ম্যাডাম কুরী, বিজ্ঞানের জন্য শহীদ এক মহীয়সী নারী

(ইদানিং শীত পড়া শুরু হয়েছে। রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে চাদর টানতে হয়। রাতের অন্ধকারে দেয়াল ঘড়িটা চকচক করতে থাকে সবুজ আভায়। এই সবুজ জিংক সালফাইডের আলো মনে করিয়ে দেয় এক মহামূল্যবান তেজস্ক্রিয় পদার্থের কথা। রেডিয়াম। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার এই রেডিয়াম অথবা আরও জেনেরালী বললে তেজস্ক্রিয়তা। আধুনিক বিজ্ঞানের এত যে সাফল্য, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সবকিছু দাঁড়িয়ে আছে এই একটা আবিষ্কারের উপর। আর তেজস্ক্রিয়তার এই মহান আবিষ্কারের সাথে যার নাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে আছে তিনি একজন নারী বিজ্ঞানী মাদাম কুরী।)
মাদাম কুরী প্রথমে একজন বিজ্ঞানী, তারপর একজন নারী- নাকি, প্রথমে নারী তারপর বিজ্ঞানী বলা কঠিন। বিজ্ঞানের জগতে তার অবদান বিচার করলে তাকে আইনস্টাইনের পাশাপাশি স্থান দেয়া যায়।জীবন তার বিজ্ঞানের গবেষণায়। তারপরও মানুষ হিসাবে, বিশেষ করে পুরনো পৃথিবীর একজন নারী হিসেবে তার জীবন কাহিনী রূপকথাকেও হার মানায়।
জন্ম এক পরাধীন দেশে।পোল্যান্ড তখন রাশিয়ার দখলে।ভাষাগত আর অর্থগত অর্থেই শোষিত জাতি তখন পোলিশরা। এমনি এক সময়ে, ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর, পোল্যান্ডের রাজধানী ভার্সাভা (Warsaw)তে  জন্ম নেন তিনি। নাম রাখা হয় “মারি স্কদ্ভস্কা”(Marie Sklodowska)। পদার্থবিদ্যা আর গণিতের প্রফেসর পিতা ভাদিসভ স্কদ্ভস্কি( Władysław Skłodowski ) আর পিয়ানোবাদক আর গায়িকা স্কুল-টিচার মা ব্রনিসভা (Bronisława) তার পাঁচ সন্তানকে নিয়ে গড়েছিলেন ছোট্ট সংসার। মারিয়া ছিলো সবার ছোট। শিক্ষিত পরিবার কিন্তু পরাধীনতার শৃঙ্খলে পড়ে অর্থের টা্নাটানিতে।রাশিয়ানদের শোষণে তার বাবা মা চাকরি হারান। মা শুরু করেন মেয়েদের বোর্ডিং। তারপরও ছোট মারিয়া তার ভাই বোনদের সাথে আর তার বাবার গবেষণার টেস্টটিউব নিয়ে খেলতে খেলতে বড় হতে থাকে। মারিয়া ছিলো ছোট্ট থেকেই বেশ লক্ষ্মী ও মনোযোগী ছাত্রী।  কিন্তু আর্থিক অনটনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে, ছোট্ট নয় বছরের  মারিয়া,  তার বড় বোন সোফিয়াকে (জন্ম ১৮৬২) হারায় টাইফাস রোগে। তার চেয়েও বড় আঘাত আসে যখন মা যক্ষ্মায় মারা যান দু বছর পর। কথিত আছে, মায়ের দুঃখ ভুলার জন্য  মারিয়া তার বোনদের সাথে ডাক্তার ডাক্তার খেলতো। আর ভাব করত খুব জটিল রোগের সমাধান পেয়ে গেছে তারা। কে জানত, এই ছোট্ট মারিয়া একদিন সারা পৃথিবীর লোকদের চিকিৎসায় অবিস্মরণীয় পরিবর্তন এনে দেবে?
মায়ের মৃত্যুতে শোকাহত সেজো বোন ব্রনিসোভা (১৮৬৫) আর মারিয়া ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর্থিক অনটনে তারা চুক্তি করেন যে, বড়জন যখন পড়াশোনা করবেন ছোটজন খরচ চালাবে। আর তার পড়াশুনা শেষ হলে বড়জন চালাবে ছোটজনের খরচ।
ব্রনিসোভার দুবছরের প্যারিসে মেডিক্যাল পড়াশুনার খরচ চালাতে মারিয়া ক্রাকোভ, সিসেনভ বিভিন্ন শহরে গভর্নেসের কাজ নেন।
উল্লেখ্য, তখন পরাধীন পোল্যান্ডে মেয়েদের  উচ্চশিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু মারিয়া ভেতরে ভেতরে “ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ” একাধারে শিক্ষাগ্রহণ ও পাঠদান করতে থাকেন।আর এ সময়েই তার কাজিন জোসেফ এর সহায়তায়  ও উৎসাহে , “ভার্সাভা কৃষি-শিল্প যাদুঘর” এর গবেষণাগারে পদার্থবিদ্যা আর রসায়নবিদ্যায় পারদর্শী হতে থাকেন মারিয়া ।  এটা চলতে থাকে ১৮৯১ পর্যন্ত। পৃথিবী তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে এক  বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের, নিউটন গ্যালিলিওর  সরল  বিশ্বকে জটিল মৌলিক বলের আর পরমাণুর বিশ্বে পরিণত করার গবেষণা চলছে পুরোদমে। আর এদিকে প্রস্তুত হচ্ছেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর এক মহানায়িকা মারিয়া স্কদ্ভস্কা।

১৮৯১ এ মারিয়ার নারী হৃদয় অবলোকন করে এক বিদারক পরিণতি। তার প্রথম প্রেমিক(যিনি একজন ভবিষ্যত গণিতবিদ) পারিবারিক কারণে গরিব মারিয়াকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। ভগ্নহৃদয় মারিয়া পাড়ি জমান জ্ঞান রাজ্য প্যারিসে। ছোটবেলা থেকে আঘাতের পর আঘাত পাওয়া মারিয়া এবার পুরো হৃদয় ঢেলে দেন বিজ্ঞান চর্চায়। দিনে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর রাতে টিউশনি করে দুই বছরেই পদার্থবিজ্ঞানে আর দু বছরেই গণিতে ডিগ্রী নিয়ে নেন তিনি।
ও বছরই, বিভিন্ন স্টিলের চৌম্বক ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে  তার পরিচয় হয় পদার্থ আর রসায়নের ইন্সট্রাক্টর পিয়েরে কুরীর সাথে। তাদের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মারিয়ার দেশে ফিরে যাবার স্বপ্ন। ভালবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের পথে পা বাড়ান মারিয়া।

কিন্তু দেশ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল। ভার্সাভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আবেদন শুধুমাত্র মেয়ে বলে পাত্তা পেল না। আবার হৃদয় ভাঙ্গল এই নারীর। নিজ ভালবাসা পিয়েরে কুরীর কাছে ফিরে যান মারিয়া। প্যারিসে, ২৬জুলাই ১৮৯৫ সালে বিয়ে হয় দুজনার। শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিজ্ঞান-দানবীয়-যুগলের একসাথে পথচলা। মারিয়া নাম নিলেন মারিয়া স্কদ্ভস্কি কুরী। ভালবাসায় আর আনন্দে শুরু হলো তাদের একটানা গবেষণা জীবন।  নাওয়া খাওয়া ভুলে শুরু করলেন জ্ঞান সাধনা। বাইরে যাবার মধ্যে ছিল মাঝেমধ্যে সাইকেলে দুজনের গ্রামখানি ঘুরে আসা। তারপর গবেষণা আর গবেষণা। সময়ের অভাবে পাউরুটি আর কফি দিয়েই খাওয়া সারতেন অনেক সময়। বিজ্ঞানের জন্য এমন পারিবারিক আত্মত্যাগ আসলেই আর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

তাদের বিয়ের বছরেই জার্মান পদার্থবিদ ড. ভেলহাম রঞ্জেন আবিষ্কার করেন আশ্চর্যজনক রশ্মি ‘এক্সরে’. চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব এনে দেয়া এ আবিষ্কার নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। পরের বছর ১৮৯৬ তে ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী হেনরী বেকরেল ইউরেনিয়াম সল্টের মধ্যে এক্স রের মত পদার্থভেদী রশ্মির অস্তিত্ব দেখতে পান। তিনি আরো আবিষ্কার করেন, ইউরেনিয়ামের  আলোকিতকরণ অথবা বিকিরণ ক্ষমতা  বাইরের কোন শক্তির উপর নির্ভর করে না। ইউরেনিয়াম লবণ থেকে এটা নিজে নিজেই বের হয়। তিনি এ গুণের নাম দেন রেডিওএকটিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা। বেকরেলকে তাই তেজস্ক্রিয়তার জনক বলা হয়।

তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হলেও এর প্রকৃতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা তখনো ছিল অজানা। স্বামীর পরামর্শে স্কদ্ভস্কা কুরী ইউরেনিয়াম রশ্মির উপর গবেষণাকেই নিজের থিসিস হিসাবে গ্রহণ করলেন। স্বামী পিয়েরে কুরী তার ভাইকে সাথে নিয়ে পনের বছর আগে তড়িত চার্জ মাপার যন্ত্র ইলেক্ট্রোমিটার আবিষ্কার করেছিলেন। মারিয়া, ইউরেনিয়াম খনিজের মধ্যে তড়িত চার্জের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা চালালেন। তিনি আবিষ্কার করলেন, খনিজের চারপাশে চার্জের অস্তিত্ব আছে। এবং এই চার্জের পরিমাণ কেবল খনিজে ইউরেনিয়াম পরমাণুর পরিমাণের উপর নির্ভর করে। বিস্তর গবেষণা করে মারিয়া কুরী  এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, ইউরেনিয়াম খনিজে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে এ বিকিরণ হচ্ছে না। বরং তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম পরমাণুরই নিজস্ব ধর্ম। তেজস্ক্রিয়তার গবেষণায় এটা ছিল এক বিরাট আবিষ্কার। ভবিষ্যৎ আধুনিক পদার্থবিদ্যার দরোজা এ আবিষ্কারই খুলে দিয়েছিল। পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে যে মৌলিক কণার সৃষ্টি ধ্বংসলীলা এ আবিষ্কারই এনে দিয়েছিল মানুষের সামনে।এটি ছিল তার প্রথম মৌলিক (স্বামীর সাহায্য ছাড়াই ) আবিষ্কার আর একজন নারী হিসাবে  বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি অতুলনীয় ।

এই মহাআবিষ্কারের পর মারিয়ার উৎসাহ বেড়ে গেল বহুগুণে। শুরু করলেন মহা গবেষণা। আরো আরো ইউরেনিয়াম লবণ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। পীচব্ল্যান্ড (ইউরোনাইট) আর টোরবারনাইটের তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপ করতে গিয়ে অস্তিত্ব টের পেলেন আরো শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় মৌলের। মারিয়ার এ আবিষ্কারে আকৃষ্ট হয়ে পিয়েরে কুরী, তার নিজ গবেষণা বন্ধ করে, তার স্ত্রীর সাথে গবেষণা শুরু করলেন।নতুন মৌলের পরিমাণে অতি অতি অল্প বলে প্রচুর খনিজ পরিশোধন করার প্রয়োজন পড়ল। স্কুল ল্যাবরেটরিতে আর সম্ভব হল না। তাদের ঘরের বিপরীতে পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউজে যাত্রা শুরু করল তাদের চরম গবেষণাগার। কিন্তু  এত যে পরিশ্রম, পারিশ্রমিক কিন্তু নেই বললেই চলে। পয়সার অভাবে বারবার বন্ধ হতে চেয়েছে।কিন্তু তাও বন্ধ হতে দেননি দম্পতি। এর মাঝে ১৮৯৭ সেপ্টেম্বর এ জন্ম নেয় তাদের প্রথম কন্যা  আইরিন কুরী। বিজ্ঞানী মা বাবার কোলে বড় হতে থাকে আরেক বিজ্ঞানী।

দিনের পর দিন গবেষণার পর কুরী দম্পতি আবিষ্কার করেন নতুন শক্তিশালী পরমাণু। মারিয়া নাম দেন তার নিজ দেশের নামে “পোলোনিয়াম”(জুলাই ১৮৯৮) . পরাধীন তার দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন এই নাম দিয়ে। কিছুদিন পরেই আবিষ্কার করেন সবচেয়ে শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় পদার্থ ‘রেডিয়াম’(ডিসেম্বর ১৮৯৮).কিন্তু এই রেডিয়াম আলাদা করার কোন প্রক্রিয়া জানা ছিল না তাদের। মারিয়া গবেষণা করতে থাকেন রেডিয়াম পরিশোধনের জন্য। টনের পর টন পীচব্ল্যান্ড পরিশোধন করতে হয়েছে ভাঙ্গাচোরা ঘরটাতে। বিজ্ঞানের জন্য পবিত্র কসাইখানা বেথেলহামের সাথে তুলনা করা হয় তাদের এই গবেষণাগারটাকে। অবশেষে বছরের পর বছর গবেষণায় ০.১গ্রাম রেডিয়াম আলাদা করতে সক্ষম হন তারা (১৯০২).প্রমাণিত হয় রেডিয়ামের অস্তিত্ব। ড. হেনরী বেকরেলের সুপারভিশনে ১৯০৩ সালে মারিয়া প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব সাইন্স (আজকের পি এইচ ডি) ডিগ্রী লাভ করলেন।

একই বছরে আসল সবচেয়ে সম্মান জনক স্বীকৃতি। হেনরী বেকরেলের সাথে সাথে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হলেন কুরী দম্পতি। মাত্র ৩৬বছর বয়সে মৌলিক গবেষণা করে নো্বেল পেলেন মারিয়া। সাথে আসল মোটা অংকের প্রাইজমানি। শুরু হলো তাদের গবেষণার নতুন দিগন্ত। পরের বছর জন্ম নিল তাদের দ্বিতীয় কন্যা ইভ কুরী।

ভাল অংকের টাকা ছিল নোবেল থেকে। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে তারা পুরো টাকাটাই খরচ করলেন গবেষণায়। সচ্ছলতা আসল। আসলো খ্যাতি। কিন্তু অন্য দিক থেকে প্রচন্ড ক্ষতির সম্মুখিন হলেন তারা। মানব দেহের উপর  তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তখনো ছিল অজানা। পুরো অসতর্ক পরিবেশে তারা গবেষণা চালিয়েছেন তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে। পকেটে নিয়ে  ঘুরতেন। এমনকি, রাতে বিছানায় পাশে রেখে ঘুমাতেন। নিজের সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালবেসেছেন যে বস্তুকে, সেগুলোই ভিতরে ভিতরে তাদের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দিচ্ছিল। প্রথম আঘাতটা আসল পিয়েরে কুরীর উপর। ১৯এপ্রিল, ১৯০৬ এ রাস্তা পার হতে গিয়ে ঘোড়াগাড়ির নীচে পড়ে মারা গেলেন তিনি, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে।। ধারনা করা হয়, তেজস্ত্রিয়তার ক্ষতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়ায় সময় মত সরে দাঁড়াতে না পারায়  এ দুভাগ্য বরণ করতে হয় তাকে। একা হয়ে পড়লেন মারিয়া। বিয়ের মাত্র ১১ বছরের মাথায় স্বামী হারালেন। সাথে হারালেন নিজের সবচেয়ে বড় গবেষণা সহায়ক কে।

দুঃখের সাথে কিছু সুখবর এল। পিয়েরে কুরীর শূন্য পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পদে নিয়োগ পেলেন মারিয়া। নোবেল বিজয়ী মারিয়া হলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী প্রফেসর। দুই কন্যা সন্তানকে বড় করতে লাগলেন মাতৃ আদরে। সাথে সাথে চালাতে লাগলেন গবেষণা। এবার তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর পারমাণবিক গুণাবলী নিয়ে চালালেন মৌলিক গবেষণা।
কিন্তু নারী হওয়ায় সমাজের বাকিরা তার বিরুদ্ধে লেগেই ছিল। তার গবেষণা সহকারী পাঁচ বছরের ছোট একজন ছাত্রের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের গুজব রটালো তার পুরুষ কলিগরা। আর সামাজিক ভাবে হেয় হলেন অনেক। কিন্তু পাত্তা দিলেন না মারিয়া। গবেষণার কাজ চালিয়ে রসায়নবিদ্যায় নোবেল জিতে নিলেন তিনি। ১৯১১ সালের এই নোবেল ছিল পুরোটাই নিজের। প্রথম দুই নোবেলের অধিকারী হলেন তিনি। এখনো বিজ্ঞানের দুটো ভিন্ন শাখায় একমাত্র নোবেল বিজয়ী হয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন।

এখানেই শেষ নয়। বরং শুরু। নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকা খরচ করলেন রেডিয়াম কিনতে। ১ গ্রাম রেডিয়ামের দাম  তখন এক লক্ষ ডলার। এই রেডিয়াম দিয়ে উন্মুক্ত হলো আরো গবেষণার সুযোগ। তার মেয়ে আইরিন সহ অন্য ছাত্রদের নিয়ে চালাতে লাগলেন কাজ। সরকারের অনুমোদন নিয়ে ১৯১৪ তে গড়ে তুললেন ফরাসী রেডিয়াম ইন্সটিটিউট। এই ইন্সটিটিউট থেকে ভবিষ্যতে নোবেল বিজয় করেন তার মেয়ে আইরিন আর তার মেয়ে জামাই। একই পরিবারে চারজনের নোবেল বিজয়ে রেকর্ড হয়ে আছে আজো।
কিন্তু ততদিনে কিডনী সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছেন ভালভাবেই । তারপরও জ্ঞান সাধনা থেমে থাকেনি।

এর পরপরই ইউরোপ জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। শত শত আহত সৈন্যের প্রয়োজন হয় উন্নত চিকিৎসার। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক্সরের ব্যবহার তখনো অপ্রচলিত। অসুস্থ শরীর নিয়েও বসে থাকেননি এই বিজ্ঞানী । বন্ধ করে দেন নিজের প্রাণপ্রিয় গবেষণাগার। গাড়ির উপর রেডিয়াম চালিত এক্সরে যন্ত্রপাতি বসিয়ে তৈরী করেন মোবাইল এক্সরে ইউনিট। নিজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছুটে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। তার চেয়ে বড় হলো, নিজের ও স্বামীর নোবেল প্রাইজের গোল্ড মেডেলগুলো অবলীলায় দান করে দেন সরকারের তহবিলে। আহত সেনাদের তাৎক্ষণিক  এক্সরে করে প্রাণ বাঁচান হাজার হাজার সৈন্যের। মানবতার জন্য এই মহীয়সী নারীর হয়তো শান্তিতে আরেকটি নোবেল পাওনা ছিল। যাই হোক, একজন মহান বিজ্ঞানী সাথে সাথ দেশপ্রেমের যে নজির রেখেছেন,  তাকে আধুনিক যুগের ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল বললে ভুল হবে না।

যুদ্ধ থামার পর, বসে থাকেননি এই মহীয়সী নারী। রাজনৈতিক কোন ব্যাপারে জড়াতে পছন্দ ছিল না তাঁর। কিন্তু, বিজ্ঞানের প্রয়োজনে ও নারী অধিকারের প্রয়োজনে বারবার ছুটে গেছেন দেশে বিদেশে। রেডিয়াম নিয়ে গবেষণার জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে ১৯২১ সালে আমেরিকা ছুটে যান তিনি।  ৫০০০০ডলার নিয়ে ফিরে এসে পুরো টাকা দিয়ে কিনেন রেডিয়াম। আরেকবার, ১৯২৯ এ আমেরিকা সফরে, আমেরিকান নারীদের কাছ থেকে অনুদান পান ১লক্ষ ডলার। এগুলো দিয়েও কেনে রেডিয়াম। বিজ্ঞানের মহাসম্মিলন খ্যাত সোলভে কনফারেন্সের সবগুলোতেই ছিলেন এই নারী বিজ্ঞানী। আধুনিক বিজ্ঞানের সব দানবীয় বিপ্লবের ইতিহাসে এভাবে জড়িত হয়ে আছে এই নারীর নাম।  বিজ্ঞান শিক্ষায় নারীদের অগ্রগতির জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন তিনি।

তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়া শরীরে ১৯৩২ সালে মারাত্বক ভারে পিছলে গিয়ে আহত হন তার প্রিয় গবেষণাগারেই। তারপর থেকে অসুস্থতা নিয়ে চলেছেন বাকি সময়টা। পাঁচ সপ্তাহ প্যারিস  ক্লিনিকে ভর্তি থাকার পর  ১৯৩৪ সালের ৪জুলাই ভোর ৬টায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই মহান বিজ্ঞানী।

ছিলেন পরাধীন দেশের দরিদ্র পরিবারের এক মাতৃহীন মেয়ে, সেখান থেকে নিজের পরিশ্রম আর মেধা দেখিয়ে বড় হয়েছেন। বার বার বিভিন্ন ভাবে কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসায় কাজ করে গেছেন অবিরত। একদিকে যেমন বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ ছাত্রী ছিলেন, অন্য দিকে ছিলেন ভালবাসায় পরিপূর্ণ স্ত্রী ও মাতা। নিজের সন্তানদেরকে সর্বোচ্চ যত্ন দিয়ে মানুষ করেছেন। দেশের কাছ থেকে গ্লানি পেয়েও দেশকে কেবল দিয়ে গেছেন। একসময় জীবনে পেয়েছেন প্রতিষ্ঠা। খ্যাতির শিখরে ছিলেন। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের সাথে ছিল উঠাবসা। কিন্তু হাজারো প্রলোভন তাকে নষ্ট হতে দেয়নি।  আইনস্টাইন বলে গেছেন,

“তিনি সম্ভবত সে সময়ের একমাত্র মানুষ যিনি তার খ্যাতির কারণে দুর্নীতিগ্রস্থ হননি।”
বিজ্ঞানের এই মহান মানুষটির জন্ম দিন ৭ নভেম্বর। শুভ জন্মদিন হে মহৎ হৃদয়।

জ্ঞানচোর সম্পর্কে

সেই কবে জেগেছিলাম, বিলিয়ন বর্ষী নক্ষত্রের আলোয়, ডিরাকের সমুদ্রের পাড়ে। অবাক কৌতুহল নিয়ে গেলাম বহুদুর। তারপরও সহসা বুঝি, নিজে আমি,নিছক পড়ে থাকা ঝিনুকের খোলসে সোনালী অনুপাত খুঁজে বেড়াই। পড়ে থাকো তুমি, মহা সমুদ্র।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

22 Responses to ম্যাডাম কুরী, বিজ্ঞানের জন্য শহীদ এক মহীয়সী নারী

  1. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    বানানের ভুল গুলো ধরিয়ে দিন ।

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      ভাষা-গত আর অর্থ-গত>> ভাষাগত আর অর্থগত
      ইদানীং>> ইদানিং
      গবেষনা>> গবেষণা
      দিয়েউ>> দিয়েই
      রশ্মীর>> রশ্মির
      লবন>> লবণ
      পরিমান>> পরিমাণ
      কারনে>> কারণে
      লেবেরটরীতে>> ল্যাবরেটরি
      প্রাইজ-মানী>> প্রাইজমানি (যদিও ইংরেজি শব্দ))
      ভাল বেসেছেন>> ভালবেসেছেন
      তেজস্ত্রীয়তার>> তেজস্ক্রিয়তার
      পারমানবিক>> পারমাণবিক
      গুনাবলী>> গুণাবলি
      প্রাণ প্রিয়>> প্রাণপ্রিয় (সমাসবদ্ধ শব্দ)
      নজীর>> নজির
      সুপাভিশনে>> সুপারভিশনে
      দুর্নিতীগ্রস্থ>> দুর্নীতিগ্রস্থ
      মারীয়া, মারিয়া>> একই পোস্টে একটি শব্দের দুইরকম বানান না দেয়াই ভাল। যেকোন একটি ব্যবহার করুন প্লিজ।
      হলোনা, ছিলনা>> না-বোধক অর্থে ‘না’ একটি পৃথক শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়।

      আরো থাকতে পারে। তবে এগুলোই আপাতত চোখে পড়ল।

      সময় হলে কখনো এই পোস্টটি পড়ে দেখবেন। কিছুটা উপকৃত হবেন আশা করিঃ

      http://shorob.com/2011/08/14/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9F/

  2. কিনাদি বলেছেনঃ

    ম্যাডাম কুরী সম্পর্কে কিছুটা জানতাম। বিস্তারিত জেনে ভালো লাগলো 🙂

    তেজস্ত্রীয়তা>তেজস্ক্রীয়তা হবে।

  3. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    অসাধারন! একজন মানুষ নিজের পুরো জীবন দিয়ে দিল গবেষনায় এত কষ্টের পরও!

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    তথ্যবহুল লেখা, ভাল লাগলো খুবই। 😀
    শুভ জন্মদিন, ম্যাডাম কুরী!

    বানানের জন্য অভ্র স্পেল চেকার ব্যবহার করতে পারেন, বেশ কিছু ভুল চোখে পড়লো।

  5. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    মাদাম কুরী সম্পর্কে বিজ্ঞানের সব ছাত্রই কিছু না কিছু জানে, কিন্তু, এত বিস্তৃতভাবে এই প্রথম জানলাম। খুবই সুন্দরভাবে তার জীবনটা উপস্থাপন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। :clappinghands:
    পড়ে খুব ভালো লেগেছে। 🙂

  6. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    কুরি পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা আগে থেকেই ছিল কিন্তু এতটা বিশদভাবে জানতাম না।

    কুরি পরিবারের জন্য ভালবাসা।

    আর আপনাকে ধন্যবাদ এই পোস্টটি দেয়ার জন্য। 🙂

  7. নিলয় বলেছেনঃ

    লেখা চলুক 🙂

  8. আহমেদ বলেছেনঃ

    অনেক তথ্যবহুল লেখা……বিশেষ ধন্যবাদ………..

  9. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    বাংলা বানান নিয়ে আসলেই বাজে অবস্থায় আছি। ধন্যবাদ। আশা করি ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

  10. মুবিন বলেছেনঃ

    মাদাম কুরী সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।
    অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
    সামনে এরকম আরো তথ্যবহুল পোস্ট চাই 🙂

  11. কখগঘঙ বলেছেনঃ

    আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম মাদাম কুরিকে নিয়ে একটা লেখা লেখার। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। খুব ভাল লাগলো লেখাটা। অনেক তথ্যসমৃদ্ধ। আমি নিজেও হয়ত এত সুন্দর করে লিখতে পারতাম না।
    মাদাম কুরি আর পিয়েরে কুরি তাঁদের কাজে এত ডেডিকেটেড ছিলেন যে, কী খাচ্ছেন তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। মাদাম কুরি জন্মসূত্রে ক্যাথলিক হলেও পরে মা আর বোনের মৃত্যুর পরে নাস্তিক হয়ে পড়েন।

  12. জনৈক বলেছেনঃ

    দারুণ একটা লেখা…

  13. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    উফ! এত্ত সুন্দর একটা লেখা! রুদ্ধশ্বাসে পড়া হল। :clappinghands:

  14. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আগেই পড়েছিলাম। মন্তব্য করি নি কেন বুঝলাম না!! 😀

    চমৎকার। এই লেখাটি অনেকের মনে সাড়া ফেলেছিলো।

  15. কানিজ আফরোজ তন্বী বলেছেনঃ

    🙂
    উনি আমার আদর্শ। খুব ভাল লাগলো পড়ে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছি বিজ্ঞানী হবো।
    দোআ করবেন যেন ভবিষ্যতে আমার এই স্বপ্নপূরণ হয়। 🙂

    • জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

      আমাদের দোয়া তো আছেই। দোয়া করি, একদিন তন্বী আপুন্নীর নাম নিয়ে জ্ঞানচোর এমন ব্লগ লিখবে। 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।