সন্ধ্যাতারার খোঁজে

শ্রাবণের মেঘগুলো পুরো আকাশকে যেন কাল চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। এই যে দুদিন ধরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে থামবার জো নেই। আজকে দুপুরের পর আর ল্যাব নেই। তাই রুম্পা কলেজ থেকে তাড়াতাড়িই ফিরেছে। বারান্দার গ্রিল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে আর রুম্পা একমনে তা আঙুল দিয়ে মুছে যাচ্ছে। মনটা ভীষণ খারাপ তার। না, সিরিয়াস কিছু হয়নি। রুম্পার বেস্ট ফ্রেন্ড পলির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এক পর্যায়ে পলি বলেছে সে রুম্পাকে এতদিন ভুল চিনেছে, আর কখনও যেন রুম্পার মুখও দেখতে না হয় তার। ‘পলির মাথা এমনিতেই গরম থাকে প্রায়ই। হয়তো কি বলতে কি বলেছে…’, মাকে থামিয়ে দিয়ে রুম্পা বলল, ‘তুমি কিছু বুঝ না। পলি এই পর্যন্ত কখনও ওভাবে কথা বলেনি।’ ‘কি জানি বাবা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি ভাবে, কি নিয়ে ঝগড়া করে, কি নিয়ে মন খারাপ করে অত কিছু বুঝি না। শুধু বুঝি তুই শুধুশুধু মন খারাপ করছিস।’ ‘যাও তো মা। তুমি কিছু বুঝ না। তুমি শুধু তোমার রোগী আর হাসপাতালই বুঝ’- রুম্পার কথায় অভিমান ঝরে পড়ে। রুম্পার মা মুচকি হেসে প্রস্থান করেন। বিকালের পর থেকে রুম্পার মা চেম্বারে বসেন। বাসা থেকে সেই চারটার সময় বেরোন আর ফিরতে ফিরতে বেজে যায় রাত ১১টা কি ১২টা। রুম্পার বাবা চাকরিসূত্রে শহরের বাইরে থাকেন। কলেজ থেকে ফেরার পর রুম্পাকে একরকম একাই থাকতে হয়। তবু আজকে ভাল লাগছে না। মনটা অনেক বেশিই খারাপ হয়ে আছে। শুধু যে পলির সাথে ঝামেলা হয়েছে তা নয়, গত টার্মের রেজাল্টও ভাল হয়নি। সব মিলিয়ে অনেক টেনশন রুম্পার। কি করা যায়?

খুব বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু উপায় নেই। যেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে বাইরে গেলে কাকভেজা হতে হবে। ঘরে ঢুকে কেবল একোণ ওকোণ তাকায় রুম্পা। জানালার কাছে শূন্য ক্যানভাস পড়ে আছে। হ্যাঁ, মন খারাপ হলে রুম্পা ছবি আঁকে। আজও সে সেই ক্যানভাসের দিকে এগিয়ে গেল। রঙের প্যালেট, রঙ আর তুলি। ‘মন খারাপ হলে এই রঙ আর তুলির আঁচরে ক্যানভাসটা রাঙাবি। দেখবি কত ভাল লাগে। আরে! ক্যানভাসটাই যে আমাদের মন।’ হুম, নানাভাইয়ের কথা বেশ মনে পড়ছে। রুম্পা মনে মনে ভাবে, ‘নানাভাই তুমি কোথায় চলে গেলে? তুমি ছাড়া আমাকে কেউ ঠিকমত বুঝে না।’ প্রায় বছর ছয়েক হল রুম্পার নানা শরীফ সাহেব মারা গেছেন। বলা যায়, ব্যস্ত বাবা-মার একমাত্র সন্তান হিসেবে রুম্পার খেলার সাথী, স্কুলের যতরকম, ‘যা খুশি তাই’ গল্পের একমাত্র শ্রোতা, পার্টনার অফ ক্রাইম- সবই ছিলেন শরীফ সাহেব। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর ফেলে যাওয়া স্মৃতিগুলো এভাবেই কষ্ট দেয় রুম্পাকে। একসময় নানার আবদারে, অনুরোধে কতকিছুই এই ক্যানভাসে আঁকত রুম্পা। বিশেষ করে মন খারাপ থাকলে এটা ওষুধের মত কাজ করত। কিন্তু আজ সেই স্মৃতি রোমন্থন করে রুম্পা যেন ততটাই কষ্ট পাচ্ছে।

-এই এই দুষ্ট মেয়ে…খেয়ে নে বলছি। এত দৌড়াদৌড়ি করিস না বাবা। এই যে থাম। এই মেয়েটা আমাকে পাগল করে দিবে।
-(হাসতে হাসতে) নানাভাই দৌড়াতে পারে না।
-এই এই, আমার সাথে মজা করা হচ্ছে! হুম? এত দুষ্টুমি করলে কিন্তু ঐ রাজপুত্র টগবগ ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসে তোকে নিয়ে যাবে। এইতো আমি এখনই ফোন করছি।
-না না। (ফ্লোরে পা দিয়ে আঘাত করে) আমি কোথাও যাব না। আমি তোমার কাছেই থাকব।
-আমার কাছে থাকতে হলে কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ের মত খেতে হবে।
রুম্পার বয়স যখন দুই কি তিন এভাবেই রুম্পার নানা সারা ঘর রুম্পার পিছুপিছু ছুটতেন খাবারের প্লেট নিয়ে। টগবগ ঘোড়া আর রাজপুত্রের কথা বললেই রুম্পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। যদিও বড় হওয়ার পর এ নিয়ে রুম্পা মনে মনে অনেক হাসত।

‘কেউ যদি আমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারত…নানাভাইয়ের মত যে আর কেউ নয়…’- ভাবতে ভাবতে আবারও বারান্দায় আসে রুম্পা। উদাস মনে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতিদিন বিকালে নানাকে নিয়ে সংসদ ভবনের ওদিকটাতে হাঁটতে যেত রুম্পা। একদিন এক ঘটনা ঘটল। এর পর থেকে নানাভাই ওকে প্রায়ই খেপাত ‘বোকি রুম্পা’ বলে। তখন রুম্পার বয়স সবেমাত্র চার পেরিয়েছে। শরীফ সাহেব বাদাম কিনছেন আর রুম্পা তাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
-নানাভাই দেখ, বেলুন।
-কোথায় বেলুন?
-ঐ যে বেলুন…সাদা বেলুন, গোলাপি বেলুন।
-আহা! ওগুলো তো বেলুন না। ওগুলো তো হাওয়াই মিঠাই। একি? আমার নানুভাই দেখি হাওয়াই মিঠাই চিনে না।
-এগুলো কেমন খেতে?
-মিষ্টি। চকলেটের মত। এই ভাই, এদিকে আসেন তো। আমার রুম্পামনিকে হাওয়াই মিঠাই দেন। (মিঠাই রুম্পার হাতে দেয়ার পর) বলতো কেমন খেতে?
-উঁহু। আমার ক্যাটবুরি এর চেয়ে অনেক মজা। (রুম্পা Cadbury chocolate কে ক্যাটবুরি বলত)
-কি বলে বোকা মেয়েটা? আজ থেকে তোর নাম হয়ে গেল ‘বোকি রুম্পা’। হাঃ হাঃ…
-নানাভাই, না…
আজ এসব কথা মনে করে রুম্পার নিজের উপরই খুব ঈর্ষা ও ক্ষোভ হচ্ছে। এমনি সুন্দর কিছু মুহূর্ত তার শৈশব জুড়ে ছিল। এখন তাই যেন তার নিদারুণ যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে।

রুম্পা আর নিজেকে সামলাতে পারছে। মাথা ভারি হয়ে আসছে। এদিকে আকাশ জুড়ে কেবল মেঘ আর মেঘ। ‘সন্ধ্যাতারা কি আজও দেখতে পারব না?’- অস্থির হয়ে উঠে রুম্পা। আবারও অতীতে হারিয়ে যায় সে।
-নানাভাই, দেখ কি এঁকেছি।
-বাহ! এ তো দেখি বেলুন।
-না! এগুলো হাওয়াই মিঠাই।
-ও! বোকি রুম্পা দেখি হাওয়াই মিঠাই চিনে।
-(বিরক্ত হয়ে)আহ! নানাভাই। তুমি এমন কর কেন আমার সাথে? (কিছুক্ষণ নীরবতা) নানাভাই, কি হয়েছে তোমার? আকাশে কি দেখ?
-দেখি নারে নানুভাই। খুঁজি।
-কি খুঁজ?
-বুঝবি না।
-আ আ…আমি এখন অনেক বড়। আমি স্কুলে যাই। বাক্য লিখতে পারি, পড়তেও পারি।
-ইশ! আমার নানুভাই যে পাকাবুড়ি হয়ে গেছে। আরেহ! ঐ যে সাদা চুলও দেখি বেরিয়েছে…
-আ আ আ…নানাভাই তুমি শুধু দুষ্টুমি কর! বলনা কি খুঁজ?
-আচ্ছা বলছি। আমি সন্ধ্যাতারা খুঁজি।
-এটা আবার কি?
-এটা একটা তারা। সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশের এক কোণে দেখা যায়। যখন কাউকে মনে পড়ে তখন আমি ওটাকে খুঁজি।
-কাকে মনে পড়ে?
-এই যেমন ধর…আমি যখন মরে যাব তখন তুই আমাকে মনে করবি, সেরকম একটা ব্যাপার।
-ধুর, নানাভাই! কি বল? তুমি মরবে কেন? (জড়িয়ে ধরে) আমি তোমার কাছেই থাকব সবসময়।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম্পা ঘরের ভেতর আসে। মেঘলা আকাশ, মেঘলা মন। ঘড়ির টিকটিক শব্দও অসহ্য লাগছে। বিছানায় শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে রুম্পা। চোখের পাতা একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে, একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে। উপরের সিলিংটা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসছে। দৃষ্টির সীমানায় কেমন যেন মেঘ জমা হচ্ছে। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ। শব্দের আকস্মিকতায় কর্নিয়া প্রসারিত হল। চারদিকে নিকষ কাল অন্ধকার। লোডশেডিং?! উঠে দাঁড়াল রুম্পা। ফ্লোরের উপর হারিকেন পড়ে আছে। ‘হারিকেন আসল কোথা থেকে? এটা জ্বালালোই বা কে?’-ভাবতে ভাবতে রুম্পা হারিকেনটা তুলে নেয়। নিজের রুমটাও ঠিকমত চিনতে পারছে না রুম্পা। এ কি? এটা যে রুম্পার রুম নয়। একটা শূন্য, ফাঁকা হলরুম। কেন জানি রুম্পার ভয় করছে না, কিন্তু অদ্ভুত লাগছে।
-রুম্পা…রুম্পামনি…এই যে আমি এদিকে।
-কে? নানাভাই?
-এই যে এদিকে…
হারিকেনের আলোতে নানাভাইকে চিনতে রুম্পার এতটুকুও দেরি হল না।
-নানাভাই তুমি? তুমি তো…
-আমি তো কি?
-না মানে…বুঝতে পারছি না।
-না না, কাছে আছিস না। দূরে থাক।
-কেন?
-আলোতে বড্ড কষ্ট হয়।
-ওহ! আচ্ছা, তাহলে আলো কমিয়ে দেই।
-না সেটার দরকার নেই। কেবল কাছে না আসলেই হল।
-এমন করছ কেন নানাভাই?
-আলোতে আমাকে দেখলে কষ্ট পাবি, তাই কাছে আসতে বারণ করছি।
-কষ্ট পাব কেন নানাভাই? তোমার কথাই তো ভাবছিলাম…
-এখন আমায় দেখলে তোর কষ্টটা আরও বেড়ে যাবে।
-আচ্ছা।
-আমার নানুভাইয়ের কি মন খারাপ? তা ক্যানভাসটা ফাঁকা কেন?
-সবসময় ছবি আঁকলে মন ভাল হয়ে যায় না…
-আচ্ছা, তাহলে বোকি মেয়ের মত মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন?
-সন্ধ্যাতারা খুঁজছিলাম। তুমিই তো বলেছিলে…
-হুম, বলেছিলাম। আকাশে মেঘ থাকলে খুঁজে পাবি কিভাবে?
-তাহলে কি করব বল। তোমার কথা মনে পড়লেই তো তারাটা খুঁজি।
-কেন? মনের ভেতরে একটা সন্ধ্যাতারা আছে না। সেখানে খুঁজে দেখবি যে, আমি চুপটি করে এক কোণে বসে আছি।
-যেমনটা এখন দেখছি…
-হ্যাঁ, ঠিক তেমনটাই খুঁজে পাবি।
হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ। বিকট আলোর ঝলকানিতে রুম্পা আঁতকে উঠল আর হাত থেকে হারিকেনটা পড়ে গেল।

‘নানাভাই, নানাভাই।’

সব চুপচাপ। অতঃপর নিস্তব্ধতার আবরণ ভেদ করে গান বেজে উঠল-
You’ll remember me when the west wind moves upon the fields of barley,
You’ll forget the sun in his jealous sky as we walk in fields of gold.
রুম্পার মোবাইলের রিংটোন বাজছে। রুম্পা তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠল। ফোনের ওপাশ থেকে পরিচিত স্বর কানের পর্দাকে আঘাত করল, ‘কি রুম্পা? এতবার কলিং বেল বাজাচ্ছি দরজা খুলছ না কেন? একটু হলে তো সিকিউরিটি কল করে দরজা…’। রুম্পা দৌড়ে দরজা খুলতে গেল আর দরজা খুলেই চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলে উঠল, ‘জানো মা, নানাভাই এসেছিল।’

পাহাড়ি কন্যা সম্পর্কে

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বাস্তব ও কল্পনা আমার দৈনন্দিন জীবনের সহযাত্রী। জীবনকে ভালবাসি। অনেক স্বপ্ন দেখি, যদিও তা বাস্তব থেকে মাঝে মাঝে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। আমি বরাবরই রাশভারী প্রকৃতির মানুষ, স্বল্পভাষী কিন্তু হাসতে খুব ভালবাসি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।