গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রায় ২৫টি প্রেক্ষাগৃহে একযোগে মুক্তি পেল অনিমেষ আইচ পরিচালিত এবং প্লে হাউজ প্রোডাকশন নিবেদিত চলচ্চিত্র ‘জিরো ডিগ্রী’। এতে অভিনয় করেছেন- মাহফুজ আহমেদ, জয়া আহসান, দিলরুবা ইয়াসমিন রুহি, মীর রাব্বি, তারিক আনাম খান, টেলি সামাদ, ইরেশ যাকের প্রমুখ। পরিচালক একটি টিভি ইন্টারভিউতে তাঁর এই মুভিটিকে ‘Psychological Thriller’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই মুভিতে জেমসের গাওয়া একটি গান ‘প্রেম ও ঘৃণা’ ফেসবুকে বেশ আলোচনার ঝড় তুলেছিল। এছাড়া এই মুভিটির ট্রেইলার দেখার পর থেকে এটি দেখার জন্য আমি বেশ আগ্রহী হলাম। আর আমরা যারা বাংলা নাটকের ভক্ত তাদের কাছে অনিমেষ আইচের নাম ও কাজ সম্পর্কে বেশ ভালই ধারণা আছে। কিভাবে যেন ৬ তারিখ সকালে স্টার সিনেপ্লেক্সে ঢুঁ মারতেই সকালের শো মানে একেবারে প্রথম শো এর টিকেটটাই পেয়ে গেলাম। ফলে অনিমেষদা আর তাঁর টিমের সাথে মুভি দেখার সুযোগটাও হয়ে গেল। তাহলে এবার মূল গল্পে আসা যাক!
মুভিটির মূল গল্প আবর্তিত হয়েছে অমিত (মাহফুজ আহমেদ) ও সোনিয়া (জয়া আহসান) –কে কেন্দ্র করে। স্ত্রী নীরা ও একমাত্র সন্তান অর্ককে নিয়ে অমিতের সুখের সংসার। অমিত একজন ইঞ্জিনিয়ার ও নীরা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। সুখ ও আনন্দের কোন কমতি ছিল না ওদের। কিন্তু হঠাৎ একদিন অমিত বুঝতে পারে যে নীরা তাকে ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে। পরে এটিও বুঝতে পারে যে তাকে ধোঁকা দিয়ে নীরা এতদিন আরেকজনের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। নীরার এরকম আকস্মিক চলে যাওয়ায় মুষড়ে পড়ে অমিত। তারপর একটি সড়ক দুর্ঘটনায় অর্কের মৃত্যুর পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে।
অন্যদিকে সোনিয়া পাটোয়ারী বংশের মেয়ে। ছোটবেলায় সে তার বাবাকে দেখেছে তার মাকে খুন করতে, নারী ও পানীয়তে আসক্ত হয়ে নিষ্ঠুরতা চালাতে। পরে সোনিয়ার তৃতীয় মা তাকে এরকম পরিবেশ থেকে পালিয়ে যেতে বলে। কিন্তু ঢাকায় এসেও রেহাই পায় না সোনিয়া। চাকরির প্রয়োজনে যে কর্মক্ষেত্রেই গিয়েছে সেখানেই দেখেছে ভদ্র মানুষের আবরণে লুকিয়ে থাকা পশুত্বকে। জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে যখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখনই তার জীবনে ভালবাসার ছোঁয়া দিয়ে আবির্ভূত হয় ওয়াহিদ। ওয়াহিদকে ঘিরে সোনিয়া যে বিশ্বাসের জাল বুনতে শুরু করে তা যেন মুহূর্তেই ভেঙ্গে যায়। ওয়াহিদ সোনিয়াকে ঠেলে দেয় আরও অন্ধকার দুনিয়াতে। এভাবে সোনিয়া মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
অমিত ও সোনিয়া দুটি চরিত্র সমাজের দুটি বিপরীত শ্রেণীকে উপস্থাপন করে। কিন্তু এই দুটি শ্রেণীতেই একটি সাধারণ মিল হল অবক্ষয়। আর এই অবক্ষয়ের প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীকরূপে তারা আবির্ভূত হয় মুভিটির শেষ অর্ধাংশে। মানসিক হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়ে তারা প্রতিশোধের আগুনে পুড়তে থাকে। তাদের জীবন যারা ধ্বংস করেছে তাদেরকে একে একে খুঁজে বের করে তারা লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এভাবেই মূলত ‘প্রেম’ ও ‘ঘৃণা’ এই দুটি জাগতিক বিষয়ের এক অসাধারণ মিশেল ঘটেছে মুভিটিতে।
এবার আসা যাক মুভিটির বিশ্লেষণে।
- অভিনয়ের ক্ষেত্রে বলব সবাই দারুণ পারফর্ম করেছেন। নীরা ও সোনিয়া দুটি চরিত্রই অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। জয়া আহসান ও রুহি দুজনই বেশ সাহসী অভিনয় করেছেন। মাহফুজ আহমেদ এর আগেও অনেক নাটক ও কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও ‘জিরো ডিগ্রী’ তে তাঁর অভিনয় দেখে আমার মুখে একটি কথাই এসেছে ‘হ্যাটস অফ’। তিনি আবারও প্রমাণ করেছেন যে উনি কতটা শক্তিশালী অভিনেতা! আর অন্যান্য চরিত্রগুলোও দারুণভাবে পারফর্ম করে পুরো মুভিকে গতিশীল করেছে। এক্ষেত্রে টেলি সামাদের কথা বিশেষভাবে বলতে হয় যে, এতটা অসুস্থ থাকার পরও উনি অত্যন্ত সুন্দর অভিনয় করেছেন।
- পরিচালনার ব্যাপারে বলতে গেলে কথা শেষ হবে না। অনিমেষ আইচ বুঝিয়েছেন কিভাবে সিনেমা বানাতে হয়। সিনেমা আর নাটকের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তাঁর এই কাজটি দেখে বুঝলাম। সাইকো থ্রিলারধর্মী এই ছবিটি আর্ট ও কমার্শিয়াল এই দুইয়ের মিশেলে গড়ে উঠেছে। ঝড়ের রাতে নীরাকে নিয়ে অমিতের হাসপাতালে ছুটে চলা, বৃষ্টিস্নাত রাতে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বোরখা পরিহিত অনেক মেয়ে, তাদের রহস্যময় আচরণ ও সোনিয়ার একাকী দাঁড়িয়ে থাকা (পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ভাবগুলো বুঝাতে আমার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে), খোলা আকাশ আর উইন্ড চাইম, কচুরিপানার ডোবায় পাথরের আঘাত, মুভির একেবারে শেষ অংশে ‘লাস্ট সাপার’ ও ‘কানামাছি খেলা’ -এরকম আরও অনেক দৃশ্য ধারণেই নৈপুণ্য দেখিয়েছেন পরিচালক।
- এই মুভির প্রত্যেকটি গান সুন্দর। একদম বাড়িয়ে বলছি না। চাইলে আপনারা মুভিটি দেখে বিচার করতে পারেন। কোনরকম আইটেম সং ছিল না। বরং গানগুলোর মধ্য দিয়ে অনেকটুকু গল্প বলা হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধি ও ন্যান্সির ‘কিছু কথা’ গানের প্রারম্ভে জীবনানন্দ দাসের কবিতার কিছু লাইন মনে বেঁধেছে-
তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে,
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে,
শিশিরকনার মতন শূন্যে ঘুরে,
শুনেছিলাম পদ্মপাতা আছে অনেক দূরে,
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে,
নদী-সাগর কোথায় জলে বয়ে,
পদ্মপাতায় জলবিন্দু হয়ে।
সন্ধি ও ন্যান্সির ‘কিছু কথা’ গানটির লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=4r2vsS8WxSg
সামিনা চৌধুরী ও প্রবর রিপনের ‘যাও তুমি যাও’ গানের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=CjKQe3tOCbM
মৌমিতার ‘বিমূর্ত এই রাত্রি’ গানের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=8HX03nsvP-8
জেমসের ‘প্রেম ও ঘৃণা’ গানের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=isXB4osIquk
মুভি ট্রেইলারের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=tAuCXLYAofc
পরিশেষে বলব, সারা বছর দেখার মত বাংলা সিনেমা দেখতে হলে কলকাতার মুভির উপরই নির্ভর করে থাকতে হয়। আমাদের দেশে যে ভাল সিনেমা হয় না তা নয়, কিন্তু সংখ্যায় কম হওয়ার দরুণ ওপার বাংলার মুভি দেখা ছাড়া উপায় নেই। ‘জিরো ডিগ্রী’ দেখার পর এটুকু বলতে পারি যে, আমাদের দেশেও থ্রিলারধর্মী ভাল ছবি হয়। এর চেয়ে বেশি কিছু কমেন্ট করতে চাই না। বাকিটুকু পাঠকরা দেখেই বলবেন কেমন হয়েছে পুরো ছবিটা।