মোস্তফা সারওয়ার ফারুকি পরিচালিত ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ গত ২৪ অক্টোবর মুক্তি পায়। ইতিমধ্যে টিভি, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে এই ছবিটি। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন- নূর ইমরান মিঠু, শিনা চৌহান, সাব্বির হাসান লিখন, মোহিনী মৌ প্রমুখ। এরই মধ্যে ছবিটি সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে সিলভার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে যেখানে প্রতি বছর ১০টি সেরা এশিয়ান ছবি স্থান পেয়ে থাকে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্ব করার মতই একটি বিষয়। যেখানে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ভঙ্গুর দশা থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এ ধরণের একটি সাফল্য আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হতে পারে। অবশ্য মোস্তফা সারওয়ার ফারুকি পরিচালিত ‘টেলিভিশন’ ছবিটিও কয়েকটি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়েছিল।
যাও বা কোথায় যাও মন আমার,
লেজে রাখা পা,
রঙের হাওয়ায় উড়ুউড়ু, পথ হারিও না…
পিপীলিকার পাখা গজায় উড়িবার তরে,
উড়িয়া উড়িয়া ফানুস দেখ ওড়ে আহারে!
‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিতে ‘চিরকুট’-এর গাওয়া ‘লেজে রাখা পা’ টাইটেল ট্র্যাকের এই কথাগুলোই ছবিটির সারমর্ম। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মিঠু। মিঠু মাস্টার্স পাশ করা বেকার যুবক। অভাবের সংসারে সেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চাকরির খোঁজে কেরানীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ভোরে নৌকায় করে নদী পার হয়ে ঢাকায় আসে চাকরির সন্ধানে। লাজুক ও অন্তর্মুখী স্বভাবের যুবক মিঠুর ভাগ্য খুলে যায় যখন সে ‘লাকি সেভেন’ কোম্পানিতে চাকরি পায়। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। তারপর সে একদিন ব্ল্যাক মার্কেট (যেখানে চুরি করা মোবাইল কম দামে বিক্রি হয়) থেকে অল্প দামে একটি মোবাইল কিনে। মোবাইলের সূত্র ধরেই পরিচয় অভিনেত্রী রিমার সাথে। আসলে মোবাইলটি রিমারই ছিল। মোবাইল ট্র্যাকিং করে মিঠুর সাথে যোগাযোগ হয় রিমার। সহজ-সরল মিঠু মোবাইলটি রিমাকে ফেরত দিয়ে দেয়। সাহায্য স্বরূপ রিমার দেয়া ক্রয়ের অতিরিক্ত অর্থও সে ফেরত দিয়ে দেয় রিমাকে। কিন্তু সমস্যা বাঁধে ঐ মোবাইলে থেকে যাওয়া রিমার একটি ভিডিও নিয়ে। রিমার মনে অজানা ভয় জন্ম নেয় যে, যদিও মিঠুকে দেখে নিতান্ত সরল মনে হয়, তবুও সে যদি ভিডিওটির কপি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় তাহলে হয়তো ব্যাপারটা রিমার ক্যারিয়ারের জন্য বিপদজনক হবে। এমনই অবস্থায় মিঠুকে সাহায্য করার জন্য রিমা লাকি সেভেন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে। কোম্পানির ক্লায়েন্ট লিস্টে রিমার মত একজন সেলিব্রেটি যুক্ত হওয়ায় মিঠুর প্রমোশন হয়। রিমা ও মিঠুর মধ্যে বেশ ভাল বন্ধুত্বও গড়ে উঠে। খুব দ্রুত ক্যারিয়ারের সাফল্য মিঠুর হাতে ধরা দেয়।
এদিকে রিমার মোবাইলে থাকা ভিডিওটি সে ঠিকই দেখেছিল, কিন্তু মনের ভেতরে ঘটতে থাকা যুদ্ধে সে প্রথমদিকে নিজেকে সংযত রাখতে পারলেও অবশেষে পরাজিত হয়। লোভের ভয়ানক থাবা আঁকড়ে ধরে মিঠুকে। এভাবেই রিমাকে ব্ল্যাকমেইলে জড়ানোর চেষ্টা করে মিঠু। কিন্তু লোভের ফল যে কখনই ভাল হয়না সেটা মিঠু ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারে। লাকি সেভেন কোম্পানি বিভিন্ন সরকারি তদন্তে জড়িয়ে পড়ায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে পাওনাদারদের ভিড় লেগেই থাকে মিঠুর বাসায়। অন্যদিকে রিমাও প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। মিঠু বাসা থেকে পালিয়ে কোনভাবে দিনপাত করে। পাড়া-প্রতিবেশিদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয় মিঠু ও মিঠুর পরিবারকে ঘিরে। মিঠুর ছোট বোনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মিঠুকেও সবসময় জীবন বাজি রেখে ছুটে চলতে হয়। অবশেষে মিঠু সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আবার ভাল হয়ে যাবে, সেই আগের সহজ-সরল, সর্বক্ষণ মায়ের চোখে চোখে থাকা ছোট্ট মিঠু হয়ে যাবে। মূলত লোভ ও কামনার বশবর্তী হয়ে একটি সহজ-সরল মনে কিভাবে পরিবর্তন আসে এবং একটি সাধারণ জীবন কিভাবে এলোমেলো হয়ে যেতে পারে সেই বার্তাই পৌঁছান হয়েছে ছবিটিতে।
এখন আসি ছবিটির বিশ্লেষণে…
- মোস্তফা সারওয়ার ফারুকি ছবিটি কেমন বানিয়েছেন? আমার কাছে ভালই লেগেছে। আর ছবির পরিচালনা নিয়ে কোন কথা হবে না। বেশ ভালই পরিচালনা করেছেন মোস্তফা সারওয়ার ফারুকি। ছবিটির কিছু প্রতীকী দৃশ্য দর্শককে গল্পটি নিয়ে আলাদাভাবে ভাববার সুযোগ করে দেয়। প্রতীকী দৃশ্যগুলো আমার কাছে সত্যিকার অর্থে দারুণ লেগেছে।
- মোস্তফা সারওয়ার ফারুকির কাছ থেকে কি আমরা এর চেয়েও ভাল ছবি আশা করি? অবশ্যই, তাঁর কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা বরাবরই আকাশছোঁয়া। তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী ফিল্মে এর চেয়েও অনেক ভাল ও ভিন্নধর্মী গল্প আশা করছি। তাই বলে যে উনি ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিটিতে দর্শককে হতাশ করেছেন সেটা বলছি না। ছবিটিতে গল্পের উপস্থাপন ও গল্পের বিস্তৃতির সাথে সাথে চরিত্রগুলোর আত্মপ্রকাশ ও চূড়ান্ত পরিণতি খুব গুছিয়ে দেখানো হয়েছে।
- ছবিটি নিয়ে কিছু সমালোচনা শুনেছিলাম। যেমন- ছবিটির দৈর্ঘ্য দেড় ঘণ্টা। আমার কাছে ছবিটির দৈর্ঘ্য মোটেও কোন ব্যাপার মনে হয়নি। বরং মোস্তফা সারওয়ার ফারুকির সাথে আমি একমত যে, কোন ছবির গল্প বলা শেষ হয়ে গেলে অযথা টেনে লম্বা করার কোন প্রয়োজন নেই। আরেকটি সমালোচনা শুনেছিলাম, ছবিটি নাকি বেশ খোলামেলা (অনেকে ‘অশ্লীল’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন)! অথচ ছবিটিতে সরাসরি খোলাখুলিভাবে কোন অস্বস্তিকর দৃশ্য দেখানো হয়নি।
- অনেকেই বলেন আমাদের চলচ্চিত্র ডিজিটালাইজড করার পর নাকি অনেকটা নাটকের মত স্ক্রিনিং হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটার সাথে আমি কিছুটা একমত। কিন্তু ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র স্ক্রিনিং আমার ভাল লেগেছে। নাটক নাটক মনে হয়নি।
- ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ও ‘টেলিভিশন’ এর চেয়ে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ আমার কাছে অপেক্ষাকৃত বেশিই ভাল লেগেছে। অবশ্য এটা আমার নিজস্ব অভিমত। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে আমি তর্কে জড়াব না। (যদিও মোস্তফা সারওয়ার ফারুকি পরিচালিত সবগুলো ছবির মধ্যে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-কেই আমি শীর্ষস্থানে রাখব।)
পরিশেষে পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলব, আমি ফেসবুকে অনেককেই দেখেছি যারা ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ নিয়ে মোটামুটি নাক সিটকানো মনোভাব দেখাচ্ছেন। তাঁরাই আবার ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, ‘ব্যাং ব্যাং’ এর মত টিপিকাল হিন্দি কমার্শিয়াল (ভাল গল্পের হিন্দি ছবি হলেও একটা কথা ছিল!) ফিল্ম নিয়ে মাতামাতি করেন, সানি লিয়নের ‘বেবি ডল’ এর মত গানের ভিডিও শেয়ার করেন। তাঁদের কাছে জানতে চাইব, তাঁরা কি আদৌ ছবিটি দেখেই কমেন্ট করেন নাকি না দেখেই অন্যের কাছ থেকে শোনা কথায় কান দিয়ে কমেন্ট করেন। তাঁরা যতটা নাক সিটকাচ্ছেন সেরকম ছবি কিন্তু এটি নয়। গতানুগতিক লাভ স্টোরির বাইরে ভিন্নধর্মী গল্পের উপর ছবি আমাদের দেশে খুব কমই বানানো হয়। তাই হলে গিয়ে ছবি দেখার এরকম মোক্ষম সুযোগ খুব কমই পাওয়া যায়। আর আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিটি হলে গিয়ে দেখে আসা যায় কিনা, তাহলে আমি আপনাকে অবশ্যই রিকমেন্ড করব এই ছবিটি দেখে আসার জন্য। আপনার দেড় ঘণ্টা বিফলে যাবে না সেই আশ্বাসটুকু আপনাকে দিতে পারি।
মুভিটা এখনো দেখি নি। ইচ্ছে আছে। দেশের বাইরে থাকায় হলে যাবার উপায় নাই এখন।
আপনার রিভিউটা বেশ ভালো লাগছে।
শেষের কথাগুলো খুব পছন্দ হইছে। মনে হইছে আমারই কথা!
ধন্যবাদ 🙂 শেষের কথাগুলো মনের ক্ষোভ থেকে বলা। হয়তোবা আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ওত শক্তিশালী না। কিন্তু তাই বলে একদমই ভাল ফিল্ম তৈরি হয়না এটা মানতে আমি নারাজ!