লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের বলা যেতে একটি জাতির আত্মা, জাতির প্রাণ। বই সে আত্মার ধারক, বাহক, প্রকাশক। বারো মাসে তেরো পর্বণের দেশ- বাংলাদেশ। জন্মগতভাবে উৎসবপ্রবণতা আমাদের মাঝে সহজাত ভাবে বিকাশিত হয়। বারো মাসের মধ্যে একটি বিশেষ মাস আমাদের আছে, যার প্রতিটি দিন আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়, চিনিয়ে দেয়, ভাবতে বলে- বাঙালী জাতির আত্মাদের। সেটি বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা, নিজের ভেতরকার ‘আমি’ কে খুঁজে পাওয়ার মেলা, বাঙ্গালিয়ানার মেলা- অমর একুশে বইমেলা।
বইমেলার চিন্তাটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন। ষাটের দশকে তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। তিনি ‘Wonderful World of Books’ পড়তে গিয়ে ‘Book’ এবং ‘Fair’ শব্দ দুটি দেখে বেশ পুলকিত বোধ করেন। বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, সেই চিন্তার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বই মেলা। তারপর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বই মেলার যাত্রা শুরু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৪)
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা এ উৎসবে লেখক- পাঠক- সমালোচক সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত লম্বা সময় জুড়ে উদযাপিত হয় না। প্রতিবছর বইমেলায় লেখক পরিচিতিতে পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক নতুন ও তরুণ মুখকে। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত বছরের মত এবছরও সরব ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, ‘গ্রন্থমেলা ও তরুণ লেখকের ভাবনাগুলো’।
১) নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?
হাসান মসফিক। পুরো নামঃ সৈয়দ মাহবুব মসফিকুল হাসান। জন্মঃ লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। দীর্ঘ নামের কারণে সমালোচিত হয়েছি অনেকবার। জন্মের পর পেয়েছি একান্নবর্তী পরিবারের স্বাদ। প্রায় গোছানো এক মফস্বল, বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে ডলু নদী; এসব আমাকে অন্য যে কারো থেকে যে কোন কিছুকে আলাদাভাবে ভাবতে সহায়তা করে! কৈশোরে পড়াশোনা প্রায় হয়নি। তুমুল মেধাবী হিসেবে শিক্ষা জীবন শুরু হলেও পরে স্কুল পালিয়েছি খুব। খেলাধুলা, সিনেমা দেখা, মাছ ধরা, আড্ডা দেওয়া … এইগুলাই ছিল মূলত কাজ। চট্টগ্রাম শহরে আসার পর থেকে সব দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। আবার পড়াশোনায় ফেরা। আগে যত ফাঁকি দিয়েছি, তা উশুল করে নেওয়া! কিন্তু, একাডেমিক্যালি পড়তে চেয়েছিলাম ফাইন আর্টস; সেটা হয়ে ওঠেনি! সর্বোপরি সাহিত্য নিয়েও শুভপাঠ পাঠ এ শহরে এসেই। বর্তমানে একটি দেশীয় ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যিক বিভাগে কর্মরত এবং বাংলা ভাষার জনপ্রিয় ওয়েবজিন বিভুঁই’র সম্পাদনা পর্ষদের সাথে জড়িত।
২) লেখালেখির শুরু কখন থেকে/ কীভাবে? লেখালেখির পেছনে আপনার পরিবারের কারও বিশেষ প্রভাব আছে কী?
কবিতা লেখার শুরু ২০১১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিক থেকে। এর আগে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রচুর চিঠিপত্র লেখা হয়েছে। তারও আগে কোন কোন কাগজে এক-দুইটা ফিচার লেখা হয়েছে। লেখালেখির পূর্বে বা পেছনে পরিবারের কারো তেমন কোন অবদান বা প্রভাব নেই! আউট বই পড়াটাকে ছোটকাল থেকে প্রায় গর্হিত কাজ বলে জেনে এসেছি। অথচ, পরিবারেও ছিল সাহিত্যের ছাত্র! তবু, ওই গর্হিত কাজের সাথেই মূলত তুমুল প্রেম হলো!
৩) সাহিত্যিকরা স্বভাবত বইপ্রেমী হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে নিশ্চয়ই অনেক বই পড়েছেন, এখনও পড়ছেন। লেখক মাত্রই চেষ্টা করেন, তার চিন্তাগুলোকে তার লেখার মাধ্যমে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। আপনার পঠিত এমন কোন বই কি ছিলো যা আপনাকে লেখালেখি করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে?
আমি সম্ভবত ভীষণ আত্মমগ্ন! এবং আমার জন্মের পর থেকেই পারিপার্শ্বিক সবার কাছ থেকেই শুনে এসেছি তা, অবিরত। সামগ্রিকভাবে নানা কারণে বই, পড়াশুনা থেকে পালিয়েছি খুব। স্কুলে, ক্লাসে যথাক্রমে প্রথম এবং অনেক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে। শহরে আসার পর সার্কেল বদলে গেল। কাজিনদের সাথে মেশামেশি বাড়ল। মামার বাসায় প্রচুর বই ছিল। সেখান থেকে পাঠ শুরু। এর বাইরে কলেজ লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, সিটি কর্পোরেশান লাইব্রেরী এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী থেকে প্রচুর বই পড়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি, পাঠক্ষুধা মিটিয়েছি । এ দীর্ঘ পাঠপ্রসূত ছায়া হয়ত লেখায় দেখা যাবে, যাচ্ছে! পাঠের বাইরে রয়েছে মানুষ, প্রকৃতি সংগীত, যা আমার আত্মার প্রাণায়াম। স্পেসিফিক কোন বই হয়ত সেভাবে নয়… প্রতিদিন যাপন থেকে শিখছি, সমৃদ্ধ হচ্ছি!
৪) অনেকের ধারণা এখন অধিকাংশ লেখকের লেখা একই প্যাটার্নের হয়ে থাকে, নতুনত্ব খুব কম পাওয়া যায় – আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টি?
এক-দুইটি বা কয়েকটি বই বা লেখা পাঠ করে কোন ঘোষণা দিয়ে দেওয়া অবান্তর! প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাহিত্যের যে চর্চা হয়ে আসছে- তাকেও অবহেলা করার কিছু নেই। বরং তাকেও সিরিয়াসলি অন্তর্ভুক্তিকরণ খুব জরুরি। এতেকরে এই সেম প্যাটার্ন ঘোষণার একঘেয়েমি থেকে বেরুনো যাবে। এ ছাড়াও সেন্ট্রালি বেশ এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। খোঁজ নিলেই জানা যাবে!
৫) অনেকসময় দেখা যায়, নতুন লেখক/কবি’র বই পাঠকদের কাছে সেভাবে সমাদৃত হয় না। এটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমাদের সংকীর্ণতা কিংবা সীমাবদ্ধতার প্রকাশ। নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সময়ের পরিবর্তনের সাথে লেখক-পাঠক ধারায়ও বেশ এ হাওয়া লেগেছে। একদিক দিয়ে হয়ত দেখা যায় বা ভাবা যায়- লেখক-পাঠক খুব কাছেই বিরাজ করছে! আদতে হয়তো তা নয়! একজন নতুন বা তরুণ লেখক অনেকগুলো যুদ্ধ করেই সফল হবেন; এটাই বোধয় ভালো! সার্বিক ভাবে যাকে লেখক ভাবা যায়/যাবে এবং যাকে পাঠক ভাবা যায়/যাবে … তার/তাদের মাঝেই সমস্ত দরকারি মনোভাব বিরাজিত হয়ে আছে! তাঁদের বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে না!
৬) একটি বই লেখার ক্ষেত্রে ব্লগে লেখার অভিজ্ঞতা কতোটুকু সহায়ক বলে আপনি মনে করেন?একেবারে সহায়কহীন হয়তো বলা যাবে না। কেননা, হাত মকশো করার একটা ব্যাপার তো আছে! তবে, সামগ্রিকভাবে কোথায় লিখছি তার চে গুরুত্বপূর্ণ আসলে কী লিখছি! যা লিখছি, তার সাথে নিজের চিন্তা-চেতনার সামঞ্জস্য কতটুকু!
৭) লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
লিখব, এমন কোন ভাবনা বা স্বপ্ন থেকে লেখার শুরু হয়নি। বরং বলা যায়- পড়তে পড়তে হঠাৎ লিখতে/লিখায় চলে আসা। তাই, তেমন কোন পরিকল্পনার কথা এখানে পাড়তে পারছি না। আবার, মনে মনে অনেকগুলো কাজের সুর বুনে চলেছি! আগামীর কাজগুলো জানাবে… আমি কী সুর ভাবছিলাম, কীসের বীজ বুনেছিলাম! মূলত এও ঠিক যে, প্ল্যান করে আমার কিছু করে ওঠা হয়নি!
৮) আপনার নতুন প্রকাশিত বই “মায়া ফড়িঙ” সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
মায়া ফড়িঙের বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। “মায়া ফড়িঙ” প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। গণহারে যাকে প্যাটার্ন বলা হচ্ছে- এসবের বাইরে গিয়ে হয়ত অন্যকিছু পড়া যেতে পারে। যা পাঠমাত্রই ভাবনা জগতকে খানিকটা উস্কে দিতে পারে। ভেতরে পুষে রাখা কোন বেদনাকে আইডেন্টিফাই করে, একটা আলাদা ভাষা দিতে পারে! আশকারা দিতে পারে যে কোনো অভিজ্ঞতা লালন করতে… শেখাতে পারে “অন্ধকার” যাপন!
বই – মায়া ফড়িং
কবি- হাসান মসফিক
প্রকাশকাল- অমর একুশে বইমেলা ২০১৫
প্রকাশনীঃ অনুপ্রাণন প্রকাশন, স্টল- ৩৯৯ এবং ০৪ লিটল ম্যাগ চত্বর (বহেরাতলা)
প্রচ্ছদঃ সংগৃহীত চিত্র অবলম্বনে প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন দেবাশীষ মজুমদার
বইটির ধরণঃ কবিতা মূল্যঃ ১৫০ টাকা।