“Mirror Mirror on the wall
Who’s the fairest of them all?’
এই জার্মান Fairy Tale এর কথা শোনে নি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবার কথা। Fairness এর উপর এর চাইতে জনপ্রিয় Fairy Tale হয়ত আর একটিও নেই।
ফেয়ানেস ক্রিমের কোম্পানিগুলো কাড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেললেও ‘সাদা মানেই সুন্দর’ – এই *বিশ্বসত্যকে* এর চাইতে ভালোভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে পারেন নি আজ পর্যন্ত।
আচ্ছা, একটা প্রশ্ন – সুন্দর কী?
বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ‘সুন্দর’ মানে এমন কিছু যা আপনার মস্তিষ্কের মিডিয়া অর্বিটো ফ্রন্টাল কর্টেক্সে ট্রিগার করবার ক্ষমতা রাখে।
একই জিনিস আমার মস্তিষ্কে ট্রিগার করতে পারলেও আপনার মস্তিষ্কে নাও করতে পারে, এটা অস্বাভাবিক না।
ধরা যাক, একটা এলিয়েনকে ধরে তার মাথায় জোর করে একটা আনকোরা মানুষের মস্তিষ্ক ভরে দেয়া হল। তার মাথায় ঢোকানো এই মস্তিষ্কে জাগতিক কোন তথ্য নাই। এখন এই এলিয়েনটা যদি ডাস্টবিন দেখেও বলতে পারে, ‘বাহ কী সুন্দর!’ এতে অবাক হবার কিছুই নাই। তার মাথায় ঢোকানো মস্তিষ্কের মিডিয়া অর্বিটো ফ্রন্টাল কর্টেক্স ডাস্টবিন দেখে ট্রিগার্ড হয়েছে, তাই ডাস্টবিনকে সে সুন্দর বলেছে। সারা দুনিয়া আর্মি কুজেলাকে বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব দিয়েছে, কিন্তু আর্মি কুজেলাকে এই এলিয়েনের সামনে নিয়ে এলে সে বলতেই পারে, ‘কী কুচ্ছিত এই মহিলা!’ এতেও অবাক হবার কোন কারণ নাই!
আচ্ছা, বলুন তো এই উদাহরণ দেবার সময় একটা আনকোরা মস্তিষ্কের কথা কেন তেনে আনলাম?
কারণ, মস্তিষ্কের এই ট্রিগার্ড হবার ব্যাপারটাতে একটা মানসিক প্রভাব আছে। মানুষের মানসিকতার উপর এটা অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর মানুষের মানসিক অবস্থা তার পারিপার্শিকের উপর নির্ভর করে। কোন পারিপার্শিকের প্রভাব মুক্ত মস্তিষ্ক’র কথা বলতে চেয়েছি, তাই এই এলিয়েনের মাথায় একটা আনকোরা মস্তিষ্ক ঢুকিয়ে তাকে দিয়ে উদাহরণ দিলাম।
ছোট বেলা থেকেই আমরা শুনতে শুনতে বড় হই, ‘ঐ মেয়েটা কী সুন্দর! ফর্সা, লম্বা, খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, লম্বা চুল!’
কিংবা ‘ঐ ছেলেটা কী হ্যান্ডসাম! লম্বা, ফর্সা, ছোট করে ছাঁটা চুল, ব্যায়াম করা শরীর!’
আমাদের মাথার ভেতর গেঁথে যায়, সুন্দর মানেই এমন! আমাদের মগজখানি তখন সুন্দরের খোঁজে করলে আগেই এই বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কিনা তা খোঁজে। আমাদের মস্তিষ্ক কোনদিন ভাবেও না যে কোনটা সুন্দর আর কোনটা সুন্দর না – এই প্রশ্নের কোন জবাব নাই!
আবার প্রশ্ন করি, কেন আমাদের মগজে এটাই ঢোকানে হয় যে সাদাই সুন্দর? কালোকে সুন্দর বলে পরিচিত করানো হয় না কেন?
এই প্রশ্নের জবাব জানতে হলে খুব বেশী দূর যেতে হবে না। ইতিহাসের পাতায় মাত্র কয়েক শতক আগে গেলেই বোঝা যাবে যে কেন সাদাকেই সুন্দর বলে ডিফাইন করা হয়।
‘সাদাই সুন্দর’ – এই ফেনোমেনার জন্ম আসলে কলোনিয়াল লেগেসি থেকে। ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষগুলো আমাদের কলোনাইজ করে রেখেছিল অনেক বছর ধরে। সেই সময়ে তাদের একটা টেন্ডেন্সি ছিল নিজেদের সুন্দর, শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করা। আবার এই দেশের মানুষ তাদের আনুগত্য স্বীকারে অসাধারণ উদারতা দেখিয়েছিল। এই দেশের মানুষের সেই উদারতার সুযোগে ইউরোপিয়ানরা অনেক তাদের মতাদর্শের অনেক কিছুই আমাদের ভেতর পুশ করে দিতে পেরেছিল, যার মাঝে একটা এই সাদার জয়জয়কার।
ইউরোপিয়ানরা নিজেরা সাদা চামড়ার মানুষ, সাদা চামড়া দেখতেই তাদের চোখ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তারা এদেশে এসে এদেশের অপেক্ষাকৃত সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে দেখতেই একটু কমফোর্ট ফিল করত, তাদের সাথে সম্পর্কও ভালো থাকত। সেই থেকে এই দেশের অতি অনুগত মানুষের মনেও ঢুকে যায়, সাদা মানুই সুন্দর! তাদের পুশ করা সেই ভাইরাস আমরা এখনও বহন করি।
খালি আমরা না, সারা দুনিয়াই ইউরোপিয়ানদের এই ‘পুশিং’ এর শিকার হয়েছে।
এই সময়ে এসে আপনি হয়ত ইথিওপিয়াকে দুনিয়ার সবচাইতে দরিদ্র দেশ বলে মনে করেন। ইথিওপিয়ার কথা বললেই আপনার সামনে কালো কালো রোগা কিছু মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। আপনি ভাবতে থাকেন, এরা মনে হয় দু-তিন দিনেও এক বেলা খেতে পায় না। কেন?
আপনি কখনও ইথিওপিয়া হয়ত যানও নি, কিন্তু টিভিতে আপনি এমনটাই দেখেছেন, শুনেছেন। তাই এমন দৃশ্যই আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আপনার মস্তিষ্কটা ইথিওপিয়ার নাম শুনলে এর বাইরে আর কিছুই নতুন করে ভাবতে চায় না।
আচ্ছা, আপনি কী জানে, একটা সময়ে ইথিওপিয়া দুনিয়ার সব চাইতে ধনী দেশগুলোর একটা ছিল? আশ্চর্য্য হবেন, গ্রিকরা ইথিওপিয়াকে হিংসা করত! তারা বলত, স্বর্গের দেবতারা পৃথিবীতে এসে ইথিওপিয়ানদের সাথে আমোদ-ফুর্তি করত! ইথিওপিয়ানদের সম্পর্কে তাদের বিশ্বাসটা এমনই ছিল!
ইথিওপিয়ানরা বলত, কালো হচ্ছে ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক। তারা কালো বলেই তাদের এত ঐশ্বর্য্য! আর অন্যরাও সেটাই মেনে নিয়েছিল! সারা দুনিয়া তখন কালোকেই সুন্দর বলত। কালো হবার জন্যে লাতিনরা গায়ে পাথর ঘষত, এমনটাও শোনা যায় (আমরা যেমন সাদা হবার জন্যে স্নো-পাওডার মাখি আরকি)! খেয়াল করবেন, শ্বেতাঙ্গ বডি বিল্ডাররা শারীরিক কসরত দেখাবার সময় প্রায়শই গায়ে কালচে তেল মেখে নেন। এর কারণ, তাদের ধারণা কালোতেই শারীরিক কসরত সবচাইতে ভালো মানায়।
এরপর একটা সময় কালো চামড়ার সেই মানুষগুলোর জৌলুস কমে গেল, ক্ষমতা চলে গেল সাদা চামড়ার মানুষদের কাছে। সাদা চামড়ার মানুষগুলো বলল, ‘কালো কুৎসিত, সাদা সুন্দর’!
ব্যস, সুন্দরের সংজ্ঞা বদলে গেল ধাম করেই!
তার মানেটা হল, ছেলেবেলা থেকেই এমন একটা জিনিস আমাদের শেখানো হয়, যার নিগূঢ় অর্থ হল, ‘ক্ষমতাই সৌন্দর্য্য’!! যখন যার হাতে ক্ষমতা, সেই সুন্দর!! সৌন্দর্য্য হল ক্ষমতার আরেক নাম, এখানে হৃদয় বলতে কিচ্ছু নেই!
এটাই বাস্তবতা।
কিন্তু সত্যও কী এটাই??