রম্য গল্প- ঘোড়া রোগ

স্বর্গের বিভিন্ন দেবদূত মর্তের সকল কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে থাকনে। জটিল সে সব হিশেব-নিকেশ। মানুষের পক্ষে সেগুলো বোঝা কঠিন। একবার এক দেবদূত জটিল এক হিশেবে একটু ভুল করে ফেললেন। একটি ভেরিয়েবলের মান ভুলে ঋণাত্মক রেখে দিলেন। তাতে বাংলাদেশের কিছু কিছু ঘোড়া উলটো দিকে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু দেবদূত সেটি বুঝতে পারলেন না। হিশেব শেষ করেই ঘুমিয়ে পরলেন। এক মাস বিশ্রামে তো আর তেমন ক্ষতি নেই।

এদিকে বাংলাদেশে তখন তুলকালাম কান্ড! পুরনো ঢাকার বকশিবাজার মোড়ে তোলা এক ভিডিও ইন্টারনেটে চাউড় হয়ে গেছে। মোবাইলে ধারণকৃত ভাঙা-ভাঙা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটি ঘোড়া দিব্যি উলটো দিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে এক আজব কান্ড! এই নিয়ে মানুষের মাঝে আগ্রহের অন্ত নেই। সেই আগ্রহের আগুনে ঘী ঢেলে দিতে মিডিয়া এসে হাজির।
“হ্যাঁ দর্শকমন্ডলি, এই সেই যায়গা যেখানে দেখা গিয়েছিলো উলটো দিকে হাঁটা সেই ঘোড়াটি। আমরা সারা ঢাকা শহর তন্য তন্য করে খুঁজে আপনাদের জন্য লাইভ দেখাবো সেই ঘোড়ার ভিডিও। আমাদের সাথেই থাকবেন।”
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসতে থাকলো উলটো হাঁটা ঘোড়া দেখা যাচ্ছে। মিডিয়ার লোকগুলোও ইন্ডিয়ান মারুতি গাড়ীর জানালা দিয়ে গলা বের করে খুঁজে চলেছে সেই অদ্ভুত ঘোড়াদের। এরই মাধ্যে খবর পাওয়া গেলো কক্সবাজারে দেখা গেছে এরকম একটি ঘোড়া।
প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন “হ্যাঁ, আমি দেখলাম একটা ঘোড়া সাগর পাড় দিয়ে উলটো দিকে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে”।
সেই একই ঘটনার বর্ণনা চট্রগ্রামে এসে হয়ে গেলো এরকম,
“কি আর বলবো ভাই, সে এক আজব ব্যাপার। ঘোড়াটার পেছন দিকে আরেকটা মুখ বেরিয়েছে। ইয়া লম্বা লম্বা দাঁত। লম্বা লম্বা কান। সিংহের মতো ডাক ছেড়ে সাগর পাড় দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিলো”।
কুমিল্লায় এসে হয়ে গেলো, “আর কি বলবো, নিজের কানে শোনা, মিথ্যে হতেই পারে না। দুটো পাখাও গজিয়েছে। সাক্ষাত পংক্ষিরাজ। ঘোড়ার ক্ষুর দিয়ে নাকি আগুনের ফুল্কি বের হয়”।
ইত্যাদি…
ঢাকার অফিসের কর্মকর্তারা টেবিলে থাবা দিয়ে বলছেন, “সিজি মানে বোঝেন? কম্পিউটার গ্রাফিক্স। এসবই হলিউডি কায়দায় গ্রিন স্ক্রিনে বানানো। আরে হলিউড তো চাঁদে মানুষ পাঠানোর মিথ্যে গল্প সাজিয়েছিলো, আর এ তো সামান্য ঘোড়া। সবই গুজব”।
জটা বাবা বললেন, “ওরে বাছা গুজব নয়, গজব গজব! পীর ফকিরদের খেদমত কম হচ্ছে। তাই উপর থেকে এই আলামত পাঠানো হয়েছে”।
জটা বাবার নামের অবশ্য একটা সার্থকতা আছে। আগে বাবার চুলের একটা একটা করে জটা খুলে ভক্তেরা মানত করতো, আর তাদের মুশকিল আসান হয়ে যেত। কিন্তু দিনে দিনে চুল যত বাড়তে লাগলো জটা খোলাটা কঠিন হয়ে পড়লো। তখন বাবা স্বপ্নে দেখলেন উলটো পথেও কাজ হবে। মানে এখন থেকে তার চুলে একটা করে গিট্টু দিলেও মনের বাসনা পূর্ণ হবে। যেই কথা সেই কাজ। তাই এখন জটায় জটায় বাবার মাথায় চুলগুলো জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। সেই চুল নিয়ে তিনি জটিল জটিল সব সমস্যার সমাধান বাতলে দেন।
যাই হোক, জাতির দুঃসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময় বিশেষজ্ঞ সাপ্লাই দিয়ে গেছে। এবারো অন্যথা হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কোয়াড্রুপেডোলজিস্ট হাশমত আলী স্যারকে নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক টানাটানি। টক শো গরম করে দিয়ে উপস্থিত হলেন তিনি।
-স্যার, ঘোড়াদের এই উলটো হাঁটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
চশমার উপর দিয়ে উঁকি মেরে বিশেষজ্ঞ বললেন,
-বিবর্তন। এসবই বিবর্তনের খেলা। বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের বাইপ্রোডাক্ট এসব। ঘোড়ার জিনে সাডেন মিউটেশন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরেনারির আরেক অধ্যাপক অন্য এক মিডিয়ায় হুংকার দিয়ে উঠলেন, “কখনোই না। এসব বিবর্তন ফিবর্তন কিছু না। চারদিকে এতো ভেজাল খাবার, এজন্যই এই আবোমিনেশন। পশুপাখির খাবারেও এরা ভেজাল মিশিয়ে এই অবস্থা করেছে”।
অফিস থেকে ছাত্রাবাসে, ফেইসবুক থেকে টং দোকানে সব যায়গায় এই একই কাহিনী। সবাই দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে। কেউ বলছে এই ঘোড়ার মিথ মিডিয়ার সৃষ্টি, কেউ বলছে আরে আমার নিজের মামার চাচাতো ভাইয়ের বন্ধুর বাবার কলিগ নিজের চোখে দেখেছে। সারা দেশ যখন ঘোড়ার কাহিনীতে দ্বিধাবিভক্ত পথ দেখানোর জন্য জাতীয় সংসদ তখন এগিয়ে এলো। জাতির এ সংকটকালে হাত গুটিয়ে বসে থাকা তো যায় না। সংসদে এ নিয়ে একটা প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো। বিরোধী দল বলল, এ সবই সরকারি দলের চক্রান্ত। আমাদের আন্দোলন ভন্ডুল করতে তারা এই মিথ্যে গুজব রটিয়ে জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে নেবার চেষ্টা করছে। সরকারি দল বলল, এ সরকারের আমলে জনগন সামনে পেছনে সব দিকে উন্নয়ন করেছে। সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সুফল পশুপাখিরাও ভোগ করছে। তারাও এখন সামনে-পেছনে, চতুর্দিকে চোখ কান খোলা রেখে চলতে পারে। এজন্য আমরা গর্বিত।
সংসদ গরম হলেও দ্বিধাবিভক্তি কাটলো না। কাপাশিয়ার মন্দিরে এমন এক ঘোড়ার পুজো দেয়া শুরু হয়ে গেলো। এই প্রাণী জাহান্নাম থেকে এসেছে বলে ফতোয়া দেয়ায় সাতক্ষীরায় পনেরোটা নিরিহ ঘোড়া মেরে ফেলা হলো। জনগন টিকেট কেটে চিড়িয়াখানায় না গিয়ে সার্কাসে উল্টো ঘোড়া দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পরলো। পড়ে জানা গেলো গরম লোহার ছেকা দিয়ে সার্কাসের ঐ ঘোড়াকে উলটো চলা শেখানো হয়েছে। এমন এক তোলপাড়ের মাঝে দেবদূতের ঘুম ভাংলো।

দেবদূত ঘুম ভেঙে দেখলেন পেছন থেকে তাকে এক ছোটো দেবদূত ডেকে তুলেছে। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কি হয়েছে। আমি তো এক মাসের ঘুম-ছুটিতে গিয়েছিলাম। কয়দিন পাড় হয়েছে?
ছোটো দেবদূত বলল, মাত্র এক সপ্তাহ।
– তাহলে ডাকলে কেন?
– আপনার কন্ট্রোল প্যানেলের এলার্ম শুনে ভাবলাম আপনাকে ডাকা উচিত।
দেবদূত চোখ কচলে কন্ট্রোল প্যানেলে তাকালেন। তাকিয়েই বুঝলেন কাহিনী কি। কন্ট্রোল প্যানেলের বাংলাদেশ অংশটিতে হাজার খানেক লাল বাতি জ্বলছে আর নিভছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন। তারপর ছোটো দেবদূতের আড়ালে ভেরিয়েবলের মানটা ঠিক করে ফেললেন। যদি ও দেখে ফেলে যে ভুলটা সে করেছে তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে না।

ছোটো দেবদূত বলল, এদের কি সমস্যা জনাব?
দেবদূত বললেন, এরা হলো বাঙ্গালী। যখন যে ঘটনা ঘটে তখন এদের সেই রোগ হয়। আর এখন এদের চলছে ঘোড়া রোগ।

সাইব্রিয়ান সৌরভ সম্পর্কে

আমার আকাশ তারায় ভরা। নিযুত-কোটি তারার আলো আলোকিত করে রেখেছে আমার কল্পনার রাজ্যকে। আমার কল্পনা বিলাসী মন ভালোবাসে নিরন্তর অনুভূমিক কল্পনায় বিভোর হতে। নক্ষত্রেরা যেমন প্রবল প্রাচুর্যে আকাশ দখল করে অবস্থান করে আমার খেয়ালী মন তার পেশাগত গন্ডির বাইরে গড়ে তুলেছে আরেক আকাশ, যেখানে সে তার কল্পনার জাল বিস্তার করে সদর্পে। আমার এলোমেলো মনের বিচ্ছিন্ন ভাবনার অবিন্যস্ত সংকলন আমার লেখাগুলো। যেখানে আমি আমার আমির বাইরে হয়ে উঠেছি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন সৌন্দর্যানুরাগী। যারা আমার লেখা পড়েছেন বা পড়বেন তাদের সকলের জন্য নিরন্তর শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ। বারংবার দেখা হবার আখাংক্ষা রইলো।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে কার্টুন, পাগলামি, রম্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to রম্য গল্প- ঘোড়া রোগ

  1. সুপ্ত বলেছেনঃ

    বারংবার কেন দেখা হয় না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।