“আমি কেন মারা যাই না? আল্লাহ তুমি আমাকে নিয়ে যাও”
কথাগুলো বলেই ফেললাম। বলার পরক্ষণে আমার স্ত্রী এবং ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেলো। কি করব আমি তা না বলে? সারাদিন বাসায় থাকতে কি ভালো লাগে? আমাকে বাসার বাহিরে যেতে দেয়া হয় না। যেন আমি ছোট বাচ্চা। বাহিরে যেতে হলে কৈফিয়ত দিতে হয়। এক দুইদিন নয় টানা আটমাস এমনটা হচ্ছে। তবুও পরিবারের লোকজনের কথা অমান্য করে আমি বাহিরে বের হই। এই নিয়ে সবার সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়।
সেদিন বিকালে বাহির থেকে বাসায় এলাম। বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই আকিব বলল, “আব্বা আপনাকে না বাহিরে যেতে মানা করেছি? কেন বাহিরে গেলেন? আর কতবার বলব?”
আমি অবাক হলাম। যেন আমি ওর বাচ্চা। ও আমার বাবা। ঠিক এমনটাই আচরণ করছে। কিছু না বলে সোফায় বসে সংবাদপত্র পড়তে শুরু করলাম। ইদানিং সংবাদপত্র পড়তেও ভালো লাগে না। আকর্ষণীয় কিছু নেই। খুণ, ধর্ষণ, মারামারি এই খবর ছাড়া অন্য তেমন কিছু পাই না।
রান্না ঘর থেকে আসমা বের হয়ে রাগী রাগী ভাব করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারছি এখন দ্বিতীয় দফা ঝাড়ি খাব। মানসিকভাবে প্রস্তুত নিচ্ছি। এমন একটা ভাব করছি যে কিছু করি নাই। মনযোগ দিয়ে সংবাদপত্র পড়ার অভিনয় করছি।
“তুমি পেয়েছো কি? কতবার বাহিরে যেতে মানা করলাম? তুমি শুনলে না? নিজের ভালো কি তুমি বোঝ না। আমি পাগল হয়ে যাব তোমাকে নিয়ে?” আসমার চিৎকার করে কথাগুলো বলছে। পরক্ষণে আমিও চিৎকার করতে শুরু করলাম।
“কি করব আমি? সারাদিন বাসায় বসে থাকব? পেয়েছো কি তোমরা? আমি কি ছাগল?? তোমাদের কথা মত আমাকে চলতে হবে? আমার কোন স্বাধীনতা নেই?” হাতে কাছে থাকা আমার পানি খাওয়ার মগটি ছুড়ে মারলাম দেয়াল। মুহূতের মধ্যে সম্পূর্ণ গ্লাসফট ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো ।ইস এমন করে আমার জীবনটা এভাবে চুরমার হয়ে যেতো। এই পৃথীবিতের বেঁচে থাকা ইচ্ছা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে একটু একটু করে।
দুই:
শুক্রবার দিনটার আমার খুব পছন্দের। কেননা এই দিন কোন না কোন আত্নীয় আমাকে দেখতে আসে। আমার বন্ধু নেই খুব একটা। স্কুল -কলেজের বন্ধুরা কে কোথায় আছে তা জানা নেই । কখনো খোঁজার চেষ্টাও করিনি। তবে আত্নীয় স্বজন – গ্রামের লোকজন সবার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। আগে সবাইকে দেখতে যেতাম প্রতি সপ্তাহে। এখন যেহেতু বাসা থেকে বের হতে দেয় না তাই আর আগের মত সবার বাসায় যেতে পারি না। যতটুকু যোগাযোগ হয় ফোনের মাধ্যমে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়া শেষ করে সংবাদপত্র পড়তে শুরু করলাম। আসমা এখনো ঘুমাচ্ছে। ওর শরীরটা খুব একটা ভালো না। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। বড়ই মায়া হয় আসমার জন্য সারাটা জীবন পরিবারের জন্য কষ্ট করে গেলো। ওর কোন স্বাদ ঠিকভাবে পূরণ করে পারিনি।
প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। যেখানে বসে আছি সেখান থেকে উঠে ইচ্ছা করছে না। চেহারটায় অনেক আরাম করে অধোশুয়ে আছি। আসমা ডাকলের যে উঠে পানিটা দিয়ে যাবে। কিন্তু ওকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। ঘুমটা ওর দরকার। সাধারণত এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠার মানুষ ও না। প্রতিদিন সকালে উঠে নামাজ পড়ে সবার জন্য খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে যায় সে। এরপর ঘর- গুছানো, জামা-পাড়র ধোয়া, ময়লা দেয়া, বাজার করা, দুপরের রান্না ইত্যাদ সংসারের নানা কাজ সে একাই করে।
আকিব ও আদনানের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এত বড় ছেলেরা নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারে না। ওদের প্যান্ট-শার্টগুলোও আসমাকে ধুয়ে দিতে হয়। অনেক বার ওদের বলেছি কিন্তু লাভ হয়নি। আর আসমাটাও কেমন জানি? বলে কি, “ওরা তো এখনো ছোট এত খেয়াল করার মত বয়স ওদের হয়নি।”
আমি বলি, ” একজনের বিয়ে বয়স হয়েছে আর একজন ভার্সিটিতে পড়ে । তারা ছোট”
আসমা পরক্ষণে হেসে বলে, ” মায়ের কাছে ছেলে-মেয়েরা সব সময়ই ছোট থাকে।”
পানি পিপাসাটা বেড়েই পড়ছে। বসে রইলাম। নিজের সাথে যুদ্ধ করছি। দেখি কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি। সংবাদপত্র পড়ায় মন দিলাম আবার। পরক্ষণে মনে পড়লো আজ কে আমাকে দেখেতে আসবে?
চলবে….
চলুক…