শরীরে বন্দী মন

আমার ছোট্ট একটা বোন আছে— বিভা। আমার বোন আমার চোখে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বোন। বিভার থেকে ৮ বছরের বড়ো হওয়ায় তার প্রতি আমার কিছুটা অভিভাবক সুলভ আচরণ চলে আসে। একটা সুন্দর পৃথিবীর সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার তাগিদ অনুভব করি সবসময়। আমার বোন অনেক সুন্দর। তার গায়ের রঙ কালো। দুজনে একসাথে টিভি দেখার সময় যখন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়— ‘শুধু ফর্সা ত্বক যথেষ্ট নয়’, বিভা খুব বিরক্ত হওয়ার মুখভঙ্গি করে, মাঝে মাঝে বিরক্তিও প্রকাশ করে ফেলে, তখন আমি খুব অসহায় বোধ করি, কী বলবো বুঝতে পারি না। আমাদের সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এমনভাবে ছকে বেঁধে গেছে যে ছক অনুযায়ী যে মেয়েটি সবচেয়ে সুন্দর, তাকেও কখনো না কখনো অসহায় বোধ করতে হয়, অপমানিত হতে হয় এবং প্রতিনিয়ত সৌন্দর্যের পরীক্ষা দিতে হয়।

বিজ্ঞাপনের কাজ হওয়া উচিত ছিলো জনসাধারণকে পণ্যের গুনাগুণ বর্ণনা করে পণ্য কিনতে উৎসাহিত করা। সেক্ষেত্রে পণ্যের সঠিক গুনাগুণ বর্ণনা করা জরুরি। আমরা খেয়াল করলে দেখবো আমাদের বিজ্ঞাপনগুলো যেভাবে নির্মাণ করা হয়, তার একটা বিশাল অংশ জুড়ে থাকে অতিরঞ্জন। আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলোতে যে বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার করা হয়, তার নিজস্ব একটা ভাষা আছে, সবার কাছে একটা মেসেজ খুব দ্রুত পৌঁছানো যায়। একটা দেশের বিজ্ঞাপন সেই দেশের সংস্কৃতি রিপ্রেজেন্ট করে। আমরা গুরুত্ব দেই আর না দেই, আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলো যে সকল বিজ্ঞাপন প্রচার করে আমাদের সংস্কৃতিতে তার বেশ গভীর প্রভাব রয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন অনেক সময় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। বলে নিচ্ছি— আমার এই লেখার উদ্দেশ্য বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা নয়। পণ্যের প্রচারের খাতিরে বিজ্ঞাপন অপরিহার্য। কিন্তু বিজ্ঞাপনে পণ্যকে মহিমান্বিত করার জন্যে আমরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা একধরণের প্রতারনা।

খেয়াল করলে দেখবো— বিজ্ঞাপন যে পণ্যেরই হোক না কেনো বিজ্ঞাপনের থিম সবসময় নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা থাকে। যেমন- সুখ, তারুণ্য, সাফল্য, আরাম-আয়েশ, ফ্যাশন, সৌন্দর্য, যোগ্যতা, সমৃদ্ধি ইত্যাদি। সামাজিক সমস্যার সাথে পণ্যকে বিজ্ঞাপনে এমন ভাবে সম্পর্কিত করা হয় যেন আমরা মনে করতে থাকি নির্দিষ্ট পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমেই আমাদের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। অর্থাৎ সকল সমস্যার সমাধান ভোগবাদে। টেলিভিশনে কোনো অনুষ্ঠান দেখার মাঝে বিজ্ঞাপন বিরতিতে বিরক্ত হয় না এরকম মানুষ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ছোট্ট শিশুরা বেশ মনোযোগ দিয়েই বিজ্ঞাপনগুলো দেখে। বিজ্ঞাপনের চটপটে ভাষা আর মিউজিক তাদের আকর্ষণ করে বেশি। একই বিজ্ঞাপন বারবার দেখতে দেখতে সেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটা ভিত্তিহীন বিশ্বাসও মাথার মধ্যে গেঁথে যায়। এভাবে খুব ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের নির্দিষ্ট ধারায় চিন্তা করতে বাধ্য করে। একদিন দুইদিন তিনদিন পর্যন্ত হয়তো ‘সৌন্দর্যই শক্তি’ মেসেজ বিশিষ্ট কোনো বিজ্ঞাপনের দোষ আমাদের কাছে ধরা পড়ে না। একসময় যখন নিজের অজান্তেই আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করতে থাকি সৌন্দর্যই শক্তি এবং আমাদের চিন্তায় এই সৌন্দর্য যখন কেবল গায়ের ফর্সা রঙকে রিপ্রেজেন্ট করতে শুরু করে, তখন সৌন্দর্য শব্দটার প্রতি এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দায় অনেকটাই বিজ্ঞাপনের। এভাবেই বিজ্ঞাপনগুলো নির্দিষ্ট করে দেয় আমাদের মূল্যবোধ এবং চিন্তাশক্তি। আমাদের স্মার্টনেসের সংজ্ঞা এরা বেঁধে দিয়েছে নির্দিষ্ট স্মার্টফোন ব্যবহারে, আবেদনময় পোশাকে, বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে অল্প সময়ে পটানোর ক্ষমতায়। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বিভিন্ন প্রোডাক্টে, যে যতো প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে পারছে, সে ততো সুখি। তাই তো পানীয়র বিজ্ঞাপনেও বলা হয়— ‘আজ কি খুলেছো খুশির জোয়ার?’!

আলোচনা করতে চাইছিলাম আমাদের ছকে বাঁধা সৌন্দর্য নিয়ে। বিজ্ঞাপন নিয়েও অনেক কথা এসে গেলো। আমাদের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এই ব্যাপারগুলো এমনভাবে জুড়ে গেছে যে একটা বাদ দিয়ে অন্যটা আলোচনা করা সম্ভব না। আমি বিশ্বাস করি কোনো মানুষই অসুন্দর নয়, সবাই সুন্দর। সৌন্দর্য পরিমাপের যে একক আমরা তৈরি করেছি তা সম্পূর্ণ অলীক। একজন মানুষের সাদা রঙকে কিসের ভিত্তিতে অন্য একজন মানুষের কালো রঙের উপর প্রাধান্য দিতে হবে? একজন লম্বা মানুষকে কেনো একজন খাটো মানুষের উপর প্রাধান্য দিতে হবে? একজন শুকনো মানুষকে কেনো একজন মোটা মানুষের তুলনায় বেশি সুন্দর বলতে হবে? কেনো দীঘল রেশমি চুলের মেয়েটিকে কোঁকড়ানো ঢেউ খেলে যাওয়া চুলের মেয়েটির চেয়ে সুন্দর ভাবতে হবে? দুজনকেই সুন্দর মানতে বাঁধা কোথায়? বৈচিত্র্যই সুন্দর, একইরকম কোনো মাপকাঠিতে সৌন্দর্যকে পরিমাপ করা অসম্ভব। সবচেয়ে ফর্সা মেয়েটিও কি বিজ্ঞাপনে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা একজন মডেলের মতো নিখুঁত হতে পারে? আমরা কেউ নিখুঁত নই, কখনো হতেও পারবো না, হওয়ার প্রয়োজনও নেই। সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে ধ্যানে ও জ্ঞানে, মেধা ও মননে প্রতিযোগিতা না করে আমরা যখন চেষ্টা করতে থাকি আরেকটু ফর্সা হতে, তথাকথিত ফিগার পেতে আর শরীরী সৌন্দর্য দিয়ে সবকিছু জয় করতে, তখন কি আমাদের এই অসাধারণ মানব জন্মের অপমান হয় না? বিজ্ঞাপনে যখন বলা হয় ‘সৌন্দর্যই শক্তি’, এবং সৌন্দর্য হিসেবে যখন নিখুঁত সাদা গায়ের রঙকে উপস্থাপন করা হয়, তখন আমাদের মানবাধিকার লজ্জায় অপমানে নুয়ে পড়ে। এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রতিনিয়ত অপমান করছে সেই সব মানুষকে, যারা সৌন্দর্যের এই ভিত্তিহীন ছকের ছাঁচে গড়া নয়। শুধু নারীদের কথা বললে ভুল হবে কারণ পুরুষের সৌন্দর্যও একটি নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে দেয়া হয়েছে। সুঠাম দেহ আর পেশীবহুল বাহুতে নিলাম হয়ে গেছে পুরুষত্বের স্বত্ব।

আমি নারীবাদী নই। আমি সকল মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসি। এমন সমাজের স্বপ্ন দেখি যেখানে সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় মানুষ সুন্দর শরীরের নয়, বরং একটি সুন্দর মনের মানুষ খুঁজবে। ভুল সিস্টেমে বাঁধা পড়ে গেছে আমাদের সমাজ। সভ্যতা ও আধুনিকতার নামে নিলাম হয়ে যাচ্ছে আমাদের অধিকার। একটা আফটার শেভিং লোশন, রেজর, কিংবা ছেলেদের শ্যাম্পু আর পারফিউমের বিজ্ঞাপনেও যখন ক্রেতা আকৃষ্ট করতে অর্ধনগ্ন নারীদের ব্যবহার করা হয় এবং তাকে নারী স্বাধীনতা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন এমন নারী স্বাধীনতাকে সমর্থন করা আমাদের পুরো মানব জাতির অপমান বলেই মনে করতে হবে। কারণ এধরণের বিজ্ঞাপন নারীদেরও ‘পণ্য’ ভাবতে বাধ্য করে। তাই আমার বেশ কিছু শিক্ষিত বন্ধু যখন নারীদের সস্তা ভোগের বস্তু বলে মনে করে, তখন দোষটা পুরোটাই তাদের চিন্তার সংকীর্ণতার উপর চাপানোর পূর্বে আমি মেনে নিতে বাধ্য হই— তাদের এই চিন্তাধারা আমাদের পুঁজিবাদী সমাজেরই সাফল্য।

কলড্রপ আমাদের সম্পর্কের জন্যে ক্ষতিকর কিনা তা আমার জানা নেই। এটুকু বলতে পারি— ‘সত্যি করে বলবা কিন্তু, আমি কি তোমার ফার্স্ট লাভ?’ কিংবা ‘তুমি একটা এডুকেটেড ছেলে আর মোবাইলে নিজের বিকাশ একাউন্ট নেই!’ অথবা ‘শুধু ফর্সা ত্বক? যথেষ্ট নয়!’ এই ধরনের বিজ্ঞাপন আমাদের সংস্কৃতির জন্যে, আমাদের তরুণ সমাজের জন্যে এবং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর! আমাদের জন্যে পণ্য, পণ্যের জন্যে আমরা নই। পণ্যের বিজ্ঞাপনে প্রতিনিয়ত আমাদের যেভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা রুখে দিতে হবে এখনই। আমাদের সমাজে অসংখ্য ‘আইটেম গার্ল’ এর প্রয়োজন নেই। এগিয়ে যেতে হলে আমাদের প্রয়োজন মুক্তচিন্তায় উদ্ভাসিত শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত নারীদের। নির্দিষ্ট ফিগারের লম্বা ফর্সা পণ্যদাস মডেল নয়, এইসব নারীরাই হবে নারী সমাজের সত্যিকার মডেল এবং সামনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা। আমি আশাবাদী মানুষ। ২০১৫ সালের শুরুতে দাঁড়িয়ে আশা করছি আমরাই পারবো আমাদের এই জরাজীর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকে একটা সুস্থ সুন্দর রুপ দিতে। আমাদের নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়া সফল হোক। আসুন, আমাদের শরীরে বন্দী মনকে মুক্ত করি। মনকে সুন্দর করতে শুরু করার চর্চার মাধ্যমে সত্যিকার সৌন্দর্যের দিকে এগিয়ে যাই। শরীরে এন্টি এইজিং ক্রিম মাখার বদলে, মেধা ও মননে এন্টি এইজিং চিন্তা ও কাজের প্রলেপ লাগানোর এখনি সময়। 🙂

ফারাহ্‌ মাহমুদ সম্পর্কে

অবিদিত, জানো কি? বুকের মধ্যে জল তরঙ্গ নিয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া পাপ! অবিদিত, জানো কি? অনুরাগ এক প্রকার সুখকর বিভ্রান্তি..
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to শরীরে বন্দী মন

  1. মুনীরা মারদিয়া বলেছেনঃ

    ক্যাপিটালিজমের প্রভাব। বিজ্ঞাপনে তাই দেখাবে, যা মানুষকে আকর্ষণ করতে পারবে সবচেয়ে বেশী। এতে পন্যের মার্কেটিং ভাল হবে। তাই এই ধরণের বিজ্ঞাপন কমবে না, বরং দিনে দিনে আরো বাড়বে। যেহেতু আমাদের দেশে কোন বিজ্ঞাপন নীতিমালা নাই, তাই বিলবোর্ড বলুন, আর টেলিভিশন বলুন, সবখানেই এগুলো চলতেই থাকবে, বাড়তেও থাকবে। এইসব দেখতে দেখতে আজকাল একদম নিরাশাবাদী হয়ে গেছি। 🙁

  2. saifulmasud বলেছেনঃ

    একটা আফটার শেভিং লোশন, রেজর, কিংবা ছেলেদের শ্যাম্পু আর পারফিউমের বিজ্ঞাপনেও যখন ক্রেতা আকৃষ্ট করতে অর্ধনগ্ন নারীদের ব্যবহার করা হয় এবং তাকে নারী স্বাধীনতা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন এমন নারী স্বাধীনতাকে সমর্থন করা আমাদের পুরো মানব জাতির অপমান বলেই মনে করতে হবে। 😳
    আপু সত্যিই অসাধারণ

  3. পাহাড়ি কন্যা বলেছেনঃ

    আমরা যারা কাল বা শ্যামলা তারাই কেবল বুঝি কতটা কটূক্তি সহ্য করতে হয়। মুরুব্বি মানুষরা দেখলে প্রথমেই কমেন্ট করেন, ‘আহারে মেয়েটা কাল। কেমনে বিয়ে হবে?’, ‘মেয়েটার দাঁত কেমন যেন!’, ‘আহারে মেয়েটা মায়ের মত সুন্দরী হয় নাই’। কেউ একবারও জানতে চায় মেয়েটা কি চাকরি করছে, পড়াশুনায় কেমন, কি গুণ আছে। যেন ফর্সা ত্বক দিয়েই মেয়েটাকে বিচার করা যায়। আর বড় হওয়ার সাথে সাথে এই ব্যাপারগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করে। মায়েরা নিজেরাই তখন বলে, ‘বাইরে বেরুচ্ছ? একটু পাউডার দিয়ে যাও।’ আমারই একটা ফ্রেন্ড আছে, দারুণ সুন্দরী, মিষ্টি চেহারা কিন্তু শ্যামলা। ও আমাকে বলছিল, ‘পার্লারে কোন ফেসিয়াল করলে সাদা হওয়া যায়?’ অথচ ও বুঝে না ওরকম সাদা ক্যাসপার ভূত সাজলে মানুষকে কতটা বিশ্রী দেখায়! বিশেষ করে বিয়ে বাড়িতে এটা হারেহারে টের পাওয়া যায়!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।