এনিমেল ম্যাগনেটিজম এবং আধুনিক চুম্বক চিকিৎসা

মেসমারের চিকিৎসালয়

ঘরটার কাঠের দেয়ালজুড়ে অদ্ভুদ নকশা আঁকা। জানালাগুলো বন্ধ, এবং ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা। মাপা দূরত্বে বেশ কয়টি বড় আয়নাও রয়েছে। আলোর সংস্থান কয়েকটি বেঢপ লম্বা মোমবাতির সাহায্যে। আপনার এখানে আসার কারনঃ ধরা যাক, প্রচন্ড পেট ব্যাথা। এমন সময় তার দেখা পাওয়া গেলো। ধোপদূরস্ত পোশাক, অভিজাত চেহারা আর ধারালো চোখের অধিকারী তিনি। আপনার সামনের চেয়ারটিতে বসে সেটা কিছুটা এগিয়ে নিলেন যেন তার হাটু আপনার হাটু স্পর্শ করে থাকে। এরপর একজন সহকারী দুটো চুম্বকের টুকরা আপনার পেটে বসিয়ে দিয়ে গেলো। আর সেই লোকটি আপনার বুড়ো আঙ্গুল চেপে ধরে চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। অনেক ক্ষন পর সামনের লোকটি আপনার দুই হাতে আচমকা চড় বসিয়ে দিয়ে তার আঙ্গুলগুলো আপনার মুখের সামনে এনে নাড়াতে থাকলো। আপনার শরীর সেই আঙ্গুলের নাচনের সাথে সাথে প্রচন্ডভাবে কাঁপতে থাকে… একসময় আপনি চোখে মেলে দেখেন লোকটি আপনার সামনে দাড়িয়ে হাসছেন, আর আপনার পেটে ব্যাথা গায়েব! এই সস্মিত লোকটিই হলেন ফ্রানয অ্যান্টন মেসমার, যিনি শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন চিকিৎসক, এবং পেশায়… চিকিৎসকই বলা চলে। আর যেই কাজটি তিনি করলেন সেটাই তার চিকিৎসা পদ্ধতি যার ভিত্তিই হচ্ছে এনিমেল ম্যাগনেটিজম।

দৃশ্যকল্পটি কল্পিত হলেও মেসমার এবং এনিমেল ম্যাগনেটিজমের ব্যাপারটা আসল। মেসমার বিশ্বাস করতেন, আমাদের চারপাশ অদৃশ্য চৌম্বক তরলে ডুবে আছে। আমাদের দেহের মধ্যে দিয়েও এই তরল প্রবাহিত হয়। রোগবালাইয়ের কারনে দেহের ভেতর তার প্রভাবে ব্যাঘাত ঘটে। এসব সহ আরো ২৭ টি তত্ব দিয়ে তিনি ‘এনিমেল ম্যাগনেটিজম’ মতবাদ প্রচার করেন। মেসমার চুম্বকের টুকরা, চুম্বকের দন্ড, লোহায় ভেজানো পানি এসব ব্যাবহার করে সেই প্রবাহ ঠিকঠাক করে দিতেন। তিনি এটাও দাবী করেন যে তার ক্ষমতা আছে রোগীর দেহে নিজের দেহ থেকে অদৃশ্য চৌম্বক তরল প্রবাহিত করার। এভাবে দেহের প্রবাহ ঠিক করার ফলে রোগ সেরে যেত। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে এই ব্যাবসা করে ১৭৭২ থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্রচুর খ্যাতি, অর্থ এবং ভক্তি অর্জন করেন। ১৭৭৭ সাথে একজন অন্ধকে সাড়াতে না পারার কারনে তার ভিয়েনা ছাড়া লাগে। এর পরে প্যারিসে গিয়ে চুম্বক চিকিৎসা করতে থাকেন।

১৭৮৪ সালে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের নেতৃত্বে মেসমারের কাজের তদন্ত চালানো হয়। তার দলে প্রখ্যাত রসায়নবিদ ল্যাভয়সিয়েও ছিলেন। তাদের অনুসন্ধানে মেসমারের রোগ সাড়াতে সফলতার ব্যাপারে দ্বিমত না থাকলেও, তারা একমত হন এই ধরনের কোন ম্যাগনেটিক ফ্লুইড কোথাও নেই এবং মেসমার নিজেও তার শরীর থেকে কোন কিছু প্রবাহিত করতে পারেন না। তার চেয়ে বরং মেসমারের জনপ্রিয়তা, বিশাল ভক্তকূল, চিকিৎসার নাটকীয় প্রকৃয়া রোগীর মধ্যে ভালো হওয়ার যে আশাব্যাঞ্জনা ও আত্নবিশ্বাস তৈরি করে সেটাই রোগমুক্তিকে ত্বরান্বিত করে। তার চিকিৎসা সফলতার অনেকগুলো ঘটনাকে প্লাসেবো এফেক্ট দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়।

ঘটনা হলো ২০০ বছরের বেশি পার হলেও এনিমেল ম্যাগনেটিজমের জনপ্রিয়তা বেশ প্রসংসনীয়। নানান দিক থেকে শোনা যায়ঃ চুম্বক ব্যাবহারে ভাংগা হাঁড় দ্রুত জোড়া লাগে, চুম্বক দেহের রক্ত প্রবাহ প্রভাবিত করে, চুম্বকে ডুবালে খাদ্য পানীয়ের স্বাদ বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। যদিও এটার আসলেই কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই তবে, কিছু প্রকাশিত গবেষনা এর কার্যকারীতাকে সমর্থন করে। যেমন এইটা কিংবা এইটা । খুঁজলে আরো পাওয়া যেতে পারে।
http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/6/67/Transcranial_magnetic_stimulation.jpg
তবে হ্যা, ট্রান্সক্রেনিয়াল ম্যাগনেটিক সিমুলেশন(TMS) নামের এক চিকিৎসা আছে। যাতে রোগীর মগজের নির্দিষ্ট অঞ্চলে তড়িৎচৌম্বক আবেশের মাধ্যমে মাইগ্রেন, ডিপ্রেশন ইত্যাদির চিকিৎসা করা হয়। TMS যদিও বৈজ্ঞানিক, তবে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার বাজারও যে বেশ ভালো সেটা নানান দেশে ম্যাগনেটিক ব্রেসলেট, ব্যান্ড, ইনসোল সহ আরো নানান জিনিসের ব্যাবসা দেখেই বোঝা যায়। দুঃখের বিষয় ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে বাংলাদেশে এমন কোন চিকিৎসককে খুজে পেলামনা। আর পেয়ে গেলেও আপনার আমার ক্ষেত্রে এই ধরনের চুম্বক চিকিৎসা কাজ করবে কি?

তথ্যসূত্রঃ

১। উইকিপিডিয়া
২। Animal Magnetism, Early Hypnotism, and Psychical Research, Adam Crabtree

রুহশান আহমেদ সম্পর্কে

ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লিখতাম, পত্রিকায় পাঠাতাম। ছাপা হতোনা, ভাবতাম দেশে এত লেখক কেন! তারা না থাকলে হয়তো আমার লেখা ছাপাত। যেদিন ব্লগের সাথে প্রথম পরিচয় হয়, আমি যেন আকাশের চাঁদ না, আস্ত একটা গ্যালাক্সী পেয়ে গেলাম। সেই গ্যালাক্সীতেই অবিরত বিচরন, বিট বাইটের প্রহেলিকায় একটু একটু অস্তিত্ব রেখে যাওয়া... পাথর কুঁচি, পাতা বাহার, রঙ্গনে- ভীড় জমালো শৈশবেরা-  রৌদ্রহীন এই বিষন্নতার প্রাঙ্গনে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to এনিমেল ম্যাগনেটিজম এবং আধুনিক চুম্বক চিকিৎসা

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    মজা পেলাম পড়ে। কত কী যে আছে দুনিয়ায়!
    আরেকটা ব্যাপার – এভাবে হাইপারলিঙ্ক না দিয়ে ‘সরব’ স্টাইলে ডাব্‌ল ব্র্যাকেটের মধ্যে ফুটনোটও দেয়া যেতে পারে। তাতে সুবিধাটা হচ্ছে পাঠক শুরুতেই দেখে নিতে পারে যে লিঙ্কটা কিসের, তাতে লিঙ্কে ক্লিক করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়াটাও সহজ হয়। ব্যস্ত পাঠকদের জন্য এইটা বিশেষ দরকারি। 😀

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    বাহ! কত কিছু যে জানার আছে 😀

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ইন্টারেস্টিং তো ! মানুষের ব্রেইনের উপর প্রভাবটা কাজে লাগানো গেলে তো আর ডিপ্রেসডই থাকা লাগবে না। 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।