গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকদের ভাবনাগুলো (১): মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের বলা যেতে একটি জাতির আত্মা, জাতির প্রাণ। বই সে আত্মার ধারক, বাহক, প্রকাশক। বারো মাসে তেরো পর্বণের দেশ- বাংলাদেশ। জন্মগতভাবে উৎসবপ্রবণতা আমাদের মাঝে সহজাত ভাবে বিকাশিত হয়। বারো মাসের মধ্যে একটি বিশেষ মাস আমাদের আছে, যার প্রতিটি দিন আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়, চিনিয়ে দেয়, ভাবতে  বলে- বাঙালী জাতির আত্মাদের। সেটি বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা, নিজের ভেতরকার ‘আমি’ কে খুঁজে পাওয়ার মেলা,  বাঙ্গালিয়ানার মেলা- অমর একুশে বইমেলা।
২১শে-বই-মেলা7

বইমেলার চিন্তাটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন। ষাটের দশকে তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর  বিদেশি বই সংগ্রহ করত। তিনি ‘Wonderful World of Books’ পড়তে গিয়ে ‘Book’ এবং ‘Fair’ শব্দ দুটি দেখে বেশ পুলকিত বোধ করেন। বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, সেই চিন্তার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বই মেলা। তারপর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বই মেলার যাত্রা শুরু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৪)
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা এ উৎসবে  লেখক- পাঠক- সমালোচক সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত লম্বা সময় জুড়ে উদযাপিত হয় না। প্রতিবছর বইমেলায় লেখক পরিচিতিতে পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক নতুন ও তরুণ মুখকে। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত বছরের মত এবছরও সরব ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, ‘গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো’।

১) নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?

মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব। জন্ম তারিখ ১৩ই নভেম্বর হওয়ার কারণে এবং লেখালেখি করি বলে অনেকেরই ধারণা হুমায়ূন স্যারের সাথে মিলিয়ে তারিখটা লিখে থাকি আমি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য- আমি এইদিনেই ধরাধামে নাযিল হয়েছি। এবং আমার বড় বোন হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসে প্রথমেই নাকি বলে উঠেছিল, “আম্মু? এইটা তো চাকমার মত দেখতে। তুমি ভুল বাচ্চা নিয়ে এসেছো। আল্লাহ্‌কে ফেরত দিয়াসো এই বাচ্চা।”
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করে এক বছর হল একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছি।

 

২) লেখালেখির শুরু কখন থেকে/ কীভাবে? লেখালেখির পেছনে আপনার পরিবারের কারও বিশেষ প্রভাব আছে কী?

বিরাট ইতিহাস! সোজা বাংলায় চিপায় পড়ে লেখালেখির সূত্রপাত। ঘটনাটা খুলেই বলা যাকঃ আমি ছোট বেলা থেকে আঁকা আঁকি করতে ভালবাসতাম। লেখা লেখিটা দুই চোখের বিষ ছিল। একজন মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কাগজ কলম নিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখার মত নিজে নিজে লিখে যাচ্ছে- কোনো কারণ ছাড়াই; খুব বিরক্ত হতাম বিষয়টা নিয়ে। আমার আব্বা দিনের পর দিন পেট মোটা ডায়েরি লিখে শেষ করতেন ক্লান্তিহীন ভাবে। আমি অবাক হতাম খুব। কিন্তু কখনো আগ্রহ হয়নি দুই কলম লিখার।

ক্লাস সেভেন পড়াকালীন সময়ে একদিন আমাদের ক্লাস টিচার কলিমুদ্দিন স্যার হঠাৎ করে ঘোষণা দিলেন, “আমাদের স্কুল ম্যাগাজিন বের হবে- তোমরা যে যা পারো লেখা জমা দিও।”
আমি মোটামুটি হতাশ মুখে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। কারণ লেখা লেখি জিনিসটা আমি কিছু পারি না। ছবি আঁকা চাইলেও পারতো, কিন্তু সেবার ছবি আঁকা চায়নি আমাদের কাছে। গল্প, কবিতা, ছড়া চেয়েছে শুধু। কারণ সেবারে দ্বিতীয়বারের মত ম্যাগাজিনটা বের হচ্ছিল। অনেক ধরণের সীমাবদ্ধতা ছিল স্কুলের।
যা হোক, স্কুলের এই বিজ্ঞপ্তির কথা বাসায় এসে বলিনি আমি। ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে চলে গিয়েছিলাম খেলার জন্য। ম্যাগাজিনের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। সে সময়ে খেলা ধুলাই ছিল আমার সব কিছু। স্বপ্ন দেখতাম জাতীয় দলে খেলবো একদিন। সেটারই প্রস্তুতি নিতাম প্রতিদিন। কাঠের বলে সম্ভব না হলেও মারুতি বলে খেলতাম। পড়াশোনাতেও দিন দিন খারাপ হচ্ছিল অবস্থা। সব পরীক্ষায় পাস করলেও বাংলায় সব সময় থাকতো ৩৪/৩৫ করে নম্বর।
ম্যাগাজিনের লেখা জমা দেয়ার তারিখে যে পেড়িয়ে যাচ্ছে আমার সেদিকে কোনই খেয়াল ছিল না। কারণ সেটার প্রতি তেমন কোন আগ্রহই বোধ করিনি তখন।
কিন্তু আমার বন্ধু শাহনূর মহা উৎসাহী মানুষ। লেখা জমা দেয়ার শেষ দিনে সে নিজে নিজে গিয়ে স্যারের কাছে দুইটা কবিতা জমা দিয়ে এলো নাম, রোল নাম্বার দিয়ে। জমা দিয়ে একান ওকান হাসি নিয়ে ফিরে এলো সিটে। আমি অবাক হয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কবিতাও লেখিস্‌! তাও আবার একটা না! দুই দুইটা কবিতা! কীভাবে লেখলি?”
শাহনূর বিশাল একটা জ্ঞানী জ্ঞানী হাসি নিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, “কাউরে বলিস না! কিশোর কন্ঠ থেইকা দুইটা কবিতা তুইলা আনছি! হে হে হে! একটা আমার নামে দিয়া দিছি, আরেকটা তোর নামে!”
স্যার সামনে থেকে ডাস্টার দিয়ে বাড়ি দিলেন টেবিলে, “কে কথা বলে রে! থাবরায়া দাঁত ফালায় দিবো!”
শাহনূর সাথে সাথে চুপ। আমি মোটামুটি অবিশ্বাসী একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন ওর দিকে।

এক বছরের মাথায় ম্যাগাজিনটা বের হল। ক্লাস এইটে পড়ি আমি তখন। ম্যাগাজিনের সব ইতিহাস ভুলে বসে আছি ততদিনে। ক্লাস এইটের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে সেদিন। রেজাল্ট কার্ড হাতে নিতেই মোটামুটি আকাশ ভেঙে পড়লো আমার মাথায়। এতদিন কেবল বাংলায় ফেল করতাম। এইবারে আগের রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছি। বাংলা, ইংরেজী দুই পত্র এবং অংক- মোট মাট চার সাবজেক্টে ডাব্বা খেয়েছি। বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আশাও শেষ।
আমাদের সেবারের ক্লাস টিচার ছিলেন আমান উল্লাহ্ মজুমদার স্যার। তিনি পরীক্ষায় খারাপ করলেই বেত দিয়ে পিটিয়ে পাছায় চামড়া ছাড়িয়ে নিতেন। সেই চামড়া বাঁচাতে প্যান্টের ভেতরে আরো দুই একটা মোটা জিনসের থ্রি কোয়ার্টার পরে যেতাম। তাতে শুধু প্যান্টের ওপর দিয়েই বিপদ যেত। কিন্তু সেদিন ঘটনাক্রমে আমি রিপোর্ট কার্ড হাতে নিতে স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে গেছি যথারীতি ধোলাই খাওয়ার জন্য, কারণ আগেই শুনেছি চারটা সাবজেক্টে ধরা খেয়েছি। স্যারের কাছে কার্ড নিতে গেলেই বেতিয়ে ভূত ছাড়াবেন।
কিন্তু কি আশ্চর্য! আমার চেয়ে দুই এক সাবজেক্টে কম ফেল মেরে রবিন স্যারের ধোলাই খেয়ে সিটে বিবর্ণ মুখে ফেরত যাওয়ার পরে আমি সিরিয়ালে স্যারের কাছে যেতেই স্যার হঠাৎ করে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকানোর বদলে খুব নরম দৃষ্টিতে তাকালেন; যেটা কষ্মিকালেও তিনি করেননি ক্লাসের কারো প্রতি! আমার হাতে রিপোর্ট কার্ড দিতে দিতে কেবল বললেন, “অসুবিধা নাই। মাঝে মাঝে খারাপ হতেই পারে। লেখা লেখি করতে পারাটাও খুব বড় একটা ব্যাপার।” আমার পিঠ থাবরে দিলেন তিনি আদর করে। আমি সিটে ফিরে এলাম রিপোর্ট কার্ড হাতে হতভম্ব মুখে। আমি তখনও ঘোর অমাবস্যায়। ঘটনাটা কি ঘটেছে যে আমান স্যার ধোলাইয়ের পরিবর্তে আমাকে বাহবা দিলেন ফেল করার জন্য?
রহস্যটা পরিষ্কার হতে সময় লেগেছিল সেদিন আরো চল্লিশ মিনিট। ক্লাস শেষ পিয়ন এসে যখন সবাইকে স্কুল ম্যাগাজিনগুলো হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল- আমি অলস মুখে পৃষ্ঠা ওল্টাতেই হকচকিয়ে গেলাম তৃতীয় পৃষ্ঠায় এসে। “দিলদার আলীর ছড়া” নামে বিশাল একটা ত্রিশ লাইনের কবিতা ছাপা হয়েছে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে। এবং নিচেই বড় বড় হরফে নাম লেখাঃ “মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব! সপ্তম শ্রেণি!”
তার পরের পৃষ্ঠা ওলটানো মাত্র ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে লেখা আরেকটা কবিতা পেলাম। “মজার দেশে। শাহনূর রশীদ। সপ্তম শ্রেণি।” হতবিহ্বলের মত শাহনূরের দিকে তাকাতেই দেখি বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে চওড়া একটা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা গেল, “আমি বলছিলাম না? এই কবিতা না ছাপায়া যাইবো কই! অখন তুই আর আমি সমান বিখ্যাত কবি এই পাবলিক ইস্কুলে!”
কিন্তু আমি খুশি হওয়ার বদলে আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ যতই ক্লাস এগোচ্ছে- একের পর এক স্যার এসে আমাকে আর শাহনূরকে প্রশংসা করে যাচ্ছেন। দিন শেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে আমাকে রীতিমত লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে বেঞ্চের নিচে। কারণ স্যার ম্যাডামেরা ক্লাসে ঢুকেই হাঁক দিচ্ছেন, “ফরহাদ-শাহনূর? দাঁড়ায়া যা। নিজেদের কবিতাগুলা আবৃতি করে শোনা!”
সমস্যা হল নিজের কবিতা নিজের মুখস্ত থাকে। অন্যের কবিতা মুখস্ত থাকে না- তারওপর যে কবিতা আগে চোখেই দেখিনি, সেটা গড় গড় করে আবৃতি করে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে থাকলেও শাহনূর কেউটেকো একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় প্রতি ক্লাসেই। এবং সুন্দর করে আবৃতি করে যেতে থাকে তার কবিতা। শালা ভাল মতে করে বাসা থেকে ঝেড়ে এসেছে আগে থেকেই। ধরেই নিয়েছিল তার কবিতা ছাপা হবে। পরে যদি আবৃতি করে শোনাতে বলে- এজন্য আগে থেকেই মুখস্ত করে রেখেছে। বিপদ যত সব আমার ওপর দিয়েই গেল। যদিও ধরা পড়িনি। বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে থাকায় সবাই ভেবে নিয়েছে চার সাবজেক্টে ধবল ধোলাই খেয়ে বাসায় চলে গেছি। ক্লাস করিনি।
বাসায় ফিরে সেই বিপদ মহীরুহ বৃক্ষের আকার নেয়া শুরু করল অতি দ্রুত। কারণ আমার ব্যাগ ঘেটে আম্মা আগেই রিপোর্ট কার্ড আর ম্যাগাজিন বের করে নিয়েছেন। আব্বা সে সময় চিটাগাং এ ছিলেন। আমরা থাকতাম সিলেটে। বাসার সবকিছু দেখা শোনার ভার ছিল আম্মার হাতে। তিনি রিপোর্ট কার্ডের অবস্থা দেখে তারপর গম্ভীর মুখে ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছিলেন। সামনে আমি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভয়াবহ ধোলাইয়ের পূর্ববর্তী অবস্থা এটা। আম্মা এবং আব্বা আমাকে মার ধোর করার আগে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকেন। তারপরেই বেত নিয়ে শুরু করে দেন উত্তম মধ্যম। যদিও আমার জীবনে মধ্যম ধোলাই বলে কিছুই ছিল না। আগা গোড়া পুরোটাই উত্তম এবং অতি উত্তম।
কিন্তু খুব অবাক হয়ে দেখলাম আম্মা ম্যাগাজিনের “দিলদার আলীর ছড়া”টা বের করা মাত্রই বিস্মিত গলায় বলে উঠলেন, “তুই আবার লেখা লেখি কবে থেকে করিস! আমি তো কিছুই জানতাম না!”
আমি মিনমিন করে বলতে গেলাম যেটা ওটা আমার লেখা না, শাহনূর কোত্থেকে এনে আমার নামে ছাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। আমি সেদিন সত্য কথাটা বলতে পারিনি। আমার সামনেই আমার মা আব্বাকে ফোন দিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, “তোমার ছেলের লেখা ছেপেছে স্কুল ম্যাগাজিনে! বিশাল একটা কবিতা লিখেছে শিহাব! তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবে!”
আম্মার মুখে সেদিন আমি যে হাসিটা দেখেছিলাম- সেটা ভোলা আমার পক্ষে কেন, পৃথিবীর কোনো ছেলেরই ভোলা সম্ভব না যদি তাদের মা সেভাবে হেসে থাকেন একবারও তাদের সামনে। আমি আর কিছু বলতে পারিনি।আমার আব্বা চিটাগাং থেকে পরেরদিনই চলে এসেছিলেন আমার সেই লেখা দেখার জন্য। ছেলে এক সাবজেক্টে ফেল করলে  যিনি পিটিয়ে পাত করে দিতেন, সেই মানুষটা অবাক হয়ে বলেছিলেন, “শিহাব তো দেখি আমার চেয়েও ভাল লেখে! এত ভাল লেখা শিখলি কীভাবে!”
তীব্র একটা অপরাধ বোধ থেকেই সেরাতে আমার লেখা লেখির শুরু হয়। দরজা বন্ধ করে দিয়ে লিখে যেতে থাকি একের পর এক কবিতা, গল্প, উপন্যাস। সেগুলো কোন ধরণের ভাল তো দূরের কথা- কোনো সাহিত্যই ছিল না। কিন্তু তারপরও লিখে যেতে থাকি আমি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। ভয়ংকর খেলা পাগল সেই ছেলেটা হঠাৎ করেই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে খাতা কলমের রাজ্যে ডুবে যায় চিরতরে। আমার কাহিনী এটুকুই ছিল।

 

৩) সাহিত্যিকরা স্বভাবত বইপ্রেমী হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে নিশ্চয়ই অনেক বই পড়েছেন, এখনও পড়ছেন। লেখক মাত্রই চেষ্টা করেন, তার চিন্তাগুলোকে তার লেখার মাধ্যমে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। আপনার পঠিত এমন কোন বই কি ছিলো যা আপনাকে লেখালেখি করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে?

ম্যালা বই! প্রথমেই চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, রমন। আমি খুব শখ করে ছবি আঁকতাম, এখনো আঁকি। নিজে নিজে চাচা চৌধুরীর তিন চারটা কমিকস বই বানিয়েছিলাম। যদিও কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং হয়েছিল সে সব। এবং আমি ছাড়া কেউ সেই সব ছবি এবং কাহিনী বুঝতে পারতো না। এরপর আরেকটু বড় হওয়ার পর তিন গোয়েন্দা। বই পড়ে পড়ে নিজেই তিন গোয়েন্দা খুলেছিলাম। আমি ছিলাম কিশোর পাশা। কিন্তু পাশের বাসার ছয় মাসের বাবু রাব্বির কম্বল উঠানের দড়ি থেকে চুরি যাওয়া কেস ছাড়া আর কোনো কেস পাইনি। এবং সেই কেসের এখনো অবধি কোনো সুরাহা হয়নি।

এরপর মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আর শাহারীয়ার কবিরের বই উঁই পোকার মত খেয়েছি। সত্যজিৎ রায়ের বই কিনে ছাপ দিয়ে দিয়ে তার মত করে ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম। বেঁচে থাকলে এবং সত্যজিৎ সাহেবকে সামনে পেলে নির্ঘাত বলে বসতাম- ক্যাম্নে পারো ম্যান! হাউ! এতো জটিল, দারুণ সব লেখা আর ছবি ক্যাম্নে হয় একজনকে দিয়ে?

অনেক পরে এসে পরিচয় হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সাথে। তাঁর ছোটদের বইগুলো গোগ্রাসে গিলেছি এক সময়। উপন্যাসগুলো এড়িয়ে গেছি যদিও। আর সুনীল, সমরেশ তো আছেই। তাদের লেখা খুব যে পড়েছি তা না, তবে বাছাই করে পড়েছি।

আর বর্তমানে যেটা করি- পড়ুয়া বন্ধুদের মুখে গল্প শুনেই কাটিয়ে দেই। বই পড়া এখন আর হয় না!

 

৪) অনেকের ধারণা এখন অধিকাংশ লেখকের লেখা একই প্যাটার্নের হয়ে থাকে, নতুনত্ব খুব কম পাওয়া যায় – আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টি? 

প্রশ্নটা মাথার উপর দিয়ে গেলো! এন্টেনাতেও বাড়ি খায়নি! তবু মই বেয়ে ওপরে উঠে খানিকটা আন্দাজে উত্তর দেই- আপনি সর্বভুখ শ্রেণীর পাঠক যদি হয়ে থাকেন- প্রশ্নটা অবান্তর। আর যদি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরীর লেখা পড়ে আরাম পান- তাহলে আপনি যথার্থই বলেছেন! আমাদের খাদ্যাভ্যাসের উপরেই হরি সাহেবের প্রসাদের ধরণ নির্ভর করে! নয়তো ভগবান কিংবা ঈশ্বর, আল্লাহ্‌ যে কোনো ম্যানুতেই সন্তুষ্ট থাকেন। (লেখক, পাঠক দুই তরফ থেকেই বললাম কথাটা)

 

৫) অনেকসময় দেখা যায়, নতুন লেখক/কবি’র বই পাঠকদের কাছে সেভাবে সমাদৃত হয় না। এটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমাদের সংকীর্ণতা কিংবা সীমাবদ্ধতার প্রকাশ। নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

সোজা সাপ্টা একটা উত্তর দেই। আমার ছোটবেলা হবি ছিল কার্টুন বই পড়া, রূপকথার বই পড়া আর ক্রিকেট খেলা। আরেকটু বড় হলাম, এবারে শখ বদলালো। যোগ হল গান শোনা, মুভি দেখা। আরেকটু বড় হলাম, মোবাইল কিনলাম। এর তার কাছ থেকে বিশিষ্ট রমণীদের ফোন নাম্বার নিয়ে রাতের পর রাত দীর্ঘ আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আরেকটু বড় হওয়ার পর কম্পিউটারে হাজারটা সফটওয়্যারের কাজে মজা পেয়ে গেলাম। শুরু করলাম সেসব নিয়ে গুতাগুতি, ফ্রি ল্যান্সিং। এর সাথে আছে বন্ধুদের সাথে নানান ধরণের হ্যাং আউট আর অমুক তোমুকের বিয়ে শাদী নিয়ে ছোটাছুটি।

এবারে বলেন, আমার এত ব্যস্ততার মাঝে বই পড়ার সময়টা কই? আমি নিজে বই কিনতে গেলেও তো সেই কোন ছোটবেলায় যাদের বই পড়ে আরাম পেয়েছি- তাদের বই’ই তো কিনবো!

নতুন লেখকদের ব্যাপারে (সত্যি বলতে নিজের কথাই) পাঠকদের মনোভাব একটু হলেও বদলানো উচিত বলবো। পৃথিবীতে সব লেখকই এক বস্তা, এক কলসী, এক জগ কিংবা এক গ্লাস সাহিত্য নিজের ভেতর নিয়ে আসে। এবং যতদিন যেই বস্তা, কলসী শেষ না হচ্ছে- সে লিখে যেতে থাকে। শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে যা লিখে- তা হচ্ছে সহজ কথা পিওর সাহিত্য, খাঁটি জিনিস। কিন্তু কলসের খবর পেতে পেতে পাঠকেরা বছর লাগিয়ে দেন। এবং যতদিন পড়া শুরু করেন সেই নতুন লেখকের বই, ততদিনে তিনি বুড়িয়ে গেছেন এবং কলস শেষ! যা লিখছেন- সেটা পানি বৈ কিছু নয়।

নতুন লেখকেরা দুই শ্রেণির মানুষের কাছে রীতিমত উপহাসের পাত্র। এক পাঠক। দুই প্রকাশক। কাহিনী তো বুঝতেই পারছেন। অথচ এই নতুন মানুষগুলো যে কতটা কাঁচা সোঁনা নিয়ে আপনাদের সামনে আসার জন্য খালি পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে- কেউ বুঝতে পারে না। বই প্রকাশের পর দেখা যায় প্রকাশক তার হাতে এক গাদা বই গছিয়ে দিয়ে বলছেন, বইগুলো বিক্রির ব্যাবস্থা করেন ভাই। নাহলে পথে বসতে হবে আমাকে!

কিন্তু মুখ ঝুকিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া সেই লেখকটার কথা আর কে বুঝবে- আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম, ফেরীওয়ালা নই!

 

৬) একটি বই লেখার ক্ষেত্রে ব্লগে লেখার অভিজ্ঞতা কতোটুকু সহায়ক বলে আপনি মনে করেন?

(বর্ণমালা ঠিক আছে তো ভাই? ভাষা আন্দলোনের মাসে যদি সিকোয়েন্স ঠিক রাখতে না পারি, তাও আবার লেখক হয়ে- ইজ্জত ব্লগেই মারা খাবে!) সহায়ক তো অবশ্যই। প্রত্যেক লেখকই ঠেলাগাড়ি টাইপ বস্তু। ঠেলা না দিলে চলে না। ব্লগ হচ্ছে ঠেলাওয়ালা সম্প্রদায়দের পান্থশালা। এখানে উত্তমরূপে যত্ন সহকারে ঠেলা প্রদান করে বই আকারে লেখার রূপ দেয়া হয়ে থাকে!

অনুপ্রেরণার কথা আর কীভাবে বলা যায়? যদিও আমার লেখালেখির সঙ্গে ব্লগ তেমন ভাবে জড়িত ছিল না, তবুও যতটুকু ব্লগিং করেছি- মন্দ না। আপনার গুণগুলোকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে অন্যকারো দরকার পরে। ব্লগ আপনাকে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।

 

৭) লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কথা মাথায় এলো আপনার প্রশ্নে। “চাট্টে ডাল-ভাতের বন্দোবস্ত না করে বাংলায় কেউ যেন সাহিত্যে না আসে”। লেখালেখিকে প্রফেশন হিসেবে নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। যে কয়টা দিন লিখে আনন্দ পাবো, মানুষের দিল খোলা প্রশংসা পাবো- লিখে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে। অখাদ্য লেখার চেয়ে চুপচাপ থাকাও শ্রেয়।

 

৮) আপনার নতুন প্রকাশিত বই ‘অমিয়েত্রা’সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন? 

গত বছরের মত এই বইমেলাতেও আদী প্রকাশন থেকে আমার একটা গাবদা গোবদা উপন্যাস বের হয়েছে। “অমিয়েত্রা” নাম। উপন্যাসটার সঠিক জেনার আমার জানা নেই। প্রকাশক সাহেব দীর্ঘ চিন্তা ভাবনা করে, মাথা খাঁটিয়ে, জনবল একত্রিত করে সিদ্ধান্তে এসেছে যে এটাকে “প্যারানরমাল-ফিকশন” উপন্যাস বলা যাবে। যদিও আমার ঠিক জানা নেই এটা সঠিক প্রকরণ হয়েছে কিনা। কারণ আমি বাংলায় এমনিতেই অনেক দূর্বল ছাত্র ছিলাম। তাই প্রকাশক সাহেবকে বিশেষ ঘাটাতে যাইনি। যা জেনার দিয়েছেন, মেনে নিয়েছি। (আগের বছর প্রথম উপন্যাস ‘অমিয়েন্দ্র’র বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে)

বইয়ের লেখক হিসেবে এটাকে সামাজিক উপন্যাস, প্রেমের উপন্যাস ও আধিভৌতিক উপন্যাস হিসেবেই বলবো। তিন সময়ের তিনটা কাহিনী উপন্যাসের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। মিলেছে একসূত্রে শেষে এসে। লেখার পর বইয়ের সাইজ দেখে খানিকটা সংশয়ে আছি এই ভেবে- দামটা একটু বেশি হয়ে গেল না তো! এমনিতেই নতুন লেখকের বই মানুষ কেনে না। তারওপর আবার ভোটকা বই, দামও বেশি- ক্যামনে কি!

উপন্যাসটা সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমার কিছু কথা ছন্দে বেঁধে তুলে দিলাম।

বেশ কিছুটা খেই হারালো 
বইয়ের পাতার ভাঁজগুলো সব
মিলিয়ে গেল শেষে,
এই বইতেই আমি ছিলাম
দেশান্তরীর বেশে।
এক শতকের ছয় পুরুষে
সেই জালেতে জড়ায় হেসে
শ্যাম রাঙা নীল মেয়ে,
মরায় জরায় ব্যাধির দোড়ায়
ধরবে তারে কে?
এক অদেখা ভূবন মেশে
এই ভূবনে হঠাৎ এসে
মন্দিরা ফের বাজলো রাতে-
কে যাবে? কার পালা?
শুধাই পাঠক- তোমরা সকল
খুলবে জটের তালা?”

 

৯) ধরুন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার বালিশের পাশে একটা প্রদীপ দেখতে পেলেন। এবং কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারলেন এটা আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ! আপনি আপনার যেকোনো তিনটা ইচ্ছে পূরণের সুযোগ পাবেন। আপনার সেই তিনটে ইচ্ছে কী হবে? 

এক. পৃথিবীর কঠিনতম কাজ- গুড নাইট থাকা সত্ত্বেও আমি মশারী টানিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করি যেহেতু, আমার বাকি জীবনের মশারী টানিয়ে দিতে হবে। (আমার ধারণা পৃথিবীতে মশার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই এদের মারা উচিত হবে না।)

দুই. আমি মনে মনে যা চিন্তা করবো লেখার জন্য- লিখে দিতে হবে।

তিন. এমন একটা রকেট বানিয়ে দিতে হবে যেটায় করে আমার যেই গ্রহে ইচ্ছা বেড়াতে যেতে পারবো। আমার খুব ইচ্ছা চাঁদে বসে পৃথিবীকে নিয়ে গল্প লেখার। সবাই তো পৃথিবীতে বসে চাঁদের কবিতা লিখি!

অমিয়েত্রা

বই: অমিয়েত্রা

লেখক: মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা ২০১৫

প্রকাশনী: আদী প্রকাশন

প্রচ্ছদ: মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

বইটির ধরণ: প্যারানরমাল-ফিকশন (সামাজিক, রোমান্টিক ও আধিভৌতিক, সায়েন্সফিকশন)

মূল্য: প্রিন্টেড মূল্য ৪০০ টাকা। ডিসকাউন্টে ২৮০ টাকা। রকমারী মূল্য ৩০০ টাকা।

 

সাহিত্যস্বর সম্পর্কে

সরব বাংলাদেশে বই জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কাজ করতে চায়। এই লক্ষ্যে আমরা নানান ধরনের কাজ করতে চাচ্ছি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একুশে বইমেলা ২০১২তে বিভিন্ন ব্লগারদের বই আমরা প্রোমোট করতে চাইছি। প্রতিদিন একজন করে ব্লগার/লেখক এর ইন্টারভিউ আমরা ছাপানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।