সরব স্বরের এবারকার আয়োজনের বিষয় ছিল The Design Theory : ছলে বলে কৌশলে । সত্যি কথা বলতে আমরা যারা খুব আগ্রহ নিয়ে এই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ধারণাই করতে পারি নি Design কথাটা কতটা বিস্তৃত , কতটা বহুমাত্রিক হতে পারে । এই সেশন এতটাই শক্তিশালী ছিল দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানের পর বদলে গিয়েছিল আমাদের বহুদিনের চিন্তা এবং চিন্তা করার ভঙ্গি । আর এবারের সেশনের বক্তা ইশতিয়াক আহমেদ কল্লোল ভাইয়ের কথা না বললেই না , এমন একজন অসম্ভব মেধাবি মানুষ এতটা অমায়িক হতে পারেন সেটা না দেখলে বিশ্বাস হয় না । এমনভাবে তিনি কথা বলছিলেন যে মনে হচ্ছিল, নাহ তো, কই , কোন কঠিন কঠিন কথা তো শুনছি না, বরং মনে হচ্ছিল কেউ যেন রূপকথার কথার গল্প শুনাচ্ছেন ।
Design কথাটা মূলত প্রকৌশলীদের কাছেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, কিন্তু ঘটনা হল গিয়ে আমরা প্রত্যেকেই আসলে কোন না কোন ভাবে ডিজাইন করছি । যেমন এই অনুষ্ঠানে আসবার আগে কীভাবে আসতে হবে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়েছে । হয়ত রিক্সা করে আসার প্ল্যান ছিল কিংবা অন্য কোন ভাবে । হয়ত সেভাবে আসতে পারা যায়নি, কোন না কোন সমস্যায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে । কিন্তু যাই হোক না কেন আমরা আসলে একটা ডিজাইন করে ফেলেছিলাম সেটা যত ছোটই হোক না কেন! কল্লোল ভাই বলছিলেন আর আমরা অবাক হয়ে ভাবছিলাম বাহ ! ধীরে ধীরে তিনি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করছিলেন । বলছিলেন যে Design এর জন্য যেটা সবার প্রথমে দরকার সেটা হচ্ছে Design করবার ক্ষমতা । আমরা চাইলেই কোন System Design করতে পারি না , এর জন্য আমাদের আগে সেই Design করবার অধিকার থাকতে হবে । কিন্তু ধরা যাক, কেউ একজন চাইলেই Design করতে পারে , কিন্তু তার করতে ইচ্ছা করছে না । তাহলে ? হ্যাঁ , Design করতে হলে তাই দরকার empathy , Design টি করবার ইচ্ছা । কিন্তু সেই Design ভাল হবে না মন্দ হবে সেটা কী করে বুঝব ? এই ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার বিষয়টি কিন্তু বেশ আপেক্ষিক । সবসময় মোটা দাগে সাদা আর কালো কিন্তু আলাদা করা যায় না । দার্শনিক হেগেল বলেছেন , কোন জিনিস ভাল না খারাপ বা কেমন টা জানতে হলে অবশ্যই এর ইতিহাস জানতে হবে । যেমন একটা কলমের কথাই ধরা যাক । কোন এক সময় কেউ হয়ত বলেছিল এটি কলম, আবার আরেক সময় কেউ বলল এটি পেন্সিল আবার কেউ হয়ত অন্য সময় বলল না এটা হচ্ছে একটি বস্তু । হেগেলের মতে কলমটা আসলে যত সময়ে এর সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে তারই সমষ্টি , আলাদা করে কোন কিছু নয় । মার্ক্স আবার এই ভাল খারাপ বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছিলেন । তিনি বললেন কোন জিনিস হয়ত একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে ভাল হতে পারে , আবার কোন বিশেষ শ্রেণির কাছে সেটা খারাপ । মানে হচ্ছে ভাল খারাপের শ্রেণি ভিত্তিক আবেদনের কথা তিনি জোর দিয়ে বলছিলেন । দার্শনিক ফুকো আবার একেবারেই ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন তিনি বললেন আমাদের আসলে সিস্টেমের বাইরে গিয়ে সিস্টেম নিয়ে ভাবতে হবে । প্রাচীরে আটকে থেকে গন্ডিবদ্ধ চিন্তা করলে হবে না ।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা এখন ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন নিয়ে কথা বলতে চাই । কিন্তু গোটা বিশ্বের ডেভেলপমেন্ট নির্ধারণ করছে আসলে কে? কয়েকদিন আগে UNESCO এর আয়োজনে বাংলাদেশে হয়ে গেল প্রোগ্রামিং হ্যাকাথন । ফাইভস্টার এক হোটেলে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে প্রায় কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে । কিন্তু আসলে এর আউটপুট কী ? এই প্রোগ্রামারদের কাজ করার বিষয় ছিল বাংলাদেশের স্যানিটেশন সমস্যার সমাধান ! জ্বি, হাসবেন না প্লিজ । স্যানিটেশন সমস্যা সমাধানে প্রোগ্রামিং কীভাবে কাজে লাগবে , আর যদি এমন কোন প্রোগ্রাম আসেও তাহলে এর বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব? এইভাবে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গুলো উন্নয়নের নাম করে আসলে কী করছে , সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে । বর্তমানের পৃথিবীতে তলোয়ার নিয়ে আসলে যুদ্ধ আর হবে না , সাম্রাজ্য বিস্তারের ঝামেলাতেও পরাশক্তিগুলো আর যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা কী তাদের থেমে গেছে? নাহ, বরং আরও সুকৌশলে তারা ৩য় বিশ্বের দেশগুলোকে আটকে ফেলছে । উন্নয়নের জন্য সাহায্যের নামে তারা যে পরিমাণ অর্থ দিচ্ছে, আদায় করে নিচ্ছে তার চেয়েও বেশি । সত্যি কথা বলতে তাদের কার্যক্রম দুমুখো সাপের মতই, দুদিক দিয়েই কাটতে থাকে । একে তো বিপুল সুদের বোঝা তার উপর উন্নয়নের যে পরিকল্পনা তারা বেঁধে দিচ্ছে এর বাইরে গরিব দেশ গুলোর সরকার এক পাও যাবার স্বাধীনতা পাচ্ছে না । এমনি করে এক বিশাল ডিজাইনের ফাঁদে আমরা পড়ে গেছি , অথচ আমরা তা বুঝছিও না । আমাদের দেশে গার্মেন্টস কারখানা তৈরির জন্য অর্থায়ন করা হচ্ছে কিন্তু এমন পোশাক তৈরির কথা বলা হচ্ছে যা বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী নয় । অথবা পোশাকগুলোর পোস্ট প্রোসেসিং এর কাজ সেই উন্নত বিশ্বে গিয়েই করতে হয় । তারপর সেই পোশাক আবার আমাদের দেশের বাজারেই বিক্রি হয় বিপুল দামে । কিন্তু আমাদের যেই পোশাক শ্রমিক, তার দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের কী হবে? তার পরিশ্রমের মূল্য সে কখনই পায় না । বরং এই চক্রে শোষিত হতে থাকে ক্রমাগত । সিলিকন ভ্যালি তৈরি হচ্ছে ৩য় বিশ্বে কিন্তু এর প্রযুক্তিগত সুফল ভোগ করছে কারা? এসব দেশ থেকেই গুগল ,মাইক্রোসফট, অ্পযালে যাচ্ছে মেধাবি ছাত্ররা কিন্তু এসব প্রোডাক্ট এত দামে আসছে দেশগুলোতে এমন কি আসছে সবার পরে । খাটিয়ে মেরে আবার অবহেলার মতই ! কই বাইরের দেশ গুলোতে মেধাবিরা তো কম্পিউটার সায়েন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিং এর দিকে ঝুঁকছে না । তাদের আগ্রহ আর্টস , ফিলসফি আর পলিসি মেকিং এর দিকে । তারা পলিসি মেকিং করবে আর সেই পলিসি বাস্তবায়ন ৩য় বিশ্বের কামলারা । আশ্চর্য হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ডিজাইন হয়ে গেছে ঠিক সেইভাবে । আমরা আজকে নাসায় পাঠানোর জন্য রোবট বানাই , কিন্তু আমাদের যানজট সমস্যা সমাধান নিয়ে আমাদের কোন পরিকল্পনা নেই , কারণ আমাদের চিন্তা ভাবনাও আসলে নিয়ন্ত্রিত । আমাদের নিজস্ব জ্ঞান উৎপাদনেও আমাদের কোন আগ্রহ নেই । গ্রাজুয়েশন লেভেলে কোন বাংলা লেখকের বই আমরা পড়ি না, অনুবাদ হলে ভিন্ন কথা । এই নিয়ন্ত্রণ কতটা ভয়াবহ আসলে সেটা কল্পনাও করতে পারি না , কোনটা ভাল কোনটা খারাপ সেটা স্বাধীনভাবে বুঝবার ক্ষমতা আমাদের নেই । আজ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে মিডিয়াগুলো , আর এই মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় পশ্চিমাদের দ্বারা । ফেসবুকে দুই পক্ষ হয়ত চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে, সমস্যার হয়ত সমাধান হয় না । অথচ এই বিবাদের মধ্য দিয়ে ফেসবুকের যে লাভটা হচ্ছে সেটা নিয়ে কেউ কি ভাবছে ? কেন উইন্ডোজ ৭ এর পর ৮ , ৮ এর পর ৯ বেরোচ্ছে ? এই বের যে হতেই থাকবে সেটাও কী আমরা বুঝেও বুঝব না ? আমাদের কেন আই ফোন কেনাই লাগবে ? আমাদের চাহিদা গুলো যে ক্রমাগত বেড়েই চলছে , কিন্তু কে বাড়িয়ে তুলছে সেটা কি আমরা ভেবে দেখব না ? আসলে শুধু পশ্চিমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই আমরা তো আসলে নিজেদের দেশের ক্ষমতাধরদের দিয়েই শোষিত হচ্ছি । সিনেমার নায়ক নায়িকাদের চাইতে রাজনৈতিক নেতারা আজ বেশি জনপ্রিয় , এটা মিডিয়ার কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে । কিন্তু সাধারণ মানুষদের লাভ হল কতটুকু? আমাদের বদলে যাওয়ার যে গল্প শোনানো হচ্ছে , সত্যি কি এর ভিত্তি আছে? আমরা কি সত্যি বদলে যাচ্ছি, নাকি কেউ আমাদের বদলে দিচ্ছে? একটু ভেবে দেখুন তো ! সে জিনিস ভেবে দেখতে হলে আগে ভাবতে হবে কীভাবে করে ভাবতে হয় সেটা আসলে আমাদের কে শিখিয়ে দিয়েছে? কিংবা চিন্তা ভাবনার জন্য যেই জ্ঞানের প্রয়োজন , সেই জ্ঞানের উৎসই বা কী? যা শিখছি, যা দেখছি , যা ভাবছি, যা করছি অথবা যে উদ্দেশ্যে করছি এমনকি যে স্বপ্ন দেখছি হয়ত আমাদের সেই স্বপ্নও নিয়ন্ত্রিত ! আমরা আসলে কোন স্বপ্নের ভেতরই স্বপ্ন দেখছি । এই স্বপ্ন্বের নকশা আমাদের হাতে আর নেই ।
কিন্তু এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসবার উপায় কী ? ডিজাইনকে উপকারি করে তোলা যায় কী করে? কল্লোল ভাই এবার সমাধানের দিকে মোড় ঘুরালেন । তিনি কয়েক ধরণের ডিজাইনের কথা বললেন ।
Participatory Design : এই ডিজাইনে যার যে উন্নয়ন দরকার , তারা নিজেরাই উন্নয়ন পরিকল্পনায় অংশ গ্রহণ করবে । গ্রামের মানুষের কোন সমস্যা সমাধানের জন্য যে কমিটি উন্নয়ন পরিকল্পনা করবে তাতে গ্রামের মানুষেরও অংশগ্রহণ থাকতে হবে । তারা যে আসলে সমস্যায় আছে, বা আদৌ সমস্যায় আছে কিনা সেটা নিজেরাই বলুক ।
Personalization : সমস্যা সমাধানের জন্য ওই জনগোষ্ঠীকে সমর্থ করে তুলতে হবে । সেজন্যে শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে তুলতে হবে , অন্যের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে ।
আসলে আধুনিক হওয়ার আগে আমরা তো সুখিই ছিলাম, আমাদের গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের গল্প তো মিথ্যা নয় । কিন্তু আমরা কি কোন কৃত্রিম অভাববোধের মধ্যে পরে গেলাম? পুঁজিবাদী এই নকশা থেকে বের হওয়া কি এতটাই সহজ ? এইসব প্রশ্ন দর্শকদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেই সময়টাতেই কল্লোল ভাই তার বক্তব্যের ইতি টানলেন ।
এমন অদ্ভুত সব কথা হজম হওয়ার জন্য এবার তো একটা বিরতি দরকার , তাই না ? এই বিরতির মাঝে আমন্ত্রিত দর্শকদের চা আর চায়ের সাথে হালকা টা দিয়ে আপ্যায়ন করা হল । এরই ফাঁকে সবাই যার যার সাথে পরিচিত হয়ে নিচ্ছিলেন । যাই হোক এরপর শুরু হল ইন্টার এক্টিভ সেশন । সবাই যার যার মত প্রশ্ন করে যাচ্ছিল আর সে কারণে পুরো রুমটাই হয়ে গেল প্রাণবন্ত । প্রশ্ন আসছিল নানা দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ কেউ কথা বলছিলেন বের হয়ে আসার উপায় নিয়ে । আদৌ এই বৃহত্তর চক্র থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব? কেউ আবার বলছিলেন যদি চাহিদা কমে যায় তাহলে পরে ইনোভেশন এর কী হবে? সেটাও কী থমে যাবে না ? আলোচনায় উঠে এসেছিল প্রয়োজন আর বিলাসিতার পার্থক্যের কথা । সবাই আমরা এই বিষয়ে একমত হয়েছিলাম যে পারি আর না পারি অন্তত এসব আমাদের সচেতন হওয়া উচিৎ , জানা উচিৎ আলোচনা করা উচিৎ যাতে করে আমাদের ধোঁকা দেওয়া এতটা সহজ না হয় !
এক কথায় গোটা সেশনটাই ছিল যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনার খোরাক । এই চিন্তাতেই বিপ্লব, চিন্তাতেই মুক্তি । চিন্তার জয় হোক , জয় হোক সরব স্বরের ।
খুব সুন্দর করে লিখেছো।
বিশাল মিস হয়ে গেলো। Kallol Ahmed ভাই এর সাথে আড্ডা দিলে ক্রিটিকালি চিন্তা করা শুরু হয়ে যায়। এই জন্য সব কিছুতে একমত হতে হয় না। এই যে প্রশ্নগুলা মাথায় ঢুকিয়ে দেন উনি।
হ্যাকাথন নিয়ে দারুণ একটা প্রশ্ন আসল। Rafid Wahid ESAB এ এইটা নিয়ে কথা বলা যায়।
আমার মাথায় আরেকটা জিনিস আসল, কোন সাবজেক্ট কতটা জনপ্রিয় এইটা পুরাই নির্ভর করতেছে স্যালারির উপর। পাশ করেই কত টাকার চাকরি আসবে! আমাদের সময় ইইই আর বিবিএ’র জন্য হিড়িক পড়ে গেছল।
একটা মনে হয় ছোট্ট ভুল আছে পোস্ট এ, সিলিকন ভ্যালি তৈরি হচ্ছে ৩য় বিশ্বে কিন্তু এর প্রযুক্তিগত সুফল ভোগ করছে কারা?
সিলিকন ভ্যালির পণ্য তৈরি হয় ৩ইয় বিশ্বে – এইটা হবে মনে হয়। সিলিকন ভ্যালি তো আমেরিকাতেই, মূল গবেষণা/ আইডিয়া ওখান থেকেই আসতেছে.
[ফেবুর পাশাপাশী এইখানেও দিলাম।]
প্রথম দুটো স্বরেই থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তবে এইবার যেহেতু থাকতে পারিনি, তাই রিভিউটার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এই প্রথম একটা সরব স্বরে থাকার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকার পরেও থাকতে পারি নাই। 🙁 (আগের দুই বক্তার বক্তব্য জীবনে এত বেশি শুনেছি+শুনছি+শুনবো যে কারণে না আসতে পারার দুঃখ একটু কম ছিল)। 😛 অনুভূতি-লিখন পড়ে ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে স্বরটা কত অসাধারণ হয়েছে, অনেক ধন্যবাদ। খুব খুব জরুরি এর বিষয়বস্তু।