অনাগত সন্তানের প্রতি

অনাগত সেই সন্তানের প্রতি,
যে এখন হয়ত মাতৃগর্ভে স্বপ্ন বুনছে পৃথিবীর আলোয় তার চোখ জুড়োবে বলে,

বড্ড ভয় হয় তোমার জন্যে। তুমি এখন যেখানে আছ, যেভাবে আছ – সেখান থেকে বর্তমানের এই পৃথিবীতে স্বাগত জানাবার কোন ইচ্ছে আমার মাঝে জাগে না। কিন্তু তবু তোমাকে আসতেই হবে, তুমি আসবেই। বাবা-মায়ের অসীম ভালোবাসার ফল হিসেবে অসীম এক শূন্যতা থেকেই ছোট্ট একটি জীবন বিন্দুর মত তোমার আবির্ভাব, মায়ের গর্ভে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছ তুমি। এখন তুমি মায়ের গর্ভে একটু একটু নাড়াচাড়া কর, ক’দিন বাদের পৃথিবীর রঙিন আলোয় চোখ রাঙ্গাবার কথা ভাব। কিন্তু তুমি হয়ত ঠিক জানই না, এই পৃথিবীর রঙিন আলো আসলে ঠিক কেমন! আমার ভয়, এই পৃথিবীতে এসে যখন তুমি দেখবে এর রং-রূপ মোটেও মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়ে তোমার স্বপ্নের মত নয়, যদি কখনো চিৎকার করে প্রশ্ন কর – ‘কেন আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এলে? কেন আমি আসবার আগেই আমাকে এই পৃথিবীর কথা বললে না? আমি তো এই পৃথিবীতে আসতে চাই নি!’

তুমি আসবার আগে তোমাকে এই পৃথিবীর কথা জানাবার সামর্থ্য আমার ছিল না। আমার কাছে তোমার এই প্রশ্নের কোন জবাবও নেই। তবু দোষটা আমারই, তোমার জন্যে তোমার স্বপ্নের মত করে এই পৃথিবীটা সাজিয়ে দিতে পারি নি।

আসতে যেহেতু তোমাকে হবেই, তাই আমি হয়ত তোমাকে স্বাগত জানাবো। যতক্ষণ পারি, তোমাকে এই পৃথিবীর সব কালো থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব, তোমাকে আনন্দে রাখবার। তবে আমি চাইব, এই আনন্দের দিনগুলোর মাঝে থাকতে থাকতেই তুমি জীবন যুদ্ধের জন্যে তৈরি হয়ে নেবে, নিজেকে প্রস্তুত করে নেবে ভবিষ্যতে নিজের আনন্দের নিজেই করে নেবার জন্যে। জেনে রেখো, এই পৃথিবীতে প্রতি বিন্দু আনন্দের জন্যে অনেক বেশী মূল্য দিতে হয়।

এই পৃথিবীতে তুমি যে রঙ দেখতে চেয়েছিলে, তার বদলে হয়ত অবিচার কাকে বলে তার ধারণা তুমি পাবে প্রতি পদক্ষেপে, পেতে বাধ্য হবে। ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীন, ধনী আর গরীব, শিক্ষিত আর অশিক্ষিত, সুশীল আর সাধারণ – এ শ্রেণীগুলোর মাঝে দ্বন্দ্ব সারাক্ষণের। আকাঙ্ক্ষার সব কিছু বা আকাঙ্ক্ষার চাইতেও বেশী আছে এক দলের আর আরেকদলের কিছুই নাই – এই দুই শ্রেণীর মাঝে একটা সম্পর্ক আছে। তুমি খুব অবাক হবে জেনে, তাদের মাঝেই এই সম্পর্ক হল অবিচারের সম্পর্ক।

তুমি দেখবে, একজন সুস্থ সবল মানুষ হয়ত আয়েশ করে বসে আছে আর আরেকজন অসুস্থ বৃদ্ধ লোক হয় তার কার্পেট পরিষ্কার করে দিচ্ছে, জুতো পালিশ করে দিচ্ছে।

তুমি হয়ত বিশ্বাস করতে পারবে না, প্রকৃতির বিভিন্ন মৌসুমও এখানে সামাজিক শ্রেণীবিভাগ নামে একটি তত্ত্বের কাছে বন্দি। এই যেমন ধর, শীত হল সচ্ছলদের খেলার মৌসুম। গরম জামা গায়ে দিয়ে তারা ব্যাডমিন্টন খেলে, কফির মগ হাতে নিয়ে টিভি দেখতে দেখতে অলস সময় কাটায়। আর গরীব যারা, যাদের হয়ত দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতেই শরীরের সর্বশক্তি ব্যয় করে, তারা সারারাত শীতে ঠকঠক করে কাঁপে। কেউ কেউ এতটা বৈষম্য সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীতে বিদায়ও জানাতে বাধ্য হয়।
বুকে হাত দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, সত্যিকারের তোমার স্বপ্নের মত সাম্য আছে কেবল তুমি এখন যেখানে আছ, সেখানেই। আর কপাল খুব বেশী ভালো হলে হয়ত জন্মের পর অল্প কিছুদিন একটা কৃত্রিম সাম্য দেখতে পাবে তুমি। তারপর এক ফোঁটা দুধের জন্যেও তোমাকে কাঠখড় পোহাতে হবে, সামান্য এক টুকরো চকলেট খেতে হলেও হয়ত তোমাকে বুকভাঙ্গা কষ্ট সইতে হতে পারে।

কেন এই অবিচার সইতে হবে তোমাকে, জান? কারণ, তুমি হয়ত সব আছে যাদের, তাদের কারো সন্তান হয়ে জন্ম নিচ্ছ না! যদিও কাদের সন্তান হিসেবে তুমি জন্ম নিচ্ছ, তাতে তোমার কোন হাত ছিল না। কিন্তু কিছুই করার নেই, তোমাকে এটা সইতেই হবে।

এই পৃথিবীতে আরও একটা দল আছে। এদের আকাঙ্ক্ষার কিছু কিছু জিনিস থাকে, আর কিছু কিছু জিনিস থাকে না। সমাজ আদর করে এদের ডাকে মধ্যবিত্ত। আদর করে এমন একটা নাম দিলেও সত্যিকার অর্থে এদের জীবনটা আরও কঠিন। এরা না পারে ‘কিছু নেই’দের মত করে রাস্তায় বাঁচতে, না পারে ‘সব আছে’দের মত করে বিশাল প্রাসাদে জীবন যাপন করতে। ‘আত্মসম্মান’ নামের একটা অদৃশ্য আবরণে এরা নিজেদের মুড়িয়ে রাখে সবসময়। এরা কখনও সুবিচার পায় না, কখনও অবিচারিতও হয় না। নার্ভের উপর দিয়ে একটা দুঃসহ চাপ বয়ে নিয়ে চলে আজীবন।

যদি তোমার জন্ম এই দলের কোন দম্পতির কাছে হয়, তবে বলব, তোমার কপালটা আরও বেশী মন্দ। তুমি কিছুই না পেয়েও পাবার মোহের পেছন ছুটতে থাকবে! জীবনটা মিথ্যে একতা আবরণে আবৃত করে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় কেটে যাবে তোমার পৃথিবীর দিনগুলো।

যেখানেই জন্মাও তুমি, পৃথিবীর যে রঙ দেখার স্বপ্নকে পুঁজি করে প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে এই পৃথিবীতে আসছ তুমি, তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে না। তোমাকে পদে পদে আঘাত সইতে হবে, সেই আঘাতে ক্ষত হোক বা না হোক, ক্ষত হলে সেই ক্ষত তুমি দেখতে পাও বা না পাও–

জীবন ধারাবাহিক। জীবনের কোন মৃত্যু নেই। মৃত্যু আছে শরীরের। পৃথিবী এই শরীরকে মনে রাখে না, মনে রাখে জীবনকে। তাই জীবন হতে চেষ্টা করো, তোমাকে এইটুকুই বলে যাই। যে কাজ করো, জীবনের মত করে করতে চেষ্টা করো। যাকে ভালোবাসো, তাকে জীবনের মত করে ভালোবেসে যাবার চেষ্টা করো। অসংখ্য নেতিবাচকতার মাঝেও ইতিবাচকতা খুঁজে নিয়ে তাকে আকঁড়ে ধরে, তাকে বড় করে তুলতে পারাই জীবন। ইতিবাচকতাকে আঁকড়ে ধরতে হয় কীভাবে, সেটা তুমি নিজেই শিখে নিতে পারবে।

শুভকামনা তোমার জন্যে,
এই পৃথিবী থেকে একজন

অনুজ সম্পর্কে

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে গেলে হয়ত লিখতে হবে - প্রথমত আমি রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ, দ্বিতীয়ত চিরন্তন সত্য, মৃত্যুর সাথে করি বসবাস... https://www.facebook.com/CoercedAnuj
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to অনাগত সন্তানের প্রতি

  1. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে
    সুন্দর লিখা 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।