মা,
কেমন আছ? অনেকদিন তোমার সাথে কথা হয় না। তাই আজকে তোমায় লিখতে বসলাম। নিজের কাছে কেমন যেন লজ্জা লাগছে, এতোদিন পর তোমার সাথে কথা বলতে! এভাবে তো তোমাকে ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি।
আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে ভুলে যাইনি। তোমার কথা যে কত ভাবি। মাঝে মাঝে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে হয়। আমি প্রতিদিন রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম তুমি ঘুম থেকে ডেকে তুলে কোলে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে। খুব বেশি ভালো খাবার হয়তো পেতাম না, কিন্তু, তুমি অনেক যত্ন করে খাওয়াতে তাই খেতে খারাপ লাগতো না কখনো।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে দেখতাম, বাবা ঘরে এসে তোমাকে মারছে! আমরা সব ভাইবোন তখন জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পরে থাকতাম। বাবা-কে যে ভীষন ভয় ছিল আমাদের! তুমি কোন শব্দ করতে না ওই খারাপ মানুষটার কাছে মার খেয়েও। কি ভয়ংকর সময় যে ছিল ওই সময়টা!
একবার আমাকে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলে তুমি। নাগরদোলায় চড়ে আমার অনেক খুশি লাগছিলো। একবার উঁচুতে ওঠার আর একবার নিচুতে নামার কি অদ্ভূত অনূভুতি! তার চেয়ে বেশি ভালো লাগছিলো যখন নিচের দিকে তাকিয়ে তোমার হাসিমুখ দেখতে পাচ্ছিলাম।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি তোমাকে কখনও ঘুমাতে দেখিনি! সেই সকালে কাজে যাবার আগেই আমাদের জন্য কোন নাস্তার ব্যবস্থা করে তুমি ঘুম থেকে ওঠাতে আমাদের। আবার রাতে আমরা খেয়ে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত তুমি বিছানায় যেতে না। তুমি কি সত্যিই কখনো ঘুমাতে? নাকি, চিন্তায় কালি পরা চোখ দু’টি কখনো বন্ধ করলে তোমার স্বপ্নগুলোও এই পৃথিবীর মতো অন্ধকার থাকতো?
একবার আমার টাইফয়েড হলো। সেবার ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তুমি আমার মাথায় পানি ঢালতে আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। এরপর থেকে আমার শুধু মনে হতো, আমার যদি সবসময় জ্বর থাকতো, তাহলে তো সব সময়ই তুমি আমার মাথায় এমন করে হাত বুলিয়ে দিতে!
ছোট বেলায় যখন পড়ালেখায় খুব বেশি এগুতে পারলাম না, তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে। কিন্তু, আমি তখন বুঝিনি অবাধ স্বাধীনতার আড়ালে কি ভয়ানক ভবিষ্যৎ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি কত করে বলতে আমাকে পড়ালেখা আবার করতে, কিন্তু আমি কানেই তুলিনি তখন।
আমারও কিন্তু ইচ্ছে ছিল, অনেক বড় হব। অনেক টাকা হবে আমার। ছোটবেলার কষ্ট তো ভুলতে পারিনি। আশেপাশের অনেক অশিক্ষিত মানুষগুলোর হাতে প্রচুর টাকা দেখেই তোমার বোকা ছেলেটা হয়তো মনে করেছিল পড়ালেখা অত না করলেও চলে।
তোমার মনে আছে, একবার অনেক বাজে ছেলেদের পাল্লায় পরেছিলাম আমি। তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে। তারপরও আমাকে কত বুঝিয়ে যে ওদের দল থেকে চাড়িয়ে এনেছিলে!
তুমি বারবার বলতে আমাকে, ছেলেমেয়েদের মানুষ করিস বাবা। ওদের কষ্ট দিস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট দেখলে যে অন্তরটা ছিঁড়ে যায়! তোমার কথাগুলো তখন না বুঝলেও এখন বুঝি মা।
তোমাকে বলা হয়নি মা, আমার ছেলেমেয়েরা কিন্তু ভালোমতোই বড় হয়ে উঠছিল। তাদের যত্ন করতে আমি কখনো ত্রুটি করিনি। ছোটখাটো কাজ করে আমি কিছু টাকা জমিয়ে শেয়ারের ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ভালোই টাকা আয় হতো। ছেলেমেয়েদের ভালো খাওয়াতে পারতাম, ভালো পরাতে পারতাম। শুধু তোমাকে কিছু করতে পারিনি ভেবে খারাপ লাগতো সবসময়।
হঠাৎ কোন এক অদ্ভূত ঝড়ে আমার সব ভেসে গেছে মা। আমার ব্যবসায়ের সব টাকা গিলে নিয়েছে অদ্ভূত এক শেয়ার বাজার। যার সাথে আমরা কেউ পরিচিত না। আমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। আমাদের পাশেও আমরা কাউকে পাচ্ছি না। কি যে অসহায় লাগছে মা! আমার ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মেয়েটা একটু বড় হয়েছে, মাঝে মাঝে আমার কাধে এসে হাত রাখে। চোখ ভেঙে জল আসে মা, চোখ ভেঙে জল আসে। সেই ছোট্টবেলার দিনগুলোতে আবার ফেরত চলে যাই এক নিমেষে। দুঃখের সেই দিনগুলোতে তো তুমি পাশে ছিলে, তোমাকে পাশে পেতে খুব ইচ্ছে হয়।
আর কেউ তো আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারছে না। রাস্তায় আমরা মার খাচ্ছি, আমাদের চোখের জল গড়াচ্ছে। আমার ছোট্ট ছেলেটার নির্বাক অসহায় মুখটা ভবিষ্যতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। খুব অসহায় লাগছে মা। খুব অসহায় লাগছে।
আবার, আমার কাছে এসে একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যাও না, মা।
বি:দ্র: ছবিটি একজন শেয়ার ব্যবসায়ীর, সব হারিয়ে নিঃস্ব যিনি। এই লেখার চরিত্রের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। শেয়ার বাজারে কি হচ্ছে, তা আমরা অনেকেই বুঝি না। কিন্তু, এটা অন্তত বুঝি, কাউকে সব হারিয়ে রাস্তায় কাঁদতে দেখতে চাই না। কারণ প্রতিটি মানুষের সাথেই জড়িয়ে আছে, একটা করে পরিবার। একটা সুন্দর গল্প। গল্পগুলো কান্নার জলে ডুবে যেতে দেখতে চাই না।
গল্পটা পড়ে যে কমেন্ট টা করতে ইচ্ছে হলোঃ “পাইসেন টা কি? প্রতি পোস্টে মন খারাপ করিয়ে দেন!” :haturi:
পরে মনে হলো এর আগের পোস্ট টাই ছিল হাসির।
তাই কিছু বললাম না 😛
😡 😛
বরাবরের মতই দারুণ একটা লেখা। :huzur:
আর empathetic, বরাবরের মতই। 🙂
ধন্যবাদ 🙂
চারপাশের ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে কী অদ্ভুত সুন্দর গল্প লিখেন আপনি!!
আমাদের একটু শিখিয়ে দেন না ভাই।
পোস্টে বরাবরের মতোই ভালোলাগা ছড়িয়ে দিলাম।
অনেক ধন্যবাদ। :happy:
লিখাটা শুরু করেছিলাম সাধারণ একটা গল্প লেখার জন্য, কিন্তু ছবিটা দেখার পর কেন যেন ছবিটা গল্পটাকে নিয়ে নিল……
ছবিটা এত মন খারাপ করা!!
হাহাকার করা 🙁
🙁
শেয়ার বাজারের অব্যাহত দরপতন যে শুধু চোখের জল শুকিয়ে নিয়ে যায়, তা না! এর কারণে যে কতো ঘরের মানুষ পথে বসছে/ বসতে যাচ্ছে তার হিসেব নাই। আবার শোকের কারণে কেউ কেউ তো মরে পর্যন্ত যাচ্ছে। জানেন ভাইয়া, আমার পরিচিত এক আঙ্কেলের শ্যালক হার্ট অ্যাটাক করেছেন ক’দিন আগে- এই শেয়ার মার্কেটের টেনশনে! বুঝেন অবস্থা!
আমারো অবশ্য শেয়ার মার্কেটের পরিস্থিতি নিয়ে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে ছিল। এই ধাচে না, একটু অন্যভাবে। আর শিরোনামহীনও না, শিরোনাম দিয়েছিলাম ”মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি/আমরা ভাল নেই!”
দেবো দেবো করে আর দেয়াই হলো না! আপনিই দিয়ে দিলেন!
শেয়ার বাজারের এতো বাজে অবস্থা, কিন্তু, যাদের কিছু করার কথা, তারা পত্রিকায় বাণী দেয়া ছাড়া কিছু করছে না……… 🙁
তুমি এতো আইডিয়া শুধু মাথায় নিয়ে না ঘুরে কিছু ব্লগে নামিয়ে আনো…… 🙂
শেয়ার বাজারের আহাজারি আমি আর শুনতে চাই না, না, না।
আমার দম বন্ধ হয়ে আছে খবরে এই মানুষগুলোর চেহারা দেখতে পেলে।
লেখা হিসেবে ভাল হয়েছে।
কিছু বানান ভুল, বাক্যের ভুল আর অর্থের অসামঞ্জস্যতা বাদ দিয়ে।
“আমার দম বন্ধ হয়ে আছে খবরে এই মানুষগুলোর চেহারা দেখতে পেলে।” 🙁
কত কিছু যে ভুল করি! চেষ্টা করব ঠিক করতে এরপর থেকে…… :wallbash:
আমার পরিচিত এক আঙ্কেল তার পেনশন ও অন্যান্য জমানো মোট ৭০ লাখ টাকা শেয়ারে খুয়ে এখন বিছানায়! আমি যখন চিন্তা করি আমার মাথায় কোথায় যেন ব্যাথা করে উঠে! জীবনের শেষ সম্ভল টুকু! তাও আজ নেই!
এতো অসহায় লাগে…… 🙁
🙁
খালি মন খারাপ করে দিস 🙁
চারিদিকে এতো মন খারাপের গল্প, আমি মন ভালো করতে কিছু পাই না…… 🙁
🙁 ভাইয়া’র অসাধারণ সব গল্পগুলো শুধু মন খারাপ করিয়ে দেয় 🙁 🙁
কি করবো!!! আশেপাশের ঘটনাগুলো লেখার সময় দুঃখগুলোও কিবোর্ডে চলে আসে। 🙁