মনের ভাষা

মানুষ অসম্ভব স্মৃতিধর একটি প্রাণী।

মানুষ চাইলেই মোটামুটি তার ৩/৪ বছর বয়সের পর থেকে প্রায় অনেক কিছুই মনে করতে পারে। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে মাতৃগর্ভের অন্ধকার দিনগুলোর কথা মনে করতে, জন্মের ঠিক পরমুহুর্তের কথাগুলো মনে করতে! হয়ে ওঠে না। আমার মস্তিষ্ক সে সময়গুলোতে মনে রাখার ব্যাপারটা ঠিক ভালভাবে আয়ত্ত করে উঠতে পারে নি। সে তখন কেবল একটু একটু করে শিখতে শুরু করেছে, আশপাশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়াটা শিখে নেবার চেষ্টা করছে।

তবে এখন এই সময়ে এসে আমি একটা কথা বলতেই পারি, আমি চাইলে কোন কিছু মোটামুটি ভালভাবেই মনে রাখতে পারি। এই যেমন, এই মুহূর্তে হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ছে ক্লাস টু’তে পড়বার সময় মায়ের সাথে প্রথম বাঙলা ২য় পত্র বই হাতে নেবার কথা। মায়ের কাছে সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম ভাষার কথা, ব্যাকরণের কথা।

একটা সংজ্ঞা পড়েছিলাম,
“মানুষ তার মনে ভাব প্রকাশ করবার জন্যে ফুসফুস তাড়িত বাতাস ব্যবহার করে যে অর্থবোধক ধ্বনি উচ্চারণ করে, তাকে ভাষা বলে। মানুষ ভাষা প্রকাশের লেখ্য রূপও ব্যবহার করে।”

সে বয়সে এই সংজ্ঞার অর্থ বোঝা আমার কম্ম ছিল না। মা একটুখানি বোঝাবার চেষ্টা করতেই প্রশ্ন করেছিলাম, “আম্মু, ইশারা কী ভাষা হবে না?”

আমি ছেলেবেলা থেকেই কিছু কিছু ব্যাপারে একটু চাপা স্বভাবের। মাঝে মাঝেই মুখের ভাষায় সবকিছু বলতে আমার ইচ্ছে করে না। লিখতে ভাল লাগে, কিন্তু সবকিছুই লিখতে ইচ্ছে করে। অনেক সময়ই এতে করে আমায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অনেকেই আমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সবাই আমাকে বুঝবে, সেটা আশা করাটাও বোকামি। সবার সবাইকে বোঝা উচিত না।

আচ্ছা,
মুখের ভাষাতেই কি সব অনুভূতি প্রকাশ পায়? কিংবা কলমের কালিতে?
সব অনুভূতি কি এই দিয়েই প্রকাশ করা যায়?
তবে যে কবিগুরু মুখের ভাষাকে ‘পরাধীন জীর্ণ বাক্য’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন! কেন?

আমার কাছে মনে হয়, নীরবতার একটা ভাষা আছে। খুব অসাধারণ একটা ভাষা আছে।
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, ঘৃণা – মুখে না বললেও অনুভূতিগুলো নীরবতার ভাষায় প্রকাশ হয়েই যায়। নীরবতার সে ভাষা সবাই বুঝতে পারে না। নীরবতার সে ভাষা সবার জন্যে না।

মুখের ভাষা হয়ত ভাব প্রকাশের খুব শক্তিশালী একটি মাধ্যম। অনেকের মতে কলমের কালি হয়ত তার চাইতেও শক্তিশালী ভাব প্রকাশক। কিন্তু ও দিয়ে মনের অনেক কথাই প্রকাশ করা যায় না! মনের সব অনুভূতিকে মুখের ভাষায় বা কলমের কালিতে আঁচড়ে রূপ দেয়া যায় না! সব কথা বলে বা লিখে প্রকাশ করা যায় না!

দু’টি হাতের ইশারায় কত সহজেই হয়ত কত কথা বলে ফেলা যায়, যা হয়ত মুখের কথায় হাজার চেষ্টাতেও ঠিকভাবে প্রকাশ করা যেত না! সামান্য চোখের ভুরূর একটুখানি কাঁপনেও প্রকাশ পায় হাজার মনের ভাব! মুখমণ্ডলের মাংসপেশিগুলোর সামান্য একটু স্পন্দনও এমন অনেক কথা বলে দিতে পারে, যা হয়ত মুখের ভাষায় কিংবা কলমের কালিতে কোনদিনও বলা সম্ভব হত না! শরীরের একটা অঙ্গের একেক রকম পরিচলন একেক রকমের ভাষার বহিঃপ্রকাশ! এমনকি মৌনতাও হয়ে উঠতে পারে মনের ভাব প্রকাশের খুব শক্তিশালী একটা মাধ্যম!

কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম, মানুষ তার মনের ভাবের দশ ভাগও মুখের ভাষায় সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। আর মানুষ সবচাইতে ভালভাবে মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারে তার চোখের মাধ্যমে। কিন্তু চোখের সে ভাষা আবার সবার বোধগম্য হয়ে নাও উঠতে পারে। চোখের মাঝেই ফুটে ওঠে কত অনুভূতি, সত্য-মিথ্যার খেলা, গভীর ভাব! আর ভালোবাসার কথা জানাতে চোখের ভাষার তুলনা কোথায়!

মুখে হাজারটা কথা বলা যায়, কাগজের বুকে কলম দিয়ে অনেক কিছুই লেখা যায়, অক্ষর সাজিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া যায়, ফোনের মারফত ভয়েস মেসেজ পাঠানো যায় – কিন্তু ও দিয়ে চোখের ভাষা বোঝানো যায় না! ও দিয়ে ঠোঁটের কাঁপন বোঝা যায় না! হাতের ইশারার মর্ম বোঝা যায় না!

মনের ভাব প্রকাশ পায় ইশারায়, মনের ভাব প্রকাশ পায় তনুর কম্পনে, মনের ভাব প্রকাশ পায় মৌনতায়! ভাষা মানে কেবল মুখের কথা, কাগজের লেখায় সংকীর্ণ কোন কানাগলি না! ভাষা মানে মনের কথাগুলোকে মনের মত করে বোঝাতে পারা! হৃদয়ের ভাষা যেন সমুদ্রের চাইতেও বিশাল, আকাশের মত অসীম!

নীরব, সরব হাজার রঙের ভাষায় জীবনের স্বপ্ন দেখি আমরা… … …

অনুজ সম্পর্কে

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে গেলে হয়ত লিখতে হবে - প্রথমত আমি রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ, দ্বিতীয়ত চিরন্তন সত্য, মৃত্যুর সাথে করি বসবাস... https://www.facebook.com/CoercedAnuj
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

3 Responses to মনের ভাষা

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    চিন্তাগুলো বেশ ভাবালো!
    🙂

  2. পেন আর্নার বলেছেনঃ

    ছোট ছোট করে তোর মতোন এরকম লিখতে ইচ্ছা করে। ভালো লাগছে রে ভাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।