এই ঢাকা সেই ঢাকা…

ছোটবেলায় ছিমছাম একটা শহুরে জীবন ছিল আমাদের। সেই জীবনের গতি এখন কিভাবে এত ত্বরান্নিত হয়েছে ভাবতে অবাক লাগে। শহরে মানুষের চাপ এত বেশি ছিল না। আমাদের এলাকায় উঁচু দালান বলতে কেবল আমাদের এবং আশেপাশের আরো পাঁচ-ছয়টি দালান ছিল, বাকিগুলো ছিল কাঁচাপাকা ও অর্ধপাকা বাড়ি। আমরা ছিলাম দুই ভাই-বোন। যৌথপরিবারে বেড়ে উঠেছি। দুই চাচা, তাদের পরিবার ও দাদা-দাদী সবাই একসাথে একই ছাদের নিচে বাস করেছি। কচি কচি ভাইবোনেরা মিলে বিকালে ছাদে যেতাম, খেলতাম, বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে আসত। সকালের সূর্যোদয় আর সন্ধ্যার সূর্যাস্ত কত যে মনোহারিণী তা এখনকার নতুন প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারে কিনা জানিনা। রাতের বেলায় কখনো কখনো ছাদে যেতাম, আকাশের তারা গোনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাতাম। ঈদ এর চাঁদ দেখার জন্য সন্ধ্যাবেলায় ছাদে গিয়ে সবাই একসাথে হই-হুল্লোর শুরু করে দিতাম। বাবা’র হাত ধরে দুই ভাই-বোন একসাথে স্কুলে যেতাম। স্কুটার, রিক্সা, বাস এগুলোই ভরসা ছিল। সব মিলিয়ে হাসি-খেলা-গানে নির্ভেজাল একটা জীবন ছিল।

জীবন কিভাবে বদলে গেল সেটা বলি। যখন ক্লাস ৭/৮ এ পড়ি আশেপাশে বিভিন্ন বিল্ডার্স কোম্পানি এপার্টমেন্ট তৈরী করতে লাগলো। নির্মান যন্ত্রের শব্দ দুষণে কানে তালা লাগার উপক্রম হলো। ১০-১২ তলা সেসব দালানের মাঝে আমাদের দালান ঢাকা পড়ে গেল। একটির পিঠে যেন আরেকটি দালান হেলে পড়েছে! হরেক রকম মানুষের আগমন ঘটতে থাকে এলাকায়। ছাদে আর তেমন যেতে দেয়া হত না। প্রায় সময় ঘরের জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। সূর্যের মুখখানি দেখা দুরে থাক, সূর্যের আলো যে ঘরে পৌছে সেটিই যথেষ্ট। জীবনের যান্ত্রিকতা আর ব্যস্ততা বেড়ে গেল। বাসা থেকে রাজপথে পা রাখতেই যেন জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির কথা তো নতুন কিছু নয়। মানুষের আয়-রোজগার যে অনেকই বেড়েছে তা বুঝা যায় রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা দেখে। তবুও কত মানুষ বাসের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করে। ভাড়া নিয়ে চালকের সাথে কলহ তো দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ। যানবাহনের ভাড়া কিভাবে দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেল তা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন করে মনে শঙ্কা সৃষ্টি করে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরী পরিসংখ্যান : ফার্মগেট থেকে গ্রিনরোড/সাইন্স ল্যাবরেটরি স্কুটার/সি এন জি ভাড়া-
১৯৯৫: ১৫-২০ টাকা
২০০০: ৩০-৪০ টাকা
২০০৫: ৫০-৬০ টাকা
২০১২: ১২০-১৫০ টাকা

ঈদতো এই শনিবার। যানবাহনের ভাড়ার কথা বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে আসি। ঈদের নতুন জামা, গরু কেনা, গরুর সাথে ছবি তোলা, পাশের বাড়ির গরু দেখা- এসবই এখন অদ্ভুত মনে হয়। ঈদ নিয়ে তেমন কোনো আনন্দ-উত্তেজনা এখন আর অনুভব করি না। গরু কেনা হবে, মাংস বিলি করা হবে- তো কি হয়েছে? ঈদ চলে যাবে। ছুটি ফুরিয়ে আসবে। ক্লাসে ফিরে যেতে হবে। পরীক্ষার ক্ষণ ঘনিয়ে আসবে। কত-শত চিন্তা! তারপরও প্রতিটা মুহুর্তকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। এসবই তো জীবনের অংশ। এসব না থাকলে তো জীবনটাই পানসে হয়ে যেত। মাঝে মাঝে মনে হয়, ছোটবেলার সেই ভাবনাহীন, খেলাধুলাময়, ঝক্কি-ঝামেলাহীন জীবন কতই না ভালো ছিল! সেই দিনগুলো এখন স্মৃতির পাতায় ধুলো জমে থাকে। এক সময় বড়দের কথার পিঠে কথা বলতাম, “আমিও বড়।” এখন খুব বলতে ইচ্ছে করে, আমি তো বড় হয়ে যাইনি। আমিতো এখনো ছোট। মুরুব্বিদের আহলাদি কথা শুনতে মন আকুপাকু করে। কিন্তু এ কি পরিহাস! সবাই বলে, “বাচ্চাদের মত হেসেখেলে বেড়াচ্ছিস কেন? কাজকর্ম নেই নাকি?” কাজকর্মের মর্মার্থ ব্যাপক! সেটা হয়ত বলে বুঝাতে হবে না।

মনের দুশ্চিন্তা লাঘবের চেষ্টা কিন্তু কম করি না। সময় পেলেই ইট-কাঠের খাঁচা ছেড়ে বাইরে উড়াল দেই। আমরা ঢাকা শহরের বাসিন্দা। শপিং মল আর ফাস্ট ফুড- এই হলো আমাদের বিনোদন। ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। তা হয়ত বছরে একবার সুযোগ হয়, কখনো কখনো হয় না। এখন তো ইচ্ছে হলেই ছাদে গিয়ে দৌড়াতে পারব না, ছাদের পাশ ঘেষেই যে প্রতিবেশীর ঘর| বছর দেড়েক আগে তো আমার পিচ্চি কাজিন ক্রিকেট বল দিয়ে প্রতিবেশীর জানালা ভাঙ্গার অভিযোগে বেশ কানমলা আর গালিগপতা শুনেছিল। বেচারার খেলা সেই থেকে বন্ধ। আমরা এমনি অভাগা যে খেলার মাঠ পর্যন্ত নেই। স্কুলের মাঠে কতটুকু সময়ই বা খেলা যায়? এই নতুন প্রজন্মের দুর্ভাগ্য দেখে নিজেরই খারাপ লাগে। আমরা খেলার মাঠ পাইনি, ছাদ তো পেয়েছিলাম।

বিনোদনের প্রসঙ্গ পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে আসি। স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালতে প্রশান্ত মনে কাজ করার জন্য সুন্দর সকাল প্রয়োজন। কথায় আছে, “Morning shows the day”। ভাড়া, চালকের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, অনিশ্চিত ট্র্যাফিক জ্যাম– এসব মোকাবেলা করে অবশেষে গন্তব্যে পৌছানো। সারাদিন ছুটাছুটি আর ঘাম ঝরিয়ে আবারো সেই একই যুদ্ধ মোকাবেলা করে বাসায় আসা। এই তো আমাদের শহুরে জীবন।

তারপরও মানুষ ছুটে আসছে তাদের স্বপ্নের ঢাকা শহরে। পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার সেই গানটি যেন এখনো এই মানুষগুলোকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আনে তাদের স্বপ্নের শহরে-
“ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইল,
ওই লাল-নীল বাতি দেইখা আমার নয়ন জুড়াইল।”
তবে হ্যা, ওই সময়টাতে চেষ্টা করলে হয়ত আসলেই ঢাকাকে স্বপ্নের শহর বানানো সম্ভব হত। কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে, অপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করেছি, করছি এই শহরকে প্রতিনিয়ত। এরকম আতলামি চিন্তাভাবনা মাঝে মাঝে মনে উদয় হয়। একে ঠিক আতলামি বলা উচিত না। আমরা যারা ছোটবেলা থেকে এই শহরকে দেখে আসছি, যেই শহরের বাতাসের গন্ধ যতই বিষাক্ত হোক না কেন, যেই শহরের মাটি-পানি যতই দূষিত হোক না কেন, এই শহরেই আমাদের বেড়ে উঠা, এই শহরেই আমাদের বসবাস, এই শহরেই কোনো এক বাসায় আমরা আমাদের জীবনের স্বপ্ন গাঁথি। আমাদের জীবনটা কি বদলায়নি? বেশ বদলে গেছে। পৃথিবী এগিয়ে চলছে। পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরকেও এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান সবক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা। সম্পর্কের সঙজ্ঞাও বদলে গেছে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক যেন দাবাখেলার মত। সেই সম্পর্কের ভেতরে আছে শুধুই কৃত্তিমতা। নিষ্প্রাণ, ম্লান, একঘেয়ে জীবনের মধ্যে কোনো বিরতি নেই, আছে শুধু ক্লান্তি ও অবসাদ। হয়ত বয়স বেড়ে গেলে দায়িত্ব বেড়ে যায়, এ কারণে আমার কাছে এই ভিন্নতা ধরা পড়ছে। কিন্তু বাবা-মা প্রায়ই বলে, “তোদের জীবনটা আরো বেশি কষ্টের। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।”

প্রাণপ্রিয় এই ঢাকা শহরকে তাই মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নের শহর মনে হয়। মনে হয় সবকিছু ছেড়ে গ্রামে কিংবা নিশ্চুপ কোনো দূর শহরে চলে যাব যেখানে এতটা যান্ত্রিকতা নেই, যেখানে প্রকৃতির অমৃত আস্বাদন করা যায়। তবুও জীবন তো থেমে থাকে না। শত অভিযোগের মাঝেও জীবনকে আগলে রেখে ছুটে চলতে হয়, এটাই বাস্তবতা।

[প্রায় বছর দুয়েক আগে আমার এই লেখাটি ‘সরব’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন সরবের সদস্য ছিলাম না। তাই ‘অন্য স্বর’ এর একাউন্ট থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে খুবই প্রিয়। আজ নিজের লেখাগুলো ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আরও একবার লেখাটি পড়লাম। এই ঢাকা শহরকে ঘিরে আমার যে আবেগ, ভালবাসা এবং স্মৃতি জড়িয়ে আছে তারই রোমন্থন ক্ষুদ্র পরিসরে করার চেষ্টা করেছিলাম। তাই লেখাটি এবার নিজ একাউন্ট থেকে শেয়ার করতে চাচ্ছি।]

পাহাড়ি কন্যা সম্পর্কে

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বাস্তব ও কল্পনা আমার দৈনন্দিন জীবনের সহযাত্রী। জীবনকে ভালবাসি। অনেক স্বপ্ন দেখি, যদিও তা বাস্তব থেকে মাঝে মাঝে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। আমি বরাবরই রাশভারী প্রকৃতির মানুষ, স্বল্পভাষী কিন্তু হাসতে খুব ভালবাসি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to এই ঢাকা সেই ঢাকা…

  1. শারমিন বলেছেনঃ

    লিখাটা সত্যিই সুন্দর 🙂

    প্রাণপ্রিয় এই ঢাকা শহরকে তাই মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নের শহর মনে হয়| মনে হয় সবকিছু ছেড়ে গ্রামে কিংবা নিশ্চুপ কোনো দূর শহরে চলে যাব যেখানে এতটা যান্ত্রিকতা নেই, যেখানে প্রকৃতির অমৃত আস্বাদন করা যায়| তবুও জীবন তো থেমে থাকে না | শত অভিযোগের মাঝেও জীবনকে আগলে রেখে ছুটে চলতে হয়, এটাই বাস্তবতা |

    মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল সত্তিই তো এই যান্ত্রিকতা আর শত অভিযোগের মাঝেই জীবন ছুটে চলেছে জীবনের মত।

    • পাহাড়ি কন্যা বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ শারমিন 🙂 আমরা যারা ছোটবেলা থেকে এই শহরটাতে বড় হয়েছি, তাদের সবার আবেগ-অনুভূতি-অভিযোগের স্থানগুলো হয়তো একই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।