আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করত যে সারাদিনে আমার সবচাইতে প্রিয় কাজ কোনটি, একজন খাঁটি আলসে মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই আমি বলতাম ঘুমানোর কথা, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা। আহা, এর চাইতে শান্তির কাজ আর কিছু হয়! সুযোগ থাকলে আমি দিনের মাঝে ২৪ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটাতাম! কিন্তু যান্ত্রিক জীবনে দিনে ৭/৮ ঘণ্টার বেশী ঘুমানোর সুযোগ কই!
মোটামুটিভাবে একজন মানুষ তার জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। আর জীবনের এই বিশাল অংশটির অন্যতম অংশ হল স্বপ্ন বা Dream। বলা চলে, স্বপ্ন মানুষের একটি মানসিক অবস্থা, যখন ঘুমিয়ে থাকা একজন মানুষ বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা অবচেতনভাবে অনুভব করতে থাকেন। বেশিরভাগ সময় স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেই তার কল্পনায় অংশ নিচ্ছেন বা নিজেই দর্শক হিসেবে ঘটনাগুলো দেখছেন বলে ধরে নেন।
স্বপ্ন নিয়ে বহুকালে বহু ধারণা, তত্ত্ব, বিশ্বাসের আগমন হয়েছে। কালের পরিবর্তনে সেগুলো হারিয়েও গেছে। যেমন, প্রাচীনকালে মেসোপটেমিয়ানরা বিশ্বাস করতো, ঘুমের মধ্যে আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে যায়, বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে থাকে। ভ্রমণ পথে আত্মা যা দেখে, যা করে, তাই হল স্বপ্ন। আর ঘুমন্ত অবস্থায় এই ভ্রমণের নির্দেশনা আসে স্বয়ং স্বপ্ন দেবীর তরফ থেকে। আবার গ্রীক ও রোমানরা মনে করতো, স্বপ্ন হল দেবতা বা কোনো মৃত ব্যক্তির পাঠানো বার্তা। তাদের কাছে স্বপ্ন ছিলো ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবাণী।
প্রাচীন চৈনিক ধারণা অনুযায়ী আত্মার দু’টি অংশ, একটি সবসময় শরীরের ভেতরে স্থির থাকে। আর অন্যটি ঘুমের মাঝে ‘অপারলোকে’ ভ্রমণ করে। ভারতীয় উপনিষদ অনুসারে স্বপ্নের দু’ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে – মানবিক কামনার বিশুদ্ধ প্রকাশ আর আত্মার দ্বৈত রূপের বহিঃপ্রকাশ। মেক্সিকো ও আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা স্বপ্নকে মনে করত মৃত পূর্বপুরুষদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম। মৃত পূর্বপুরুষগণ স্বর্গলোক থেকে দেবতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে অনাগত দিনে কোন আপদ-বিপদ অপেক্ষা করে থাকলে সেই বিষয়ে উত্তরসূরীদের জানান দেবার জন্যে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখা দেন। এজন্য তারা স্বপ্নে তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের দেখা পাবার জন্যে বিভিন্ন উপাসনাও করত।
জার্মান মনোবিজ্ঞানী ফ্রেড্রিখ পেরলসের ভাষ্যমতে, প্রতিটি মানুষের মাঝে আসলে দুইটি সত্ত্বা বিরাজ করে, একটিকে সে বাইরে প্রকাশ করে আর অন্যটিকে সে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখে। মানুষ তার যে সত্ত্বাটিকে লুকিয়ে রাখে বা রাখতে চায়, তারই অভিক্ষেপণ হিসেবে স্বপ্ন আবির্ভূত হয়। এই ব্যাপারটার সাথে রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের বিখ্যাত উপন্যাস The Strange Case of Dr. Jekyll and Mr. Hyde এর বেশ মিল আছে।
স্বপ্নের উৎপত্তি নিয়ে খুব সুন্দর একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন জিএ যহাং। তার প্রস্তাবনা অনুসারে, স্বপ্ন মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমবায় ও সংশ্লেষণের ফলস্বরূপ উৎপন্ন হয়। ঘুমের মাঝে আমাদের মস্তিষ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, আর তা হল স্বল্পস্থায়ী বিভিন্ন স্মৃতিকে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করা। এসময় মস্তিষ্কের Subconscious অংশ প্রক্রিয়াধীন স্মৃতিগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর Consciouss অংশের কার্যক্রম অনেকাংশে স্থির থাকে। তখন স্মৃতির বিশাল ভাণ্ডারে একধরণের তথ্যঝড় বয়ে যায়। আর তখনই স্বপ্নের উৎপত্তি হয়।
আমাদের ঘুমকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায় – REM (Rapid Eye Movement Sleep) এবং NREM (Non-Rapid Eye Movement Sleep)। ঘুমের মাঝে প্রথম ধাপ হিসেবে আসে NREM। NREM ধাপের এই তিনটি পর্যায়ের পর আসে REM ধাপ। প্রধানত REM ধাপে এসেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। বিবর্তনবাদ অনুসারে দেখা যায়, প্রথমে ঘুমের REM ধাপের আগমন ঘটে এবং পরে এই ধাপেই মানুষ স্বপ্ন দেখে।
ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো স্তিমিত হলেও সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় আসলে হয় না। ঘুমের মাঝেও এগুলো চিন্তা করতে পারে, বাইরের জগত থেকে সংবেদ গ্রহণ করতে পারে। আর সে কারণেই এই ধরণের নানা কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা ও দৃশ্যের সূত্রপাত হয়। অনেক Oneirologist (স্বপ্নবৈজ্ঞানিক) এর মতে ঘুমের যে পর্যায়ে কেবল অক্ষিগোলক (Eye Ball) দ্রুত নড়াচড়া করে কিন্তু বাকি শরীর শিথিল থাকে (REM ধাপ), সেই দশায় মানুষ স্বপ্ন দেখে।
বৈজ্ঞানিক ক্যালভিন এস হল এবং ভ্যান ডি ক্যাসল কোডিং পদ্ধতির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, বিশ্বের প্রায় সব মানুষই সাধারণত একই ধরনের বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে এবং অধিকাংশ সময়ই সে বিষয়টি নিকটবর্তী কোন সময়ে ঘটে যাওয়া কোন কিছু নিয়েই।
তবে স্বপ্নের উৎপত্তি নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মনে এখনও অনেক বিতর্ক রয়েছে। আমাদের মস্তিষ্কের ঠিক কোন অংশে, কীভাবে এই স্বপ্নের জন্ম হয় – তা আজও বৈজ্ঞানিকগণ সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে খুঁজে বের করতে পারেন নি। তাই স্বপ্নের উৎপত্তির পেছনের কথাগুলোও নিশ্চিতভাবে জানা হয়ে ওঠে নি তাদের পক্ষে।
গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, প্রায় প্রতি ৯০ মিনিটে অন্তত ১০ মিনিট সময় ধরে ঘুমের REM ধাপ চলে। ৬/৭ ঘণ্টা টানা ঘুমের মাঝে ৩ থেকে ৫ বার REM ধাপের আগমন হতে পারে। অর্থাৎ একজন মানুষ মানুষ প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ টি স্বপ্ন দেখতে পারে। ক্লান্ত মানুষ সাধারণত ঘুমানোর প্রথম দু’ ঘণ্টায় কোন স্বপ্ন দেখে না। তখন শরীর পূর্ণ বিশ্রাম নেয়।
জন্মের ৩/৪ মাস পর থেকেই শিশুরা স্বপ্ন দেখা শুরু করে। ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ঘুমের প্রায় ৪০% সময় এবং কৈশোরে ঘুমের প্রায় ২০-২২% সময় স্বপ্ন দেখে কাটায়। বয়স চল্লিশের পর থেকে ঘুমের ১২-১৫% স্বপ্ন দেখা হয়। বয়স যত বাড়তে থাকে স্বপ্ন তত কমতে থাকে। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক প্রবণতা হচ্ছে মানুষ স্বপ্নহীন হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে।
সাধারণত মানুষ ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর বেশীরভাগ স্বপ্নের কথাই ঠিকঠাক ভাবে মনে রাখতে পারে না। দেখা স্বপ্নের বর্ণনা মানুষ যখন অন্যের কাছে বর্ণনা করে তখন সাধারণত মানুষ মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়। কারণ, স্বপ্ন বর্ণনার সময় জাগ্রত অবস্থার মনোভাব দেখা স্বপ্নের উপর প্রভাব ফেলে। স্বপ্ন এতটা সাজানো গোছানো থাকে না যেমনটা মানুষ বলে।
আদিকাল থেকেই স্বপ্ন মানুষের কাছে এক রহস্য। আর কৌতূহলী মানুষ তার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছে এবং করছে। খোয়াবনামা জাতীয় বইয়ের কাটিতি দেখলেই তা বোঝা যায়। তবে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা হল, স্বপ্নের ব্যাখ্যা কোন বইয়ে থাকতে পারে না। স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা কেবল জানতে পারে স্বপ্নদ্রষ্টা নিজে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ স্বপ্নদ্রষ্টা এটাই জানেন না যে তিনি সঠিক ব্যাখ্যাটা জানেন।
এক অর্থে বলা যায়, স্বপ্নদ্রষ্টার নিজের জ্ঞান, যা সম্পর্কে তিনি সচেতন নন, সেই জ্ঞানই প্রকাশিত হয় স্বপ্নে। এভাবে চিন্তা করলে, নিজেকে জানার জন্য স্বপ্ন মনে রাখার এবং স্বপ্ন বিশ্লেষণের গুরুত্ব অনেক। আর স্বপ্ন মনে রাখার জন্যে চাই যথেষ্ট চেষ্টা, মনোযোগ আর মনের উপর অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ।
স্বপ্নের তাৎপর্য মূলত নির্ভর করে স্বপ্নদ্রষ্টার চিন্তাধারার উপর। রবি ঠাকুর তাঁর রাজর্ষি নাটকের প্লট খুঁজে পেয়েছিলেন স্বপ্নে, ইংরেজ কবি কোলরিজ তাঁর বিখ্যাত Kubala Khan কবিতাটি স্বপ্ন দেখে লিখেছেন, নিলস বোর পরমাণুর গঠন স্বপ্নে দেখেছিলেন, বেনজিনের চক্রাকার গঠণের তত্ত্বটি অগাস্ট কেঁকুল স্বপ্নেই দেখেছিলেন। স্বপ্ন থেকে অনেক বড় কিছু হতেই পারে, তবে তার পেছনে আসলে স্বপ্নদ্রষ্টার সচেতন চিন্তাই মূল হিসেবে কাজ করে।
একথা ঠিক চিন্তা স্বপ্নকে প্রভাবিত করে। তবে চিন্তার তুলনায় স্বপ্নের বিচরণক্ষেত্র অনেক বেশী প্রশস্ত। স্বপ্ন যুক্তির গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না, কিন্তু চিন্তা যুক্তির গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে। তাছাড়া আমাদের চিন্তা পরিচালিত হয় কেবল Conscious Mind থেকে। অন্যদিকে স্বপ্নের উৎপত্তি সম্ভবত Conscious ও Sub-conscious Mind দু’য়ের মাঝে তথ্য আদানপ্রদানের মেলবন্ধনে।
অনেকে দাবী করেন, তারা যা স্বপ্নে দেখেন, বাস্তবেও ঠিক তাই হয়ে যায়। যেমন, আকাশ হয়ত রাঙ্গামাটি বেড়াতে যেয়ে রাতে স্বপ্ন দেখল তাকে একটা পোকা কামড়ে কামড়ে একেবারে রক্তারক্তি অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এবং ঘুম ভাংতেই সে দেখল সে আসলে তার বিছানার নিচে শুয়ে আছে আর একটা কাঁকড়াবিছা তাকে কামড়ে সত্যি সত্যি রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেলেছে!
আমার কপালটা নেহাত বেশ ভালো, আমি যা স্বপ্নে দেখি তা সাধারণত আমার সাথে ঘটে না!
ইদানীং, আমি অ্যালিয়েন নিয়ে কিছু পড়াশোনা করছি। প্রায়ই অ্যালিয়েনদের উপর বিভিন্ন আর্টিকেল পড়বার চেষ্টা করি ইন্টারনেটে। তার ফল হিসেবে মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখি মাথায় আঁকাবাঁকা অ্যান্টেনাওয়ালা কমলা রঙের লোমশ একটা প্রাণী আমাকে ধরতে আসছে! কিংবা একটা সবুজ রঙের খসখসে শরীরওয়ালা প্রাণী আমার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে! ব্যাপারটা সত্যি হলে কি ভয়ানকই না হোত!
স্বপ্ন নিয়ে আরও:
সুযোগ থাকলে ২৪ ঘন্টাই ঘুমিয়ে কাটাতে! :clappinghands:
লেখা বরাবরের মতোই ভালো। কিন্তু লেখার মাঝে অনুজ অনুজ স্বাদ কিছুটা কম- আমার এরকম মনে হয়েছে।
কথা সত্য। তাড়াহুড়ো করলে যা হয় আরকি!
‘স্বপ্ন’- এই বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই বেশ কৌতূহল ছিল। আপনার লেখাটি পড়ে ভাল লেগেছে। আমি আমার এক বন্ধুর কাছে একবার একটি ঘটনা শুনেছিলাম যে, সে স্বপ্নে একটি ঘটনা দেখেছিল যেখানে তার অফিসের এক কলিগ এক পর্যায়ে তাকে একটি প্রশ্ন করে। কিছুদিন পর আমার ঐ বন্ধুটির সাথে ঠিক একই ঘটনা ঘটে এবং ঘটনার এক পর্যায়ে তার ঐ কলিগ তাকে ঠিক একই প্রশ্নটি করে। এতে সে বেশ অবাকই হয়েছিল যে কিভাবে স্বপ্নের সাথে বাস্তব মিলে যেতে পারে!! :thinking:
ধন্যবাদ, আপু!!
🙂
ঘটনাটা হয়ত এমন ছিল যে, আপনার সেই বন্ধু আগে থেকেই এরকম কিছু একটা ভেবে রেখেছিলেন। আর বাস্তবে সেটাই কোনভাবে হয়ে গেছে।
এমন অভিজ্ঞতা মনে হয় আমাদের অনেকেরই আছে। তবে বেশিরভাগ মানুষ একে কাকতালীয় বলতেই হয়ত বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন!
স্বপ্ন নিয়ে আমি নিজেও বেশ কিছু লিখা পড়েছিলাম
তোর লিখা পড়ে আরও কিছু জানতে পারলুম 😀
তবে আরও একটু বেশি ইনফরমেটিভ হলে ভালো হত 🙂
টিঙ্কুশ!
😀
তাড়াহুড়োতে আর খুব বেশী লেখা হয়ে ওঠে নি! 😛
আমি চাই না ঘুমিয়ে কাটাতে কিন্তু পারি না 🙁 এই যে মন্তব্যটা করছি প্রচন্ড ঘুম ঘুম চোখে ।
না ঘুমিয়ে থাকতে!
ভাইয়া, আপনি মানুষ!
ঘুমের মত এত্ত মজার ব্যাপারটাকে আসতে দিতে চান না!
😛 😛 😛