” অক্ষর নামে এককালে এক গল্প লেখকের জন্ম হয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে তাহার সেই লেখকসত্বার মৃত্যুও হয়েছে ! ” এই লাইনটা যদি কেউ আমাকে আগে বলতো ঐ মুহূর্তে আমার একটা “আহারে” টাইপ অনুভূতি হওয়ারই কথা ! একজনের লেখসত্বার মৃত্যু ! খারপই তো। বাইরে থেকে দেখে চিন্তা করলে অন্যরা হলেও তাই বলার কথা। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে যেই সব হতভাগার আমার গল্প পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে তারা খুব ভালো করেই জানেন ভদ্রতার খাতিরে সেটাকে ‘বাহ ভালোই লিখেছিস’ বলে হয়তো দেওয়া যায় কিন্তু সেখানে যে প্রকৃত লেখক সত্বার অস্তিত্বও নাই সেটা একজন ভালো পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবে।
যাক গে, নিজেকে এত পচা লেখক নাই বা বলি! এই এত কথা বলার একটা কারণই ছিল, সেটা হচ্ছে “আদৌ কি আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম? লেখা কী আমার প্যাশন? তাহলে “অযথা” লেখালিখি করলাম কেন? “ছিঃ অক্ষর ছিঃ ! তুমি তো সেই লেভেলের টাইম খেকো মানুষ হে!” নাহ এখনই এসব না বলি আমরা !
“প্যাশন” ব্যাপারটাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত “চিন্তা” করার চেষ্টা করছি। উত্তরটা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক থেকে পাচ্ছি, কিন্তু শেষমেস একটা পয়েন্টে গিয়ে উত্তর মনে হয় পেয়ে যাচ্ছি, আবার মনে হয় এই বুঝি উত্তর নাই হয়ে গেল। সেই পয়েন্টটা হচ্ছে “টাইম” ! ব্যাপারটা অনেকের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে, মনে হতেই পারে টাইমের সাথে প্যাশনের রিলেশন কীরে ভাই? আমি বলছি না, রিলেশন আছেই ! আমি বলছি থাকলে থাকতেও পারে। আমার যেহেতু বাজে স্বভাব প্রশ্ন করা তাই এখানেও কয়েকটা প্রশ্ন করা আসে।
১) প্যাশন আর ‘ইচ্ছা’ কিংবা ‘শখ’ এক নাকি না?
২) আমরা কি আমাদের “সিস্টেম” আমাদের যা যা হতে পারে দেখাচ্ছে সেখানেই সীমাবদ্ধ নাকি আমরা এর বাইরেও যেতে পারি?
৩) আমি কি জানি আমি কখন মারা যাবো? [আল্লাহ না করুক]
ইচ্ছা ব্যাপারটাকে আমি যেভাবে দেখি সেটা হচ্ছে একটা খুব স্বল্পস্থায়ী অনুভূতি। যেমনঃ আমার হয়তো আজ খোলা রাস্তায় হেঁটে যেতে ‘ইচ্ছা’ করছে, ইচ্ছা করছে বাসের কন্ডাক্টর হয়ে ‘আজকে’ একটু নতুন অভিজ্ঞতা নিতে কিংবা হয়তো মরে যেতেই ইচ্ছা করছে ! ! ! রাখবো না এই ফালতু জীবন! কি আছে গেবনে? কিচ্ছু নাই ! [আহারে ! !] কিন্তু কাল থেকে কিন্তু ঠিকই আমি আমার নিয়মিত কাজ করবো আবার সেটাই আশা করা যায় [যদি শেষ ফালতু ইচ্ছাটা কেউ পূরণ না করে ফেলি বা স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়] । কিন্তু এখন যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয় “তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও বাবু/বাবা/বাছা?” [এই সম্বোধন বয়সের সাথে সাথে আপগ্রেড হয় !] তখন আমার আজকের স্বাপেক্ষে উত্তর কী হবে? যে আমি বড় হয়ে খোলা রাস্তায় হাঁটতে চাই? নাকি বাসের কন্ডাক্টর হতে চাই। নাকি যা আছি তাই থাকতে চাই? ধরে নেই আমি জানি আমি আসলে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই [মিথ্যা কথা], তাহলে ঐ মুহূর্তে আমি যদি বলে বসি আমি রাস্তায় হাঁটতে চাই সারাজীবন, সেটা হয়তো তখন আমার ইচ্ছার কথাই বোঝাচ্ছে। কিন্তু এটা কি আমার প্যাশন? ধরে নেই গোঁ ধরে বললাম, “নাহ এইটাই আপনার প্যাশন! এইটাই এইটাই ! ! তাতে আপনার কী?” আমার কিছু তো অবশ্যই না কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই রাস্তায় হাঁটার জন্য আপনি কি প্রতিনিয়ত চিন্তা করেন? বা রাস্তায় কীভাবে হাঁটবেন বা কেন হাঁটবেন জানেন? 😛 তাহলে হয়তো সেটা ইচ্ছাই। আর ইচ্ছা তো প্যাশনের শত্রু না ! ঠিক একইভাবে একটা মানুষের অনেক ছোট ছোট ইচ্ছা থাকতেই পারে, না থাকাটাই বরং অনেক ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ইচ্ছার “প্রায়োরিটি”ও ভিন্ন ভিন্ন। এখন কে কোনটার প্রতি প্যাশনেট হবে এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা বাঁধে তখনই যখন মানুষের ইচ্ছাগুলো আসলেই অস্বাভাবিক হয়ে যায় যেমনঃ হতাশ থাকা কিংবা ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে যাওয়া বা হয়তো মানুষকে গালি দিয়ে নিজে প্রশান্তি পাওয়া ! 😛 এইগুলো কি “অস্বাভাবিক ইচ্ছা” না? এই ইচ্ছা পর্যন্তও হয়তো ঠিক ছিল কিন্তু একটা সময় সেই ইচ্ছা হয়ে যায় প্যাশন। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। বার বার প্র্যাকটিস করতে করতে এতটাই প্যাশনের সাথে সে কাজগুলো করতে থাকে যে হয়তো নিজেও জানে না সে আসলে প্যাশনেট কোন ব্যাপারে। সুতরাং কে আসলে জীবনে কোন রাস্তায় হাঁটতে চায় সেটা ডিফাইন করে দেয় তার প্যাশন, তার ইচ্ছা না। বাজে ইচ্ছার কারণে একটু উলটা পালটা হয় হয়তো কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন সেটা নিয়ে প্যাশনেট না থেকে নিজেকে জেনে নিলেই হয় ! নিজের “যোগ্যতা” আর সেই অনুযায়ী ব্যবহার করছি নাকি চিন্তা করে নিলেই হয় !
আচ্ছা ধরেই নিলাম, মানুষের ইচ্ছা আর প্যাশন নিয়ে আমরা এখনও কোনরকম ডিসিশনে আসতে পারি না। ইচ্ছাকে আমরা প্যাশন বলি, আবার প্যাশনকে ইচ্ছা বলে নর্দমাতে ছুড়ে ফেলি সিস্টেমের ভয়ে। কিন্তু একটা প্রশ্ন হচ্ছে সিস্টেমের জন্য আমরা নাকি আমাদের জন্য সিস্টেম? আমি এখানে “সিস্টেম” বলতে কি বোঝাচ্ছি সেটা বলে দেই। সিস্টেম বলতে এখানে বুঝতে হবে ইন্ডাস্ট্রি, শিক্ষা ব্যবস্থা, রাস্ট্র, পুরো বিশ্ব, এক কথায় আমাদের চিন্তা ভাবনা। হ্যাঁ, এইটা অস্বীকার করছি না, আমাদের নিয়েই এই সিস্টেম। কিন্তু এই সিস্টেমে “টিকে” থাকার জন্যই কি আমাদের প্যাশনের তৈরী হয় নাকি আমরা মূলত সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে আমার নিজের ডোমেইন থেকে এই সিস্টেমকে কিছু দিয়ে যেতে চাই? দুইটাই সহজ কেউ যদি মনে করে তার প্যাশন পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে আছে ততদিন চিন্তাভাবনা ছাড়া কাটিয়ে দিবে, এটাই তার প্যাশন, সেটা ভালো। আর কেউ যদি ভাবে “আমি আসলে কী করছি? আমার কী এইটা করার কথা? বা আমি কী এটাই করতে চাই?” সেটাও ভালো। কেউ টিকে থাকতে চায় আবার হয়তো কেউ জেনেই ফেলে এই “টিকে” থাকার স্বার্থকতা খুব কম। ট্রেন্ডকে ট্রেন্ড ভেবে নেওয়াটা যেমন স্মার্টনেস, না নেওয়াটাও কিন্তু কম স্মার্টনেস না। কিন্তু এর মানে এই না যে আমি সব ছেড়ে ছুড়ে জঙ্গলে চলে যাবো ! [ গেলেই বা কী? 😛 আমি তো প্রায়ই জঙ্গলে চলে যেতে চাই ! হায়রে ইচ্ছা ! 😀 ]
আবারও কি কনফিউজড হয়ে গেলাম? “ভাইয়া আপনি তো ডিসিশনই দিচ্ছেন না? কোন সংজ্ঞা নেই প্যাশনের? আমি কী করবো?” এইখানেই ঝামেলা ! আমরা আসলে মানুষের কাছে ডিসিশন চাই কিন্তু আসলে এইসব ব্যাপারে ডিসিশন দেওয়ার মত অবস্থায় কেউ থাকে না, কেউ নেওয়ার মত অবস্থায় থাকে না। কারণ প্রত্যেকের প্যাশন আলাদা আলাদা হওয়ার কথা। যাদের একই টাইপ “প্রফেশন” তাদেরও আসলে প্যাশন এক রকম না। সুতরাং এটা আসলেই অনেকটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। ডিসিশনও ব্যক্তিগত, সর্বোচ্চ যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে আলাপ করে সিচুয়েশন বোঝা যেতে পারে তবে একটা হিন্টস দেওয়া যায় সেটা হচ্ছে, “টাইম নাই!” আমি কখন মারা যাবো আমি জানি না, এখন এইটা চিন্তা করে কেউ যদি শুধুমাত্র মুভি দেখতে থাকে তাহলে মুভি দেখাই হয়তো তার প্যাশন, কেউ যদি চ্যারিটি ওয়ার্ক করতে নেমে যায় হয়তো এটা তার প্যাশন। আবার আমি তো বেঁচে আছি, একটা বড় কোন গোল চিন্তা করে ওটার জন্য আস্তে আস্তে চেষ্টা করে যাচ্ছে, হতে পারে ঐ চেষ্টাটাই তার প্যাশন। সো কনফিউশনের কিছু নেই। প্রত্যেকের প্যাশন হয়তো আলাদা, অনেকে একই রকম চিন্তাভাবনা করে, ভালো চিন্তা করে তারা একসাথে তাদের প্যাশনকে কাজে লাগিয়ে ভালো কাজ করে। আবার অনেকে ভুলে একা একা নিজের সাথে আনজাস্টিস করা শুরু করে, খারাপ কাজগুলোকে তার প্যাশন বানিয়ে ফেলে। কিন্তু যদি মানুষ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে পারে আর উত্তরটাও পায় যে সে কেন কোন কাজ করছে? সেটা ভালো নাকি খারাপ, বা ভালো খারাপ যাই হোক এটা তার জন্য কতটা ভালো, এতে কি আশেপাশের মানুষজনের উপর ভালো ইম্প্যাক্ট পরছে? যদি উত্তর “না” হয়, তাহলে বলবো হয়তো ওটা আপনার প্যাশন না, একটু ভুল পথে চলে গেছেন এই আর কি। চেষ্টা করলে নিজেকে কন্টিনিউয়াস প্রশ্ন করতে থাকলে হতে পারে আপনি আপনার প্যাশনটা খুজে পাবেন।
উপরের প্রসঙ্গে ফিরে যাই, হ্যাঁ লেখক হওয়া আসলে আমার প্যাশন না ! লেখালিখি কেন করতাম সেটা কোনদিনও জানতাম না, আজও জানি না ! তবে টপিক চেঞ্জ হয়ে গেছে ! 😛 প্রেমের গল্প লেখার মত ক্যালিবার আমার নেই, ঐটা আমার ডোমেইন না। কিন্তু যেহেতু অভ্রতে টাইপ করতে পারি সুতরাং লিখতে কি দোষ ! 😉 আর ঐ লেখালিখি অযথা হয় নাই, প্রতিটা ব্যাপার মানুষকে নতুন কিছু শেখায়, ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে, এখন এটা মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত সে কোনটা নেবে ভালোটা? নাকি খারাপটা।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকার ফেসবুক স্ট্যাটাস কোট করে এই লেখাটা শেষ করবো। Practice makes you perfect. So, be careful what you practice! ইচ্ছাকে প্যাশনে রুপান্তরিত করতে অনেক অনেক চেষ্টা তো করতেই হবে, অনেক বাঁধা তো ডিঙাতেই হবে কিন্তু শেষমেস ঐ এক কথা প্যাশন থাকুক কিংবা নাই থাকুক, ইচ্ছাগুলো সুন্দর হোক, ভালো হোক, ভালো কিছুর জন্য হোক।
“Practice makes you perfect. So, be careful what you practice!”
কথাটা আমি মনে রাখবো ভাইয়া 😛
এই ব্যাপারটা নিয়ে আমিও বেশ দ্বিধায় ছিলাম, এখন কিছুটা দূর হয়েছে 😀
লিখতে থাকো, যা ইছা লিখো। লেখার মধ্য দিয়ে নিজের সাথে যে বোঝাপড়াটা হয় সেটাই বা কম কিসে?
“লেখা কী আমার প্যাশন? তাহলে “অযথা” লেখালিখি করলাম কেন?”
“আমি তো প্রায়ই জঙ্গলে চলে যেতে চাই ! হায়রে ইচ্ছা !”
“প্রেমের গল্প লেখার মত ক্যালিবার আমার নেই, ঐটা আমার ডোমেইন না। কিন্তু যেহেতু অভ্রতে টাইপ করতে পারি সুতরাং লিখতে কি দোষ ! 😉 আর ঐ লেখালিখি অযথা হয় নাই, প্রতিটা ব্যাপার মানুষকে নতুন কিছু শেখায়, ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে, এখন এটা মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত সে কোনটা নেবে ভালোটা? নাকি খারাপটা।”
লেখাটি যখন পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার কথাগুলোই কেউ লিখে দিয়েছে। আমার মনে হয় কি, আমরা অনেকেই কম-বেশি এ ধরণের দ্বিধা বা কনফিউশনের মধ্যে বসবাস করি। আর শেষের কথাগুলো আমার অসম্ভব পছন্দ হয়েছে কারণ আমিও এটা বিশ্বাস করি:
“ইচ্ছাকে প্যাশনে রুপান্তরিত করতে অনেক অনেক চেষ্টা তো করতেই হবে, অনেক বাঁধা তো ডিঙাতেই হবে কিন্তু শেষমেস ঐ এক কথা প্যাশন থাকুক কিংবা নাই থাকুক, ইচ্ছাগুলো সুন্দর হোক, ভালো হোক, ভালো কিছুর জন্য হোক।”
প্যাশনের অনেক সংজ্ঞা থাকতে পারে। আমার কাছেও একটা সংজ্ঞা আছে। সেটা হল, প্যাশন জিনিসটা মানুষের বার্ডেন হয়ে যায় একসময়য়। অর্থাৎ তুমি কাজটা না করলে কষ্ট পেতে থাকবা, অস্থির লাগবে। লেখালেখি নিয়ে যদি এমন অনুভূতি কখনো হয়ে যাকে তোমার, তাহলে ধরে নিতে পারো, এইটাও তোমার একপ্রকার প্যাশনই।