গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো(৪): একুয়া রেজিয়া

লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের বলা যেতে একটি জাতির আত্মা, জাতির প্রাণ। বই সে আত্মার ধারক, বাহক, প্রকাশক। বারো মাসে তেরো পর্বণের দেশ- বাংলাদেশ। জন্মগতভাবে উৎসবপ্রবণতা আমাদের মাঝে সহজাত ভাবে বিকাশিত হয়। বারো মাসের মধ্যে একটি বিশেষ মাস আমাদের আছে, যার প্রতিটি দিন আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়, চিনিয়ে দেয়, ভাবতে  বলে- বাঙালী জাতির আত্মাদের। সেটি বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা, নিজের ভেতরকার ‘আমি’ কে খুঁজে পাওয়ার মেলা,  বাঙ্গালিয়ানার মেলা- অমর একুশে বইমেলা।

২১শে-বই-মেলা7

বইমেলার চিন্তাটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন। ষাটের দশকে তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর  বিদেশি বই সংগ্রহ করত। তিনি ‘Wonderful World of Books’ পড়তে গিয়ে ‘Book’ এবং ‘Fair’ শব্দ দুটি দেখে বেশ পুলকিত বোধ করেন। বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, সেই চিন্তার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বই মেলা। তারপর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বই মেলার যাত্রা শুরু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৪)

 

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা এ উৎসবে  লেখক- পাঠক- সমালোচক সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত লম্বা সময় জুড়ে উদযাপিত হয় না। প্রতিবছর বইমেলায় লেখক পরিচিতিতে পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক নতুন ও তরুণ মুখকে। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত বছরের মত এবছরও সরব ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, ‘গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো’।

 

নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?

আমার ব্লগ নিক একুয়া রেজিয়া। মূল নাম, মাহরীন ফেরদৌস। বর্তমানে একটা ডিজিটাল ক্রিয়েটিভ ফার্মে কাজ করছি। ২০১০ সাল থেকে ব্লগিংয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে আসা। স্বাধীনচেতা, অন্যমনা। ভালোবাসি স্বপ্ন দেখতে, মানুষকে নিয়ে ভাবতে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় জীবন খুঁজে পাই। বিদেশি লেখকদের মধ্যে প্রিয়র তালিকায় আছেন মাক্সিম গোর্কি, ও হেনরি এবং পাওলো কোয়েলহো। বইয়ের জগতে আত্মপ্রকাশ একুশের বইমেলা ২০১৩ তে, ছোটগল্পের সংকলন “নগরের বিস্মৃত আঁধার” এর মাধ্যমে। ২০১৪ তে প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় বই এবং প্রথম উপন্যাস “কিছু বিষাদ হোক পাখি”। সেই উপন্যাসটি অনেক পাঠকপ্রিয় হবার পর চলতি বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আমার তৃতীয় বই ও দ্বিতীয় উপন্যাস “এই শহরে মেঘেরা একা”।

 

এটি আপনার প্রকাশিত তৃতীয় বই। আপনাকে একজন পুরোদস্তুর লেখিকা/লেখক বলা যেতে পারে। লেখালেখির শুরু কখন থেকে ও কীভাবে?

আমি আমার জীবনে প্রথম গল্প লিখেছিলাম ক্লাস ফোরে। গল্পের নাম ছিলো- “মানুষের মন”। ছোট্ট একটা মেয়ে তার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে নানুবাড়িতে বেড়াতে যায়। সেখানে সপ্তাহখানেক থাকে। নিজের বাড়ি ফিরে আসার পর তার মন অদ্ভুত রকমের খারাপ হয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে আমরা কেন সবাই একসাথে থাকি না। মানুষের কেন কাছের মানুষগুলোর থেকে দূরে দূরে বসবাস করতে হয়! এমন ধরণের নিছকই একটা সাদামাটা গল্প ছিলো যা পড়ে আমার বাসার সবাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়া স্কুল, কলেজ থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেছি। তবে মূলত ২০১০ সাল থেকে “চতুর্মাত্রিক” ব্লগে এসে ব্লগিং এর মাধ্যমে আমার লেখালেখির হাতেখড়ি হয়।

 

সাহিত্যিকরা স্বভাবত বইপ্রেমী হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে নিশ্চয়ই অনেক বই পড়েছেন, এখনও পড়ছেন। লেখক মাত্রই চেষ্টা করেন, তার চিন্তাগুলোকে তার লেখার মাধ্যমে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। আপনার পঠিত এমন কোন বই কি ছিলো যা আপনাকে লেখালেখি করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে?

আমার পরিবার অসম্ভব রকমের সংস্কৃতমনা। আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, দুলাভাই সবার মাঝেই গান, আবৃত্তি, সাহিত্যচর্চার অভ্যাস আছে। আমার ছোটবেলা থেকেই আমি শুনেছি অজস্র গান, নিয়মিত ক্লাসিক্যাল নাচ শিখেছি। পড়েছি শত শত বই। আমার কল্পনার জগতে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে রঙধনু সিরিজের অনুবাদ করা রাশান বইগুলো। এছাড়া তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, মাক্সিম গোর্কি, ও হেনরি, পাওলো কোয়েলহো, আলেক্সান্দর বেলায়েভ, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

 

অনেকসময় দেখা যায়, নতুন লেখক/কবি’র বই পাঠকদের কাছে সেভাবে সমাদৃত হয় না। এটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমাদের সংকীর্ণতা কিংবা সীমাবদ্ধতার প্রকাশ। নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আমি নিজেও একজন তরুণ, বলা যায় নতুন লেখক। এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি শেখার। প্রতি বছর বইমেলায় গেলে আমি নতুন নতুন লেখকদের বইগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। আমি বেশ কিছু প্রকাশনীর কথা জানি, যারা তরুণদের উৎসাহ দেন বই বের করার জন্য। কারণ নাহলে কিন্তু আমাদের সাহিত্যটা একপেশে হয়ে যেতো। আমার মনে হয় নতুন লেখকদের বই পড়ার বিষয় নিয়ে পাঠকরা যদি আরও ইতিবাচক মনোভাব রাখে তাহলে সেটা লেখক, পাঠক সবার জন্যই অত্যন্ত ভালো হবে। আর হ্যাঁ, আমি নতুন লেখক হবার পরেও স্বনামধন্য প্রকাশনী অন্যপ্রকাশ যেভাবে আমার লেখার গুনাগুন দেখে আমাকে একটা প্ল্যার্টফর্ম দিয়েছে এবং আমার সহব্লগার, পরিচিতজনের যেভাবে উৎসাহ দিয়েছে এটা যে কারও এগিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী।

 

একটি বই লেখার ক্ষেত্রে ব্লগে লেখার অভিজ্ঞতা কতোটুকু সহায়ক বলে আপনি মনে করেন?

-আমার লেখালেখির শুরুই কিন্তু ব্লগ থেকে। “চতুর্মাত্রিক”, সামহোয়্যার ইন ব্লগ, সরবসহ সবগুলো ব্লগ থেকেই আমি কিছু না কিছু শিখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি ব্লগের লেখার অভিজ্ঞতা, সহব্লগারদের সমালোচনা যে কারও বই লেখার ব্যাপারে বা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে খুবই উপকারি।

 

এটি আপনার লেখা তৃতীয় বই, প্রথম বই- ‘নগরের বিস্মৃত আঁধারে’ প্রকাশের পর পাঠকদের কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?

-প্রথম বই হিসেবে যথেষ্ঠ সাড়া পেয়েছিলাম আমি। এমনকি এখনও প্রচুর মানুষ আমার প্রথম বইয়ের জন্য বাংলাবাজার, রকমারিডটকম, পিবিএস, বাতিঘর এবং অন্যপ্রকাশে খবর নিচ্ছে।

 

লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

লেখালেখি কে আমার আসলে সাধনার মতো মনে হয়। লেখালেখি নিয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন আছে। লিখে যেতে চাই যতদিন শেষ নিঃশ্বাসটুকু আছে। আমার জীবনে আমি আসলে লেখালেখি শুরু করার পর সবচেয়ে বেশি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই আমার প্রাপ্তি, আমার অনুপ্রেরণা। এই অনুপ্রেরণা সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই আরও অনেক দূর।

 

আপনার নতুন প্রকাশিত বই “এই শহরে মেঘেরা একা” সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

– গল্প জেগে উঠে জীবন থেকেই। অযুত বছর ধরে জমে থাকা স্বপ্নকথাই এক একটা শব্দের গাঁথুনিতে সৃষ্টি করে গল্প। যে গল্প মানুষের পারস্পরিক দ্বন্দের, স্বপ্নভঙ্গের, বেঁচে থাকার কিংবা কারো হারিয়ে যাবার। সেই গল্পের আকার যখন বিষণ্ণতার মেঘে মিশে মহীরুহ হয়ে ওঠে, জীবন আর স্বপ্নের কাঁটাতারে তখন বাঁধা থাকে সামান্যই। স্বপ্ন যেখানে জীবনের চোখ রাঙ্গানিতেও রঙ হারায় না, গল্পগুলো হয়ত সঞ্জীবনী খুঁজে পায় সেখানেই। এইসব কিছুর ভীড়েই গল্প খুঁজে বেড়ায় একটি মেয়ে। বিষণ্ণতায় ডানা মেলে ওর স্বপ্নগুলো। মেঘ হয়ে কোন এক দূর অজানায় নিজেকে খুঁজে পেতে আকুল মেয়েটি একটু একটু করে আবিষ্কার করে, প্রাত্যাহিকতায় আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা ওর আশেপাশের মানুষগুলোও ডুবে আছে আকাশ সমান স্বপ্নে। সে টের পায় এই এক পলকের ছোট্ট জীবনটাকে অযথাই খুব জটিল করে ফেলি আমরা। মনোগ্রাফে দাগ কেটে যাওয়া সময়গুলোকে আমরা নিতান্ত অবহেলাতে কোন এক ধুলোপড়া কোণে ছুঁড়ে দেই। আমরা ভুলে যাই, এই পৃথিবীতে আমাদের গল্প লিখা হয় একবারই….

 

ধরুন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার বালিশের পাশে একটা প্রদীপ দেখতে পেলেন। এবং কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারলেন এটা আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ! আপনি আপনার যেকোনো তিনটা ইচ্ছে পূরণের সুযোগ পাবেন। আপনার সেই তিনটে ইচ্ছে কী হবে?

আমি যদি বুঝতে পারি এটা আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ, তাহলে সবার আগে সেই মজাদার জ্বিনি কে সারাজীবনের জন্য আমার বন্ধু হয়ে থাকতে বলবো। তারপর চাইবো মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলার ক্ষমতা, আর পৃথিবীর সব বই পড়ে ফেলার মতো সময়…

আমাদের জীবন আসলে খুব ছোট। তাই যতদিন বাঁচি মানুষের ভালোবাসা, লেখালেখি, বই, গান, জ্যোৎস্না, আকাশভাঙা বৃষ্টি দেখেই একটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই।

এই শরের মেঘেরা একা

লেখক- একুয়া রেজিয়া

বইয়ের নাম- এই শহরে মেঘেরা একা

প্রকাশনী- অন্যপ্রকাশ

বইয়ের ধরণ- উপন্যাস

প্রচ্ছদশিল্পী- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মূল্য- ১৩১ টাকা (ডিসকাউন্টের পর)

রকমারি তে অর্ডার দেওয়ার লিংক- http://www.rokomari.com/book/92494

 

সাহিত্যস্বর সম্পর্কে

সরব বাংলাদেশে বই জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কাজ করতে চায়। এই লক্ষ্যে আমরা নানান ধরনের কাজ করতে চাচ্ছি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একুশে বইমেলা ২০১২তে বিভিন্ন ব্লগারদের বই আমরা প্রোমোট করতে চাইছি। প্রতিদিন একজন করে ব্লগার/লেখক এর ইন্টারভিউ আমরা ছাপানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে উদ্যোগ, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো(৪): একুয়া রেজিয়া

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।