গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো(১০): শামীম আহমেদ

লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের বলা যেতে একটি জাতির আত্মা, জাতির প্রাণ। বই সে আত্মার ধারক, বাহক, প্রকাশক। বারো মাসে তেরো পর্বণের দেশ- বাংলাদেশ। জন্মগতভাবে উৎসবপ্রবণতা আমাদের মাঝে সহজাত ভাবে বিকাশিত হয়। বারো মাসের মধ্যে একটি বিশেষ মাস আমাদের আছে, যার প্রতিটি দিন আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়, চিনিয়ে দেয়, ভাবতে  বলে- বাঙালী জাতির আত্মাদের। সেটি বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা, নিজের ভেতরকার ‘আমি’ কে খুঁজে পাওয়ার মেলা,  বাঙ্গালিয়ানার মেলা- অমর একুশে বইমেলা।

২১শে-বই-মেলা7

বইমেলার চিন্তাটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন। ষাটের দশকে তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর  বিদেশি বই সংগ্রহ করত। তিনি ‘Wonderful World of Books’ পড়তে গিয়ে ‘Book’ এবং ‘Fair’ শব্দ দুটি দেখে বেশ পুলকিত বোধ করেন। বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, সেই চিন্তার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বই মেলা। তারপর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বই মেলার যাত্রা শুরু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৪)

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা এ উৎসবে  লেখক- পাঠক- সমালোচক সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত লম্বা সময় জুড়ে উদযাপিত হয় না। প্রতিবছর বইমেলায় লেখক পরিচিতিতে পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক নতুন ও তরুণ মুখকে। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত বছরের মত এবছরও সরব ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, ‘গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো’।

 

) নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি। পরবর্তীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ থেকে সম্পন্ন করেছি মাস্টার্স অফ পাবলিক হেলথ। হল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডাম থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইড এ কাজ করছি হেড অফ পলিসি এন্ড এডভোকেসি হিসেবে। এছাড়াও আছি বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশনের জেনেরাল সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য হিসেবে।

কবিতা ভালোবাসি। ভালোবাসি মানুষ, প্রকৃতি এবং দেশকে। মনে করি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই দিতে পারে মানুষের প্রকৃত মুক্তি, রাজনীতি বিমুখতা নয়।

 

) লেখালেখির শুরু কখন থেকে/ কীভাবে?লেখালেখির পেছনে আপনার পরিবারের কারও বিশেষ প্রভাব আছে কী?

লেখালেখির শুরু স্কুল জীবন থেকেই। তখন থেকেই কবিতা লিখছি। নটর ডেম কলেজের ইংরেজি সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘চিট-চ্যাট’ এ সম্পাদকের কাজ করেছি দু’বছর। তখন প্রায় অর্ধশত ইংরেজি কবিতা লিখেছি। গত বইমেলায় শুদ্ধস্বর থেকে বেড়িয়েছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একফোঁটা বৃষ্টি হতে যদি’ যা বিশেষভাবে পাঠক সমাদৃত হয়। এছাড়াও আদী প্রকাশনী থেকে হুমায়ুন আহমেদ স্মরণে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। আর নানা গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে।

সাহিত্যপ্রেমী পরিবার আমার। চাচা’রা প্রায় সবাই লেখেন রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে। দাদা ১৯৩০ সালে ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রভাব আমার লেখায় নানাভাবে নানাসময় এসেছে।

 

) সাহিত্যিকরা স্বভাবত বইপ্রেমী হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে নিশ্চয়ই অনেক বই পড়েছেন, এখনও পড়ছেন। লেখক মাত্রই চেষ্টা করেন, তার চিন্তাগুলোকে তার লেখার মাধ্যমে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। আপনার পঠিত এমন কোন বই কি ছিলো যা আপনাকে লেখালেখি করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে?

বাংলাদেশের বেড়ে ওঠা আর দু-দশ’জন মানুষের মতই হুমায়ুন আহমেদের লেখনী আলোড়িত করেছে প্রচন্ডভাবে। কবি আবুল হাসানের কবিতা মধ্যরাতে ঘর থেকে বের হতে প্রণোদিত করে এখনও। তাই ঘরের উষ্ণতার চাইতে জ্যোৎস্নার আলোয় হারিয়ে যাওয়ার অনিশ্চয়তা প্রেমময় মনে হয় অনেক বেশী। শহীদুল জহিরের ছোটগল্প পড়লে মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন যদি না মরে যাবার আকাঙ্ক্ষা না জাগে!

 

) অনেকের ধারণা এখন অধিকাংশ লেখকের লেখা একই প্যাটার্নের হয়ে থাকে, নতুনত্ব খুব কম পাওয়া যায় আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টি?

এ বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণ করি। তরুণরা দু’হাতে লিখছেন এবং তাদের লেখায় প্রচুর বৈচিত্র্য বিরাজমান। সমস্যা হচ্ছে বই বের করার সুযোগ অনেক বেড়ে যাওয়াতে ভাল লেখক যেমন তৈরি হচ্ছে তেমন অনেক লেখা আসছে যা পাঠককে হতাশও করছে বটে। প্রতিভাবান লেখক যারা বৈচিত্র্যময় লেখা লিখছেন তাদের সাথে পাঠকদের যোগসূত্রটা তৈরি হচ্ছে না সেভাবে। বইমেলা ছাড়া সারাবছর মিডিয়ায় লেখক-পাঠক পরিচয়ের আর কোন সুযোগ থাকে না বললেই চলে। তাই পাঠকরা জানতে পারছেন না বৈচিত্র্যময় লেখা সম্পর্কে। এক্ষেত্রে পাঠকদের তেমন দোষ দেয়া যায় না কারণ মেলায় প্রকাশিত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে থেকে তাদের পক্ষে সঠিক বইটি বেছে নেয়া কঠিন। এক্ষেত্রে মিডিয়া এবং সাহিত্য সমালোচকদের উচিত একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়া। পত্রিকাগুলোও সারাবছর নতুন এবং সৃজনশীল লেখকদের সাথে পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগের একটি উত্তম মাধ্যম হতে পারেন।

 

) অনেকসময় দেখা যায়, নতুন লেখক/কবির বই পাঠকদের কাছে সেভাবে সমাদৃত হয় না। এটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমাদের সংকীর্ণতা কিংবা সীমাবদ্ধতার প্রকাশ। নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আমি পাঠকদের কোন দোষ দেই না। আমি মনে করি তারা যথেষ্টই নতুনদের লেখা সমাদর করেন যদি তারা জানতে পারেন সেই কবি কিংবা সাহিত্যিক ভালো লিখছেন। কিন্তু পাঠকের কাছে এই তথ্যটি পৌঁছে দেবার দায়বদ্ধতা যাদের তারা কতটুকু করছেন এই প্রশ্ন থেকেই যায় এবং এর দায় প্রকাশকরাও এড়াতে পারেন না। তারা যখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত লেখক, কবির বইয়েরই খবর দেন। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, প্রকাশক, পত্রিকাসহ সংশ্লিষ্ট সবার এগিয়ে আসা উচিত যাতে পাঠকরা নতুন লেখক, কবি এবং তাদের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে পারেন।

 

৬) একটি বই লেখার ক্ষেত্রে ব্লগে লেখার অভিজ্ঞতা কতোটুকু সহায়ক বলে আপনি মনে করেন? 

আমরা একসময় বলতাম সেবা প্রকাশনী আমাদের একটা বড় পাঠক সমাজ তৈরি করে দিয়েছে। আমি মনে করি সরবসহ অন্যান্য ব্লগ গত অর্ধযুগে আমাদের এখানে শুধু পাঠক নয় লেখক, কবি তৈরিতেও একটি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্লগ এমন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছে যা আস্তে আস্তে আসলে মূলধারার মিডিয়াকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।

 

) লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

লিখছি বেছে বেছে। ইতিমধ্যে দু’টি কাব্যগ্রন্থের পর পরবর্তী মেলাকে সামনে রেখে পাঁচটি বই লেখার আলোচনা চলছে প্রকাশকদের সাথে। এর মধ্যে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিমিষেই নিষিদ্ধ তুমি’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘অদ্ভুত ইঙ্গিত আসে ঈশ্বর থেকে’র কাজ গুছানো হয়েছে। আসবে আগামী বইমেলায়। এছাড়া উন্নয়ন অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে দু’টি বইয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে ভিন্ন দু’টি প্রকাশনা সংস্থার সাথে।

 

৮) আপনার নতুন প্রকাশিত বই ‘যে প্রহর কুয়াশার কাছে ঋণী’ সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

‘যে প্রহর কুয়াশার কাছে ঋণী’ আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, বেড়িয়েছে ‘শুদ্ধস্বর’ থেকে। গত মেলায় প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাফল্য দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বের করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। বইটির কবিতায় বিষয়ভিন্নতা রয়েছে। প্রেম থেকে ঐহিকবাদ, ঈশ্বর থেকে নারী – নানা বিষয়ে কবির বিরহ-বেদনা ফুটে উঠেছে পরিষ্কারভাবে।

 

) ধরুন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার বালিশের পাশে একটা প্রদীপ দেখতে পেলেন। এবং কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারলেন এটা আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ! আপনি আপনার যেকোনো তিনটা ইচ্ছে পূরণের সুযোগ পাবেন। আপনার সেই তিনটে ইচ্ছে কী হবে

আমি প্রদীপে ঘষা দিয়ে ঈশ্বরকে বলব আহমদ ছফা, হুমায়ুন আহমেদ এবং কবি আবুল হোসেন’কে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেবার জন্য।

যে প্রহর কুয়াশার কাছে ঋণী

আমি প্রদীপে ঘষা দিয়ে ঈশ্বরকে বলব আহমদ ছফা, হুমায়ুন আহমেদ এবং কবি আবুল হোসেন’কে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেবার জন্য।

বইঃ যে প্রহর কুয়াশার কাছে ঋণী

কবিঃ শামীম আহমেদ

বইয়ের ধরণঃ কাব্যগ্রন্থ

প্রকাশকালঃ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫

প্রকাশনীঃ শুদ্ধস্বর

প্রচ্ছদঃ খেয়া মেজবা

মূল্যঃ ১৩০ টাকা (২৫ শতাংশ মূল্যছাড় পাওয়া যাবে)

সাহিত্যস্বর সম্পর্কে

সরব বাংলাদেশে বই জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কাজ করতে চায়। এই লক্ষ্যে আমরা নানান ধরনের কাজ করতে চাচ্ছি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একুশে বইমেলা ২০১২তে বিভিন্ন ব্লগারদের বই আমরা প্রোমোট করতে চাইছি। প্রতিদিন একজন করে ব্লগার/লেখক এর ইন্টারভিউ আমরা ছাপানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে উদ্যোগ, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।