গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকদের ভাবনাগুলো(৬): দেবাশীষ মজুমদার

লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের বলা যেতে একটি জাতির আত্মা, জাতির প্রাণ। বই সে আত্মার ধারক, বাহক, প্রকাশক। বারো মাসে তেরো পর্বণের দেশ- বাংলাদেশ। জন্মগতভাবে উৎসবপ্রবণতা আমাদের মাঝে সহজাত ভাবে বিকাশিত হয়। বারো মাসের মধ্যে একটি বিশেষ মাস আমাদের আছে, যার প্রতিটি দিন আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়, চিনিয়ে দেয়, ভাবতে  বলে- বাঙালী জাতির আত্মাদের। সেটি বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা, নিজের ভেতরকার ‘আমি’ কে খুঁজে পাওয়ার মেলা,  বাঙ্গালিয়ানার মেলা- অমর একুশে বইমেলা।

২১শে-বই-মেলা7

বইমেলার চিন্তাটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন। ষাটের দশকে তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর  বিদেশি বই সংগ্রহ করত। তিনি ‘Wonderful World of Books’ পড়তে গিয়ে ‘Book’ এবং ‘Fair’ শব্দ দুটি দেখে বেশ পুলকিত বোধ করেন। বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, সেই চিন্তার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বই মেলা। তারপর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বই মেলার যাত্রা শুরু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৪)

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা এ উৎসবে  লেখক- পাঠক- সমালোচক সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত লম্বা সময় জুড়ে উদযাপিত হয় না। প্রতিবছর বইমেলায় লেখক পরিচিতিতে পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক নতুন ও তরুণ মুখকে। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত বছরের মত এবছরও সরব ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, ‘গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো’।


 ১) নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?

জন্ম পদ্মা আর মেঘনার সঙ্গমে বেড়ে ওঠা শহর চাঁদপুরে হলেও সে শহরে খুব বেশীদিন থাকা হয়নি, সরকারি চাকরিজীবী বাবার বদলির সুবাদে চট্টগ্রাম শহরে আসা, আর এখানেই থিতু হয়ে যাওয়া, মাঝখানে ক’বছর ভারতে পড়তে যাওয়া ছাড়া জীবনের এ অব্দি এই সমূদ্র শহরেই কেটেছে। বর্তমানে একটা বেসরকারি কোম্পানীতে মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি ছাড়া ছবি তোলা একটা প্রধান শখ, আর এই শখ মেটাতে গিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। গ্রাফিক্স ডিজাইনে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নেই, শখের বশেই এই কাজ করে যাওয়া, এই ক্ষেত্রে এবার একটা মাইল ফলক স্থাপন হয়েছে, নিজের বই ‘অস্থিরতার নাম দেশলাই কাঠি’ সহ কবি হাসান মসফিক-এর ‘মায়াফরিঙ’ এবং কবি চৌধুরী ফাহাদ-এর ‘কবি কোন চরিত্রে নাই’ এর প্রচ্ছদ করা হয়েছে। ‘বিভুঁই’ ব্লগজিনের সাথে এর জন্মলগ্ন থেকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি।

 

২) লেখালেখির শুরু কখন থেকে/ কীভাবে? লেখালেখির পেছনে আপনার পরিবারের কারও বিশেষ প্রভাব আছে কী?

লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল পাড়ার পূজা সাময়িকীতে গল্প লিখবার মাধ্যমে, সে সময় কখনো সেভাবে ভাবিনি এক সময় কবিতা লিখব, পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো বাধ্যতামূলকভাবেই পড়তে হত, এছাড়া সেসময় কবিতা পড়তে তেমন ভাল লাগত না, তবে গল্প, উপন্যাস প্রচুর পড়া হত। কবিতা একদিন হঠাৎ করেই লেখা। এরপর বন্ধু বান্ধবদের উৎসাহে চালিয়ে যাওয়া, আর তাদেরই তাগাদায় ২০১৩ বই মেলায় প্রথম বই প্রকাশ করে ফেলা, নাম ছিল ‘অন্যদিন’। এরপর এক বছরের বিরতি দিয়ে এবছর আবার। পারিবারিকভাবে তেমন প্রভাব কারও আছে এটা আদতে বলা যাচ্ছেনা, তবে শুনেছি ঠাকুরদা একসময় পুঁথি লিখতেন। আমার পড়া হয়নি কখনো, ১৯৭১ এ পাকিস্তানীরা আমাদের গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, তাই সেসব পড়বার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

 

৩) সাহিত্যিকরা স্বভাবত বইপ্রেমী হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে নিশ্চয়ই অনেক বই পড়েছেন, এখনও পড়ছেন। লেখক মাত্রই চেষ্টা করেন, তার চিন্তাগুলোকে তার লেখার মাধ্যমে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। আপনার পঠিত এমন কোন বই কি ছিলো যা আপনাকে লেখালেখি করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে?

এই প্রশ্নটা সব সময়ই আমাকে বিব্রত করে, মানুষতো প্রতিটা মুহুর্তে শিখছে, শিখবারতো শেষ নাই, যা পড়ি তা থেকেই কিছুনা কিছু শিখি, তাই নির্দিষ্ট করে কোন বিশেষ বইয়ের কথা বলে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব না। ঠিক যেমন সব চাইতে প্রিয় গান, প্রিয় ফুল কিংবা প্রিয় রঙ বলে আমার কিছু নেই। আর লেখালেখির প্রসঙ্গে বলতে হয় কেবল কোন বই-ই না, কোন সিনেমা দেখে কিংবা কোন গান শুনেও আমার মধ্যে কবিতা ভাবনা এসেছে, সুতরাং সেভাবে বিশেষ বলে আমার কিছু নেই, সবই ভালবাসি।

 

৪) অনেকের ধারণা এখন অধিকাংশ লেখকের লেখা একই প্যাটার্নের হয়ে থাকে, নতুনত্ব খুব কম পাওয়া যায় – আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টি?

দেখুন, লেখকের কাজ লিখে যাওয়া, বিচারের ভার পাঠকের, পাঠক যদি কারও লেখা পছন্দ করে ফেলে তবে ওইসব প্যাটার্নের দোহাই দিয়ে কি হবে, আর দুনিয়ার তাবত মানুষকেতো আপনি সন্তুষ্ট করেতে পারবেন না, আমার যেটা মনে হয়, আজ যে লেখাটা পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে, সেটা অন্য কখনো পড়লে তেমন ভাল নাও লাগতে পারে, এর বিপরীতটাও হতে পারে। আমি মনে করি কারও লেখা ভাল লাগা মন্দ লাগা পাঠকের সেই সময়ের মেণ্টাল সিচ্যুয়েশনের উপর নির্ভর করে।

 

৫) অনেকসময় দেখা যায়, নতুন লেখক/কবি’র বই পাঠকদের কাছে সেভাবে সমাদৃত হয় না। এটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমাদের সংকীর্ণতা কিংবা সীমাবদ্ধতার প্রকাশ। নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আসলে সবাইতো পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক। এই পাঠক শব্দটার মধ্যে অনেক গভীরতা আছে, তেমনি প্রকৃত পাঠক ক’জন! আমারতো মনে হয় প্রকৃত অর্থে যিনি পাঠক তাঁর কাছে নতুন লেখক পুরান লেখক বলে কোন টার্ম নেই। এখন লেখকতো আর মাছ ব্যাপারী না, যে পুকুরের তাজা দেশী মাছ আছে বলে হাকবে। তেমন পাঠক হলে ঠিকই বই খুঁজে নেবে।

 

৬) একটি বই লেখার ক্ষেত্রে ব্লগে লেখার অভিজ্ঞতা কতোটুকু সহায়ক বলে আপনি মনে করেন?

প্র্যাকটিসেরতো কোন বিকল্প নাই। যে কোন কাজে প্র্যাকটিসটাই মূল, ব্লগ তেমন একটা প্লাটফর্ম সবার জন্য, নিজেকে পরিশীলিত করবার এই সুযোগতো আগে তেমন একটা ছিলনা, এই দিক দিয়ে আমার নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।

 

৭) লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

কোন বিশেষ পরিকল্পনা নাই, লিখে যেতে চাই যতদিন সম্ভব, একটা উপন্যাস লিখবার চেষ্টা করছি এই সময়ে, এইটুকুই।

 

৮) আপনার নতুন প্রকাশিত বই সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

নতুন যে কাব্যগ্রন্থটা এবার প্রকাশিত হল অনুপ্রাণন প্রকাশনী থেকে তার নাম ‘অস্থিরতার নাম দেশলাই কাঠি’। এবারের বইটা দুইভাগে সাজানো হয়েছে – ‘দীর্ঘশ্বাস অথবা অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক’ এবং ‘অভিশপ্ত ডায়রি থেকে’। এই দুটো সিরিজ নিয়ে বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়েছিল, তার থেকে বাছাই করা কিছু স্থান পেয়েছে এবারের বইতে।

 

৯) ধরুন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার বালিশের পাশে একটা প্রদীপ দেখতে পেলেন। এবং কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারলেন এটা আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ! আপনি আপনার যেকোনো তিনটা ইচ্ছে পূরণের সুযোগ পাবেন। আপনার সেই তিনটে ইচ্ছে কী হবে?

ক) পৃথিবীর তাবৎ নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার জন্য একটা দারুন আবাস।

খ) দুই বাংলাকে আলাদা করবার ইতিহাসটা বদলে ফেলা।

গ) যার যার ধর্ম তার তার এই ধারনাটা প্রতিষ্ঠিত করা।

অস্থিরতার নাম দেশলাই কাঠি

বই- অস্থিরতার নাম দেশলাই

কবি- দেবাশীষ মজুমদার

প্রকাশকাল- অমর একুশে বইমেলা ২০১৫

প্রকাশনী- অনুপ্রাণন প্রকাশনী

প্রচ্ছদ- দেবাশীষ মজুমদার

বইটির ধরণ-  কাব্যগ্রন্থ

মূল্যঃ ১৫০ টাকা

সাহিত্যস্বর সম্পর্কে

সরব বাংলাদেশে বই জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কাজ করতে চায়। এই লক্ষ্যে আমরা নানান ধরনের কাজ করতে চাচ্ছি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একুশে বইমেলা ২০১২তে বিভিন্ন ব্লগারদের বই আমরা প্রোমোট করতে চাইছি। প্রতিদিন একজন করে ব্লগার/লেখক এর ইন্টারভিউ আমরা ছাপানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে উদ্যোগ, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।