ে অন্য আবাদে বিক্রি হয়ে যায় কিসি।এখানে বলে রাখা ভাল যে নিগ্রো ক্রীতদাসদের পড়ালেখা শেখা নিষিদ্ধ ছিল।সেইবারই নিজের কন্যার সাথে শেষ দেখা কুন্তার।আমরাও বইয়ের পাতায় হারিয়ে ফেলি কুন্তাকে।এর পরের আখ্যান কেবলি কিসির আর তার উত্তরসূরিদের।

নতুন আবাদের মালিকের কাছে প্রথম রাতেই ধর্ষণের শিকার হয় কিসি।সেই রাতেই কিসির গর্ভে আসে জর্জ।নিজের ঔরসজাত সন্তান হলেও জর্জও আসলে মালিকের ক্রীতদাস।ক্রীতদাসদের বাজারে কেবল অক্ষম আর বৃদ্ধ ছাড়া সব ধরনের ক্রিতদাসেরই কোন না কোন ভাবে বাজারমূল্য আছে।পিতামাতা হারানোর পরে মালিকের ধর্ষণ কিসির নিজের ভিতরে আগুন জ্বালায়।কিসি নিজের সন্তানকে শিখাতে থাকেন বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো।একসময় জর্জও বড় হয়।বংশবিস্তার করে।এর মধ্য দিয়ে নবজাতককে শিখানো হতে থাকে পূর্বপুরুষের ইতিহাস বর্ণনা।এভাবে এক সময় আমেরিকান সিভিল ওয়ার আর আব্রাহাম লিঙ্কনের বদৌলতে সত্যি সত্যি মুক্তি আসে ক্রীতদাসদের।দাস থেকে নাগরিক হয়ে উঠে চিরতরে নিজের পূর্বপুরুষদের সাথে যোগাযোগ হারানো আফ্রিকানরা।কুন্তার বংশধরদের সপ্তম পুরুষই হচ্ছেন অ্যালেক্স হেলি,যিনি কিনা জন্মই নিয়েছিলেন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে!

‘শিকড়ের সন্ধানে’ ঠিক রিভিউ লেখবার মত বই না।রিভিউ লেখা মানে নিছক শব্দের অপচয়।এটা পড়বার বই।অনুভবের-উপলব্ধির বই।বিজাতীয় আগ্রাসনের মুখে শত প্রতিকূলতার মাঝেও কিভাবে নিজের ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়,তা শিখবার বিষয়।একটা ইতিহাস কিভাবে তৈরি হয়,সেটা এই বই পড়লে যেন নিজ চোখেই দেখা যায়। একটা ব্যাপার না লিখলে বইয়ের ব্যাপারে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।অ্যালেক্স হ্যালি কিভাবে লিখলেন এই বই?অ্যালেক্স হেলি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড বাহিনীতে।জাহাজে অঢেল অবসর সময়ে নিছক লেখালেখি করতে করতে এক সময়ে চাকরি ছেড়ে পেশাদার সাংবাদিক হয়ে উঠেন অ্যালেক্স।দুঃসাহসিক উত্তেজনাপূর্ণ জীবন কাটানো লোকদের নিয়ে লিখতে শুরু করেন রিডার্স ডাইজেস্টে।নিজের দাদির মুখে শোনা পূর্বপুরুষদের বিচিত্র সব শব্দ আর নীলনদের মুখে পাওয়া এক পাথর অ্যালেক্সকে নিজের আফ্রিকান পূর্বপুরুষকে জানতে আরও আগ্রহী করে তুলে।ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে মিলে আরও অনেক তথ্য।এক সময় অনেকখানি পারিবারিক ইতিহাস যোগাড় করে ফেলেন অ্যালেক্স।কিন্তু চূড়ান্ত খোঁজখবর পেতে যেতে হবে আফ্রিকাতে। নিজের হাতে তেমন কোন টাকা পয়সা নেই। অবশেষে এক ভক্ত পাঠক মিসেস ডিউইট ওয়ালেস এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে রাজি কোরআন রিডার্স ডাইজেস্টকে।পত্রিকা কর্তৃপক্ষ রাজি হয় এই অভিযানের খরচ বহনের।নিজের পূর্বপুরুষদের কাছে ফিরবার আর সেখানে পাওয়া অভ্যর্থনার গল্প আরেক আবেগঘন চোখে পানি এনে দেওয়া বর্ণনা।

অ্যালেক্স এই বইয়ের কাহিনী লেখবার আগে দ্বিতীয়বার আফ্রিকাতে গিয়েছিলেন।সেখান থেকে জাহাজে করে আমেরিকা পৌঁছেন।এই আফ্রিকা থেকে ইউএসএ যেতে চড়ে বসেন এক মালবাহী জাহাজে।উদ্দেশ্য আর কিছু নয়।প্রতি সন্ধ্যার খাবারের পরে জাহাজের অতি গভীর,ঠান্ডা ,অন্ধকার খোলের ভিতরে ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন করে সেখানকার কর্কশ,নিরাবরণ কাঠের উপর শুয়ে অনুভবের চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমেরিকায় আনা হয়েছিল পিতা কুন্তা কিন্তেকে।

এই বইয়ের কিছু নাটকীয় বর্ণনা ছাড়া পুরোটাই সত্য ঘটনা।অ্যালেক্স আমেরিকাবাসী ও আফ্রিকান আত্মীয়দের মুখে রক্ষিত কাহিনীর সাথে সাথে অনুসরণ করেছেন সরকারি দলিলপত্রে প্রাপ্ত তথ্য।ভ্রমণ করেছেন অন্তত পাঁচ লক্ষ মেইল।তিন মহাদেশের অন্তত পঞ্চাশটি লাইব্রেরি ও আর্কাইভস তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন।

গীতি সেন।অসাধারণ একজন অনুবাদক।এই ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বই পড়ার সময়ে একবারও মনে হয়নি যে কোন অনুবাদ পড়ছি।মনে হয়েছে অ্যালেক্স হ্যালি তাঁর ‘রুটস’ বইটি বাংলাতেই লিখেছেন।অনেকদিন মনে থাকবে বইটার কথা।সম্ভবত আমার পড়া সেরা বইগুলোর একটা।এটা এমনই এক বই যে আমি আসলে বইয়ের কিছুই তুলে ধরতে পারিনি।বরং কিছু জায়গায় হয়ত পিছলেও গেছি।কেবল পাঠকই বুঝবেন ক্রীতদাসদের সাথে কতটা বর্বর আর নির্লজ্জ আচরণ করা হত।সেই সাথে বুঝতে পারতেন বইটা আসলে কেমন।আর হ্যাঁ,এই বইয়ের উপর নির্ভর করে টিভি সিরিজও আছে।অ্যালেক্স হ্যালির নির্দেশনাতে জীবদ্দশাতেই এটি তৈরি ও প্রচারিত হয়েছিল। আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি,আরেক কৃষ্ণাঙ্গ কিংবদন্তী ম্যালকম এক্সের জীবনীর সহলেখক এই ভদ্রলোক।

আবদুল্লাহ সম্পর্কে

পড়তে বেশ পছন্দ করি।পছন্দের কিছু লেখকের লেখা পড়ে লিখতে চেষ্টা করি।লেখা শেষে দেখি সেগুলো আসলে শব্দের খিচুড়ির চাইতে বেশি কিছু না!তাই নিজের লেখা নিজেই পড়ি।বিশ্বাস করি Malcolm X এর সেই অমর বাণীতে "I'm for truth, no matter who tells it. I'm for justice, no matter who it's for or against." [www.rdbangla.blogspot.com]
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to পাঠ অভিজ্ঞতাঃ অ্যালেক্স হ্যালির ‘রুটস'[অনুবাদঃশিকড়ের সন্ধানে-গীতি সেন}

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    ভাল লাগল। রুটস পড়ার প্ল্যান ছিল। শেষ পর্যন্ত পড়া হয় নি 🙁
    লেখক এতটা কষ্ট করেছেন সেটাও জানতাম না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।