(পূর্বে প্রকাশের পর)
তখন আমাদের কলেজের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার আগের রাত। আমি আমার সকল মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছিলাম। এমন সময় পয়মন্তির মা আমদের বাসায় আসলেন। আমার আম্মুর কাছে এসে তার সে কি কান্না! পয়মন্তি আজ সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে আমার সাথে কোথায় জানি যাবে। কিন্তু এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। এখনও পয়মন্তি বাসায় ফেরেনি। এত কচি মেয়ে সবাইকে না জানিয়ে কোথায় যেতে পারে? আমার প্রথম সন্দেহ পড়ল অয়নের উপর। অয়নের বাসায় খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওর সাথে গত এক মাস পয়মন্তির কোন কথাই হয়নি। তাজ্জব ব্যাপার! কোথায় গেল পয়মন্তি? সেদিন প্রায় রাত ১১ টায় পয়মন্তি বাসায় আসল। আমরা চিন্তামুক্ত হলাম। কিন্তু আন্টি রেগে গিয়েও কিছু বললেন না। পরদিন পরীক্ষা শেষে ওদের বাসায় গেলাম। আন্টি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘পয়মন্তির কি কিছু হয়েছে? তোমাকে কি কিছু বলেছে? আমার সাথে তো কোন কথা বলে না। জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। আমারও তো বয়স হয়েছে। এত টেনশন হয়, কাউকে বলতে পারি না’। বলতে গিয়ে আন্টি কেঁদে ফেললেন। আমি শুধু উনাকে সান্ত্বনা দিলাম। আমি কিভাবে উনাকে বুঝাব যে, পয়মন্তির সাথে আমারও আর আগের মত বন্ধুত্ব নেই। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ‘এমন বন্ধু পেলে যে কারো জীবন সার্থক’, আর ভিতরে ঠিক ততটাই ফারাক, ততটাই নিষ্প্রাণ, নির্জীব।
এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটল একেবারে এইচ এস সি পরীক্ষার আগ দিয়ে। তখন মনে হয় পরীক্ষার ১৫ কি ২০ দিন বাকি। আমি তখন বাসার বাইরে একেবারেই বের হই না। পয়মন্তির সাথে বন্ধুত্ব আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে মাত্র। ও পড়াশুনার ব্যাপারেও আগের চেয়ে সিরিয়াস হয়েছে। এমন সময় একদিন বিকালে আন্টি আমদের বাসায় আসলেন। আন্টিকে বেশ অসুস্থ মনে হল। আন্টি বললেন, পয়মন্তি সকালে তাকে না জানিয়ে বেরিয়ে গেছে। অনেকবার ফোনে ট্রাই করেও পাচ্ছেন না। তাই আমাদের বাসায় এসেছেন আমার সাথে কথা বলতে। আমার ঘরে এসে চুপিচুপি আমাকে বললেন যে আগেও বেশ কয়েকবার পয়মন্তি বাসা থেকে এভাবে না জানিয়ে বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। এবার নাকি পয়মন্তির ঘরের অনেক জামাকাপড়, স্যান্ডেল এসব পাওয়া যাচ্ছে না। আন্টি সন্দেহ করছেন, পয়মন্তি এসব কিছু নিয়ে কোথাও গেছে, আর হয়তো ফিরেও আসবে না। আমার অবশ্য এরকম কিছু মনে হল না, যদিও জামাকাপড় নিয়ে যাওয়াটা আন্টির যুক্তির সাথেই যায়। তবু মন মানছে না। এই তো, তিন দিন আগেও কথা হল। রসায়নের কিছু চ্যাপ্টার নিয়ে ওর বুঝতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। কই ওর সাথে কথা বলে তো ওকে স্বাভাবিক লাগছিল। সেদিন রাতেও পয়মন্তি বাসায় ফিরল না। ওদিন কেন জানি অয়নের উপর সন্দেহের তীর পড়ল না। পরদিন অবশ্য জানতে পারলাম পয়মন্তি পালিয়ে অয়নকেই বিয়ে করেছে। তাই বলে পালিয়ে? আমাকে তো একবার বলতে পারত? অবশ্য দোষটা আমারই। আমিই কখনও ওকে জিজ্ঞেস করিনি অয়নের সাথে ওর কিসের সম্পর্ক বা আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কিনা। আন্টি সহজ-সরল মানুষ। পয়মন্তি তাকে এতটা আঘাত করল, তবুও তাদের বিয়ে মেনে নিলেন। কিন্তু আমি মানতে পারলাম না। এ কেমন বন্ধুত্ব? এ কেমন লুকোচুরি খেলা? আমি আজও মনে মনে পয়মন্তিকে ক্ষমা করতে পারিনি, যদিও মুখ ফুটে এ কথা ওকে কোনদিন বলতে পারিনি।
আমাদের পরীক্ষা শেষ হল। পয়মন্তির সাথে অনেকদিন দেখা হয়না। তাই দেখা করতে গেলাম। অয়নের পরিবার ওদের বিয়ে শেষমেশ মেনে নেয়নি। তাই ওরা খুব কষ্ট করে অন্য একটা বাসা ভাড়া করে থাকে। সেদিন ওর সাথে দেখা করতে গিয়ে মনে হল, ও আমার চেয়ে মানসিকভাবে অনেক পরিপক্ক। এই বয়সেই কিভাবে কষ্টের সংসারকে ধরে রাখছে, ভাবতেই অবাক লাগল। যাই হোক, সেদিন আমাদের কথার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন সাংসারিক আলোচনা। এরকম বিষয়ে কথা বলতে আমার যথেষ্ট বিরক্ত লাগছিল, কিন্তু পয়মন্তিকে দেখলাম একেবারে পাকা গিন্নির মত! মানুষ কত বদলে যায়! কত সহজে, কত দ্রুত!
আজকে প্রায় চার বছর পর পয়মন্তির সাথে দেখা। এ যেন অন্য এক পয়মন্তি! ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, হতাশ! এই চার বছর ওর উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে যা আমরা এই বয়সে কল্পনাও করতে পারি না। বিয়ের পর কেবল এইচ এস সি পরীক্ষাই দিয়েছে, এরপর আর পড়াশুনা করেনি। আর আমি হতে চলছি গ্র্যাজুয়েট। ওর সাথে এই চারটা বছর আমার দেখা না হওয়ার কারণ ছিল, ও আর অয়ন শহরের বাইরে অন্য এক জায়গায় গিয়েছিল। অয়নেরও আর পড়াশুনা করা হয়নি। সংসার সামলানোর জন্য ছোটখাটো একটা চাকরিকে জীবনের সম্বল হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ওদের একটা বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই বাচ্চাও মিসক্যরেজ হয়ে গেল। গেল বছর অয়ন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল। এত কিছু হয়ে গেল অথচ পয়মন্তি আমাকে কিছুই জানাল না! পয়মন্তির উপর আমার ভীষণ অভিমান হয়েছে আজকে। আজকে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। মনের যত ক্ষোভ সব ঝেরেছি আজকে। বলেছি, ‘তুই যতই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করিস না কেন, আমি তোর মত বন্ধু আর একটিও খুঁজে পাইনি। যাদের পেয়েছি সবাই দুধের মাছি। তুই আমার ছোটকালের বন্ধু। তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব কখনও মিথ্যে হতে পারে না। তোর জীবনে এতকিছু ঘটে গেল। আমাদের একবার জানাতে পারতি। আন্টি তোকে কত ভালবাসে জানিস? কখনও তো বুঝার চেষ্টাও করলি না…’। পয়মন্তি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলা শুরু করল, ‘কার কথা বলছিস তুই? কতটুকু চিনিস ঐ মহিলাকে? ও তো আমার মা না। আমি ঐ মহিলাকে কখনও মা ডাকি নাই, ডাকবও না। আমার জীবন শেষ হয়ে গেলেও আমি ওর কাছে যাব না।’ এই বলে পয়মন্তি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কেবল জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। আন্টির সাথে ওর কিসের এত অভিমান আমি আজ অব্দি বুঝতে পারি নাই। হতে পারে আন্টি পয়মন্তির আসল মা নয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে এত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমি খুব কম দেখেছি। আঙ্কেলের মৃত্যুর পর পয়মন্তির সব ছেলেমানুষি মাথা পেতে সহ্য করেছে আন্টি। আন্টির একটাই দোষ ছিল, উনি কখনও পয়মন্তিকে শাসন করেননি, কখনও মা হয়ে মেয়ের মনের কথা জানার চেষ্টা করেননি, কখনও জানতে পারেননি তার মেয়ের কোন অভিযোগ কিংবা আহ্লাদ আছে কিনা। নাহলে পয়মন্তির মত এত লক্ষ্মী-মন্থর একটা মেয়ের জীবন এতটা কষ্টের হতে পারে না। আর পয়মন্তিরও দোষ আছে। ও সবসময় আন্টিকে ভুল বুঝেছে। আর কিছু দোষ আমারও ছিল। আমি শুধু বন্ধু হয়েই ছিলাম। কিন্তু কখনও প্রকৃত বন্ধু হতে পারি নাই। কিন্তু সেই বয়সটা এমনই ছিল তখন ঠিক আর ভুলের মধ্যে ফারাক বুঝে ওঠাটা খুব মুশকিলের ছিল। কিন্তু আজ এত কথা কেন মাথায় আসছে? কেন আগেই এসব চিন্তা করলাম না? পয়মন্তির জন্য আমার বন্ধুহৃদয় আজ কেন হাহাকার করে উঠছে? তখনই কেন ওকে কিছু বললাম না? নাকি খুব স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম? নিজের জীবনের কথা চিন্তা করতে গিয়ে গত চারটা বছর এই বন্ধুটিকে ভুলেই গিয়েছিলাম। এ কেমন বন্ধু আমি?
শেষ বিকেলের আলোয় আমি আর পয়মন্তি অনেক প্রশ্ন, অনেক না বলা কথা বুকে জমিয়ে বসে আছি। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসল। বাড়ি ফিরতে মন চাচ্ছে না। বারবার মনে হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো ঘুরিয়ে দশ বছর পিছে চলে যেতে পারলে মন্দ হত না। যখন আমাদের মনটা চড়ুই পাখির ডানায় ভর করে উড়ে যেত, যখন আমরা হাসি-খেলা-গানে মেতে থাকতাম সারাটিক্ষণ, যখন পার্থিব কোন দুশ্চিন্তা বা যন্ত্রণা আমাদের পীড়া দিত না, অপ্রাপ্তির নিদারুণ জ্বালা আমাদের মনকে ক্ষয়প্রাপ্ত করত না। খুব ইচ্ছে করছে ঐ ছোটবেলার ভাবনাহীন দিনগুলোতে ফিরে যেতে। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি অসহায় আমরা! ভাগ্য যে নির্মম কলকাঠি নাড়ল আমাদের বন্ধুত্বকে ঘিরে তাতে নিজেকে বড় বেশি দুঃখী মনে হয়। আমার চেয়েও বড় দুঃখী পয়মন্তি। জীবনে যতবার সুখের সন্ধান করতে চেয়েছে, ততবারই দুঃখের ডামাডোল বেজে উঠেছে। এমনটা তো আমরা কেউ চাই নি। কিন্তু মেনে নেয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে? জীবনের কাছে আমরা যে পুতুলখেলা মাত্র। পয়মন্তি আর আমার বন্ধুত্ব কোন আহামরি শ্রেষ্ঠ কোন বন্ধুত্বের প্রমাণ নয়, বরং এটি আমাদের দুজনের ব্যর্থ বন্ধুত্বের করুণ পরিণতি। তবু আজ মনে হচ্ছে অতীতের সব ভুলগুলোকে শুধরে নিতে সমস্যা কোথায়? জীবনে তো আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। বন্ধুত্বে ভাঙ্গাগড়া, ভুল বুঝাবুঝি থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে তো আমার আর পয়মন্তির বন্ধুত্বের ইতি ঘটতে পারে না। আমি উঠে দাঁড়ালাম। পয়মন্তিকে বললাম, ‘চল, বাড়ি ফেরার সময় হল’। পয়মন্তি আমার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর অস্তমিত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই বাড়ি ফিরে যা। আমার আর বাড়ি ফেরা হবে না রে’।
অসাধারণ ! :huzur:
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ 🙂
গল্প কখন শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। অনেক মসৃণ লেখনী!
সামিরা আপু, আপনার কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ! দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-বিচ্ছেদ মূলত প্রাধান্য পেয়েছে লেখাটিতে। নিজের মত করেই লিখেছি। গল্পটির পরিধি কি আরেকটু বড় হলে ভাল লাগত? মতামত জানাবেন। 🙂