জীবন, স্বপ্ন ও অভিমান

ভার্সিটি লাইফের প্রথম দিন, প্রথম ক্লাস। চারিদিকে নতুন, অচেনা, অপরিচিত মুখ। স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। প্রথমে মিটিমিটি করে হেসে নিজের পরিচয়পর্ব শেষ করলেন। তারপর আমাদের একেএকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের নাম বল, কোন ইন্সটিটিউট থেকে এসেছ সেটা বল আর তোমাদের কার কি জীবনের লক্ষ্য সেটাও বল।’ একেকজন তাদের জীবনের লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে বলা শুরু করল। আমি কেবল বললাম, ‘পাশ করার পর একটা কোম্পানিতে চাকরি করব হয়তো।’ স্যার বললেন, ‘তোমাদের স্বপ্ন এত ছোট কেন? তোমরা কত মেধাবি! তোমাদের স্বপ্ন হবে গুগল, নাসায় চাকরি করা।’ এরপর থেকে যারাই দাঁড়াচ্ছিল তাদের স্বপ্ন মোটামুটি সেই গুগল, নাসা আর ইউনিভার্সিটির টিচার হওয়া- এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর একটা ছেলে স্যারকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনার কি স্বপ্ন ছিল?’ স্যার হেসে বললেন, ‘ছোটবেলায় আমার স্বপ্ন ছিল পায়ের উপর পা তুলে খাওয়া।’ স্যারের কথা শুনে পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা বলি। বেশ কিছু বছর আগের কথা। ফ্যামিলি পিকনিকে আমরা যাচ্ছিলাম নরসিংদিতে। পথিমধ্যে ট্রাফিক জ্যামে এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইতে আসল। আমার খালাতো বোন ভিক্ষুককে কিছু টাকা দিল। তখন আমার খালাতো বোনের ছোট মেয়ে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি বড় হলে এই ভিক্ষুকদের আর ভিক্ষা করতে দিব না।’ আমরা অবাক হয়ে গেলাম ঐটুকু বয়সের বাচ্চার মুখে এই কথাটা শুনে। আমার বোন ওকে খানিকটা বকা দিয়ে বলল, ‘থাক, এত স্বপ্ন দেখা লাগবে না।’ আমার আরেক খালাতো বোন তখন বলল, ‘থাক না আপ্পি। ছোট মানুষ। ওদেরকে স্বপ্ন দেখতে শেখাও।’

স্বপ্ন। এই শব্দটার অর্থ, গভীরতা, বিস্তৃতি অতি ব্যাপক। আমিও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নগুলো হয়তো অনেক সময় সাধ্যাতীত কিছু হয়ে যায়, আবার কখনওবা খুবই সাদামাটা হয়। কিন্তু নিজের চোখের সামনে স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে দেখা কিংবা স্বপ্নের করুণ মৃত্যু হওয়াটা অনেক বেশি কষ্টের। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণেই মনটা বিশেষ ভাল নেই। ঐ যে বললাম ‘স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়া’, এরই মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আর এখন নিজেই নিজেকে বলি, ‘কি দরকার ছিল এত স্বপ্ন দেখার?! জীবনকে নিয়ে এত উচ্চাভিলাষ কেন করেছিলাম?’ নিজের পতন দেখতে কার ভাল লাগে বলুন। আম্মুর সাথে যখন কথাগুলো শেয়ার করি তখন আম্মু বলে, ‘মানুষের জীবনে উত্থান-পতন থাকেই।’ আব্বু বলে, ‘Failure is the pillar of success.’ কিন্তু এসব কথা মন মানতে চায় না। আশেপাশের কত মানুষকেই তো দেখি তাদের স্বপ্নগুলো কিভাবে সত্যি হচ্ছে, জীবনে কত দ্রুত উন্নতি করে ফেলছে তারা। আর আমাকে কেন এত চেষ্টার পরও হতাশ হতে হবে? সাফল্য কেন আমার হাতে এক বারেই ধরা পড়বে না? এরকম একটা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় আসলে কিছুই ভাল লাগে না। আমারও লাগেনি। মন ভাল করার কম চেষ্টা করিনি। গান শুনলে সচরাচর অনেক ভাল লাগে। কিন্তু মোবাইলের মিউজিক অপশনটাতে ক্লিক করতেও প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা লাগত। ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগত। আর আমি বেশ অন্তর্মুখী স্বভাবের, তাই শেয়ারিং ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রে খাটে না। ক্লাসে যাই, ক্লাস শেষে বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকি। টিভিতে ওয়ার্ল্ড কাপের ম্যাচ হচ্ছে, ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম টিভি স্ক্রিনের দিকে। আমি যেরকম ক্রিকেট পাগল, সেই মানুষটা নাকি ম্যাচের সময় অন্যমনস্ক হয়ে আছে! এমন অস্বাভাবিক অবস্থায় আগে কবে পড়েছি মনে নেই।

এবার বলি মন কিভাবে ভাল হল। মন ভাল হওয়া দুই ধাপে ঘটেছে। প্রথম ধাপটা অবশ্যই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় এই উপলক্ষে। আর দ্বিতীয় ধাপটা অনেকের কাছে খুব তুচ্ছ মনে হতে পারে কিন্তু আমার জন্য তা ছিল ঔষধের মত, মন অনেকটা হালকা হয়েছে।

আমার এক ফ্রেন্ড আমার সাথে রাফার গাওয়া একটা গান শেয়ার করেছিল, বলেছিল গানটা শুনতে। এতদিন শুনিনি। আজ বিকালে শুনলাম। গানটা এমন আহামরি কিছু নয়। গানটার কোন মাহাত্মও নেই। গানের কথাগুলো এমন, “আমি আকাশ পাঠাব তোমার মনের আকাশে, খোলা মাঠে গাইবে গান বসন্তের বাতাসে।”

sky
গানটা শোনার পর আমার মনে পড়ল জানালার ওপাশে ঐ বিশাল আকাশটার কথা। সত্যি তো, এই কদিনে আকাশটার দিকে ভালভাবে তাকাইনি। যদিও শরতের আকাশ আমার অনেক প্রিয়, সাদা, ফ্যাকাশে নীল কিংবা মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেও আমার বেশ ভাল লাগে। আকাশের পরিধি এতটাই অসীম যে নিজেকে খুব নগণ্য মনে হয়। দৃষ্টির সীমানা থেকে টুকরো টুকরো মেঘগুলো ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। মেঘগুলোর কোন তাড়া নেই। ওরা ধীরে ধীরে চলতে থাকে। এভাবেই বিকালের সময়টুকু কেটে যায়। সূর্য ডুবে যেতে থাকে। সূর্যটার জন্যও মনটা খারাপ লাগে। সূর্যটা প্রতিদিন সকালে সেই পুব দিকেই উঠে আর সন্ধ্যার সময় আসলে আকাশের পশ্চিম কোণে টুপ করে ডুবে যায়। সূর্যটা নিঃস্বার্থভাবে তার রঙবেরঙের রশ্মি ছড়িয়ে আকাশকে মুখরিত করে অথচ কালের পরিক্রমায় সেও ক্ষয়ে যাচ্ছে। কই তাও তো সে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় তার আপন অস্তিত্ব ও মহিমা প্রকাশে এতটুকু বিচলিত হয় না। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে হয়তো দুষ্টু মেঘগুলো রোদের কোলে বসে সূর্যটাকে ঢেকে দেয়। তাও সূর্য হাসিমুখে মেনে নেয়। উদাস ও অপার্থিব চিন্তা করলে কত সহজে মন হালকা হয়ে যায়! প্রকৃতির কি অপরূপ লীলাখেলা!

লেখাটি শেষ করব ‘মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট’ নাটকের শেষাংশের কিছু কথা দিয়ে-

জীবনের প্রতি বেশিক্ষণ অভিমান করে থাকা যায় না। Because there’s so much beauty around. সহজ জীবনটাকে আমরাই কত যত্ন করে জটিল করে তুলি। Middle-class sentiment, ধনী-গরিব আমরা সবাই এই রোগে ভুগছি। আমাদের সব কিছুতেই না পাওয়া, বিদ্বেষ, ঘৃণা and we are never satisfied. Life is a gift. আকাশের মত উদার হওয়া শিখো, পানির মত স্বচ্ছ হও, স্বাগত জানাও প্রতিটা দিনকে with your arms wide open. বেঁচে আছি, এইতো অনেক। Let’s uncomplicate.

পাহাড়ি কন্যা সম্পর্কে

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বাস্তব ও কল্পনা আমার দৈনন্দিন জীবনের সহযাত্রী। জীবনকে ভালবাসি। অনেক স্বপ্ন দেখি, যদিও তা বাস্তব থেকে মাঝে মাঝে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। আমি বরাবরই রাশভারী প্রকৃতির মানুষ, স্বল্পভাষী কিন্তু হাসতে খুব ভালবাসি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।