বেশ কদিন আগে সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা সমগ্র’ -এর একটি গল্প ‘ডা. মুনসীর ডায়রি’ পড়ছিলাম। গল্পের এক পর্যায়ে ফেলুদা ডা. মুনসীর রোগী রাধাকান্ত মল্লিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। রাধাকান্ত মল্লিক যে রোগটায় ভুগছিলেন তার নাম ‘পার্সিকিউশন ম্যানিয়া(Persecution mania)’। তার ভাষায়, ‘আমি যে ব্যারাম নিয়ে এখানে আসি তার নাম আমি জানতাম না। মুনসী বলেন, পার্সিকিউশন ম্যানিয়া। তার লক্ষণ হল, চারপাশের সব লোককে হঠাৎ শত্রু বলে মনে হওয়া। বাবা, দাদা, পড়শী, আপিসের কলিগ কেউ বাদ নেই। সবাই যেন ওৎ পেতে বসে আছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আগে এটা ছিল না; ঠিক কখন যে শুরু হল তাও বলতে পারি না। শুধু এটা বলতে পারি যে শেষ দিকে এমন হয়েছিল যে রাত্তিরে ঘুমোতে পারতাম না, পাছে ঘুমোলে কেউ এসে বুকে ছুরি মারে!’ গল্পটি পড়ার পর অনলাইনে ঘাটাঘাটি করে কিছু তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করলাম। আর যা জানতে পারলাম, তাতে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, ‘আমরা সবাই মানসিকভাবে ঠিক আছি তো?’
মনস্তাত্বিক জটিলতা(Psychological Complex) বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। আর এটি মূলত ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিত্ব ও আচরণের উপর নির্ভর করে।
১। পার্সিকিউশন ম্যানিয়া(Persecution mania): প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই যুগে অনেকের মাঝেই এই সমস্যাটা দেখা যায়। উচ্চাভিলাষী ও সাফল্যের সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে এক সময় এরকমটা মনে হতে পারে, ‘সবাই আমার অর্জনকে ঈর্ষা করছে। কেউ আমার ভাল দেখতে পারছে না। সবাই আমার ক্ষতি করতে চায়।’ সন্দেহের রেশ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় যেতে পারে যে, ধরুন, আপনি রাস্তায় হাঁটছেন। আপনার মনে হবে আপনাকে ফলো করার জন্য আশেপাশে হয়তো অনেক স্পাই আছে। আবার ধরুন, বন্ধুকে বলে রেখেছেন কোন একটি জরুরি কাজে সাহায্য করার জন্য। বেচারা হয়তো নিজের কাজের চাপে বেমালুম ভুলে গেছে আপনার কাজটার কথা। আপনার মনে হবে, হয়তো আপনার বন্ধু ইচ্ছে করেই আপানার ভাল হতে দিবে না, সে হয়তো আপনাকে হিংসে করে। এভাবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কাউকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। ধীরে ধীরে নিজেকে বাইরের জগত থেকে গুটিয়ে নিতে চাইবেন। রাধাকান্ত মল্লিকের মতই আপনার রাতে ঘুম ভাল হবে না পাছে কেউ যদি এসে আপনাকে মেরে ফেলে।
২। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স(Inferiority complex): এটি সাধারণত স্টুডেন্টদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এমনকি আমার নিজেরও এই সমস্যা আছে- হীনমন্যতায় ভোগা। ভাল স্টুডেন্টদের দেখে আমরা অনেক সময় হতাশ হয়ে যাই আর ভাবি, ‘আমাকে দ্বারা এত কঠিন পড়াশুনা হবে না।’ এমনও হতে পারে যে কোন টপিক পড়ার আগেই ধরে নিলাম, ‘পড়ে কি কিছু বুঝতে পারব? কি হবে এত কষ্ট করে? মোটা মাথায় কিছুই তো ঢুকে না।’ পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাসের অভাবে এরকমটা হয়। আবার অনেক সময় মেয়েদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যায়, ‘মেয়েরা তো বিয়ে করে সংসারী হয়, রান্নাবান্না করে। আমার আর এত পড়াশুনা, ক্যারিয়ার নিয়ে টেনশন না করলেও হয়।’ তবে এই সমস্যা উত্তরণের পথ হল, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। ‘আমাকে দিয়ে কি কিছুই হবে না?’– এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। অযথা হা-হুতাশ ও নেতিবাচক চিন্তা করে সুন্দর জীবনকে নিঃশেষ করার কোন মানেই হয় না। ব্যর্থতার মানে এই নয় যে জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
৩। সুপারিওরিটি কমপ্লেক্স(Superiority complex): এটি ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের একদম বিপরীত। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও ক্রমাগত সাফল্যে আপনার মনে হবে, ‘আমি অন্য সবার চেয়ে উত্তম। আমাকে ছাপিয়ে যাওয়ার মত আর কেউ নেই।’ আপনি তখন আশেপাশের সবাইকে, এমনকি বন্ধু-বান্ধবকেও অধম মনে করবেন। আপনার মনে হবে, তারা আপনার বন্ধুত্বের যোগ্য নয়। চরম পর্যায়ে গিয়ে এ ধরণের মানুষেরা ‘Norman psychosis’ এ ভুগে। এ পর্যায়ে সে নিজেকে মিথের বা রুপকথার চরিত্র বলে কল্পনা করতে থাকে ও নিজেকে উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করে।
৪। মারটিয়ার কমপ্লেক্স(Martyr complex): এ ধরণের জটিলতায় আক্রান্ত মানুষেরা ইচ্ছে করেই নিজেদের জীবনে দুর্দশা ডেকে আনে। তারা এমনই ডিপ্রেশনে ভুগেন যে জীবনে উন্নতি করার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলে এবং নিজেরাই ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের ক্ষতি করে হতাশার আশ্রয় নেয়। তারপর তারা তাদের দুর্দশার কথা অন্যকে জানিয়ে করুণা আদায়ের চেষ্টা করে। করুণা বা সান্ত্বনামূলক আচরণ না পেলে তারা তখন আরও হতাশ হয়ে পড়ে ও জীবনকে শেষ করে দিতে চায়। তাই চরম পর্যায়ে এ ধরণের রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
৫। প্যারেনটাল কমপ্লেক্স(Parental complex): ‘As Good as it Gets’(1997) মুভিতে সাইমন যখন মেলভিন ও ক্যারলের সাথে বেড়াতে যায়, তখন নিজের জীবনের গল্প করতে গিয়ে বলে যে, তার বাবা একদিন তাকে তার মায়ের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলায় বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল। সাইমনের বাবার ধারণা হয়েছিল যে তার ছেলে ‘প্যারেনটাল কমপ্লেক্স’ এ ভুগছে। এ ধরণের কমপ্লেক্সের ধারণা দুই ভাগে বিভক্ত- অডিপিয়াস কমপ্লেক্স (Oedipus complex) ও ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স (Electra complex) যা গ্রিক মিথ চরিত্র অডিপিয়াস ও ইলেক্ট্রার গল্প থেকে এসেছে। অডিপিয়াস কমপ্লেক্সে ছেলে সন্তান তার মায়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সে মেয়ে সন্তান তার বাবার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য, এ ধরণের মানসিক সমস্যা ৩-৬ বছর বয়সেই শুরু হয়।
৬। ডন জুয়ান কমপ্লেক্স(Don Juan complex): ‘Two and a Half Men’ টিভি সিরিজের Charlie Harper কে আমরা পারফেক্ট ডন জুয়ান বলতে পারি। এ ধরণের মানুষেরা সাধারণত কোন রিলেশনশিপ বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না এবং কিছুদিন পরপর পার্টনার পরিবর্তন করে। অনেকক্ষেত্রে তারা অজুহাত দেয় যে, তারা পার্টনারের মধ্যে তাদের বাবা-মার মত পারফেকশনিসম খুঁজে পায় নি বলে পার্টনার পরিবর্তন করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এদের অনেককেই সমকামিতা ও বহুগামিতায় ভুগতে দেখা যায়।
৭। গড কমপ্লেক্স(God complex): এই ধরণের জটিলতা বিশেষ করে রাজনীতিবিদ, বিজনেজ লিডার বা উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। তারা এমনই ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায় যে, তাদের অধীনস্থদের মতামতের কোন গুরুত্ব দেয় না এবং নিজের ভুলও স্বীকার করে না। অনেকটা একনায়কের মত আচরণ করতে থাকে। তারা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজতে থাকে। অনেক সময় সোসিওপ্যাথ ও ক্রিমিনালদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা যায় কারণ তারাও মনে করে যে, তাদের এই অবস্থার জন্য সমাজই দায়ী।
৮। ডিপেনডেন্সি কমপ্লেক্স(Dependency complex): এ ধরণের কমপ্লেক্স দুই ভাগে বিভক্ত- পিটার প্যান কমপ্লেক্স(Peter Pan complex) ও সিনডারেলা কমপ্লেক্স(Cinderella complex)। পিটার প্যান কমপ্লেক্সে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে আলসেমি ও শিশুসুলভ আচরণের মাধ্যমে নিজেকে ফ্যান্টাসির জগতে আবদ্ধ রাখতেই পছন্দ করে এবং বিনা কষ্টে সাফল্য পেতে চায়। সে নিজেকে ‘grown up’ বলতে চায় না ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানায়। সিনডারেলা কমপ্লেক্সে একজন মেয়ে তার ক্যারিয়ার ও জীবনের সাফল্য সম্পর্কে উদাসীন থাকে। অজুহাত হিসেবে সে সমাজের নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করে। এভাবে তার মধ্যে পরনির্ভরতা জন্ম নেয়। সে বাড়ির বাইরে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না এবং নিজের কেয়ারিং এর জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে পছন্দ করে।
৯। কমপ্লেক্স অফ গিল্ট(Complex of guilt): এ ধরণের কমপ্লেক্সে আক্রান্ত মানুষ সাধারণত সব ভুলের জন্য কেবল নিজেকেই দোষারোপ করে। নিজের উপর সবসময় নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা এবং মতামতহীনতা- এ ধরণের কমপ্লেক্সের লক্ষণ। এ ধরণের মানুষেরা নিজের ভিন্ন মত থাকলেও তা প্রকাশ না করে সহজেই অন্যের মতামতকে গ্রহণ করে নেয়, কারো বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে অবস্থান নিতে চায় না। এছাড়াও অন্যের কমেন্টকে সবসময় সেনসিটিভলি চিন্তা করে।
১০। হিরো কমপ্লেক্স(Hero complex): এ ধরণের কমপ্লেক্সে আক্রান্ত মানুষেরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজেকে ‘হিরো’ হিসেবে পরিচিত করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা নিজেদের পেশায় বা কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্ট হতে পারে না বা ভাল পারফর্ম করতে পারে না, তারা অন্যদের কাছে নিজের পেশার কঠিন দিকগুলো তুলে ধরে এবং নিজেকে ‘rescuer’ বলে দাবি করে। অনেকটা বলতে পারেন, অন্যের সামনে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য ‘নিজের ঢোল নিজেই পিটানো’র মত একটা অবস্থা।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আমাদের চারপাশের মানুষদের, এমনকি নিজেদের আচরণেও উপরোক্ত নানান অসঙ্গতি খুঁজে পাই। তাই বলে যে সবাইকেই সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে এমনটিও নয়। শুনেছি, বাইরের দেশগুলোতে অনেক পরিবারেরই ব্যক্তিগত সাইকোলজিস্ট থাকে যিনি পরিবারের প্রত্যেকের সাথে কনসাল্ট করেন, কথা বলেন। আমাদের দেশে এটি করা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও কমপক্ষে আপনজন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে আলাপ করলেও মন অনেকটা হালকা হয়। তবে এই জটিলতাগুলো এক্সট্রিম পর্যায়ে পৌঁছালে বা পৌঁছানোর আগেই সেই আপনজনদের উচিত রোগীকে কোন সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া।
রোগের নামগুলোতে যথেষ্ট সৃজনশীলতার ছোয়া পেলাম। পড়ার পর মনে হচ্ছে আসেপাশের কেউই সুস্থ না…নিজে সহ্য :wallbash:
আমার নিজের মধ্যেই ৩ টা কমপ্লেক্সের লক্ষণ মিলে যায়। আমিও সুস্থ নই 😛
😯
ভালো লাগছে। অনেক কিছু জানলাম। বলা বাহু্ল্য নিজের মধ্যেও কতগুলি কমপ্লেক্স খুঁযে পেলাম।
এখনকার জীবনযাত্রা এতটাই জটিল আমার মনে হয় না আমরা কেউই মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ।
ইন্টারেস্টিং লিখা 🙂
অনেক কিছু জানতে পারলাম 🙂
সামনে এই টাইপের আরও ইন্টারেস্টিং লিখা পাবো আশা করছি 😀
আমার লেখা সচরাচর বোরিং ধাঁচের হয়, তবে ভবিষ্যতে এই টাইপের লেখা লিখার চেষ্টা করব 🙂
একটা মন খারাপ কমপ্লেক্স আছে নিশ্চই, আমি সেটাতে ভুগি…… 😛 😛
ভালো লেগেছে লিখাটা… :penguindance:
ধন্যবাদ 🙂 কমপ্লেক্স যে কত ধরণের হতে পারে সেটা আমি অনলাইনে সার্চ দিতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি :thinking: তবে এই দশটি কমপ্লেক্সের কথা কয়েকটি সাইটে পাওয়ায় কেবল এগুলো নিয়েই লিখেছি। আর আমারও কিন্তু প্রায়ই ছোটখাটো বিষয়ে মন খারাপ হয়। ‘মন খারাপ’ নামক কমপ্লেক্স নিশ্চয় আছে 😛