[ সবাইকে ১৪ মার্চ পাই দিবসের শুভেচ্ছা। গণিতের এই বিস্ময়কর সংখ্যাটির বিচারে, গণিতের এক মানববিস্ময়ের জীবনালেখ্য অবতারণা করছি আজ এখানে।]
নাম তার টেরী। পুরো নাম টেরেন্স টাও। টেরীর জন্ম ১৯৭৫ এ।
টেরীর বয়স যখন দু-বছর, টেরীর মা আবিষ্কার করলো, সে পাঁচ বছরী আরেক পিচ্চি কে হাত দিয়ে গুনতে শেখাচ্ছে, যোগ করতে শেখাচ্ছে। পদার্থবিদ্ মা ছেলের মাঝে তখনই হয়তো ভবিষ্যতের গণিতবিদ দেখেছিলেন। কিন্তু, তা যে এত নাটকীয় হবে, তা নিশ্চয়ই ভাবেন নি। বছর গড়াতেই, গণিতের প্রতি বাচ্চার অদম্য ইচ্ছা দেখে, মা তেমন কিছু করতে পারলেন না। কারণ, সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট বাচ্চাকে কোন স্কুলেই যে নেবে না – তাও আবার সে যদি হয় অংকের পোকা।
টেরীর বয়স যখন পাঁচ, তখন সে স্কুলে ভর্তি হলো ঠিকই। কিন্তু, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হালকা অংক তাকে কিছুতেই খুশি রাখতে পারল না। তাই, যখন সে প্রায় নিজ চেষ্টায়, ছয় বছর বয়সেই, “ব্যাসিক” কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে তা দিয়ে অংক খাটাতে শুরু করলো, তখন তার স্কুল শিক্ষক বাধ্য হয়ে, গণিত আর বিজ্ঞান শিখতে হাই স্কুলে ক্লাস করতে সুযোগ করে দিল।

বেচারা সাত বছর বয়সী টেরী গণিত পরীক্ষা দিচ্ছে হাই স্কুলের আপু ভাইয়াদের সাথে। লক্ষ্য করবেন, ভাল মত লিখতে তাকে চেয়ারে হাঁটু মুড়ে বসতে হয়েছে।
যে সব বাচ্চা অল্পবয়সে কোন বিষয়ে দক্ষ হয়ে পড়ে, তাদেরকে ইংরেজীতে ডাকা হয় “প্রোডিজি” বলে। এখন টেরী নামের এই প্রোডিজিকে নিয়ে শুরু হলো পরীক্ষা নিরিক্ষা। পত্রিকায় ছাপা হলো তার নাম। স্বভাবতই, বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নিজের প্রডিজিত্বের প্রমাণ দিতে হলো তাকে। মাত্র আট বছর বয়সে “স্যাট” পরীক্ষায় ৭৬০ নম্বর পেয়ে ইতিহাসে দ্বিতীয় বাচ্চা হিসেবে রেকর্ডের খাতায় নাম লেখাল সে।
গণিতের বিস্ময় হিসেবে এগারো বছর বয়সে (ইতিহাসের কনিষ্ঠতম প্রতিযোগী হিসাবে) আ্ন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েই টেরী, বাঘা বাঘা গণিত-যোদ্ধাদের পরাস্ত করে “তৃতীয়” তাম্র পদক নিয়ে নিল। আরে একটু অপেক্ষা করুন। পরের বছর রৌপ পদক। আর তার পরের বছর, হে হে, স্বর্ণপদক পেয়ে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮৮ সালে তখন তার বয়স তের।
![[IMO Team 1988]](http://www.amt.edu.au/images/root-imgs/imo1988.jpg)
১৯৮৮ সালের অান্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার দল। সামনের পুচকের গলায় ঝুলছে স্বর্ণপদক।
শিশু প্রতিভা টেরীর গল্পের পরের অংশ সহজেই অনুমেয়। ১৬ বছর বয়সে একই সাথে স্নাতক ও স্নাতকত্তর সনদপ্রাপ্ত হয়। আর তারপর বিখ্যাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে পিএইডি যখন নিয়ে নিল, তখন তার বয়স সবে ২১।

একজন গণিতের কিংবদন্তী (পল আর্ডোস) বয়স ৭২, আরেকজন গণিতের রাজপুত্র, বয়স ১০। পরে আর্ডোসের প্রত্যয়নেই টেরী প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইডি করতে যায়।
এধরনের প্রতিভাধর বিশ্বে অনেক পা্ওয়া যায় ঠিক। কিন্তু, লম্বা জীবনের পুরোটা জুড়ে সেই কাজের ধারা ধরে রাখা সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। ব্যতীক্রম সংগীতের বিস্ময় মোজার্ট। আর এখন গণিতে বিস্ময় টেরী।
টেরীর কাছে গণিতটা কোন কঠিন অবোধ্য শ্রাস্ত্র নয়। তার কাছে অনেকটা কলা বা আর্টের মতো। কোন চিত্রকর্ম কিংবা কাব্য রচনায়, যেমন শিল্পীকে তার সৃষ্টির সাথে মিশে যেতে হয়; টেরীর মতে, গণিতের সাথে্ও মিশে যেতে হয়, গণিতকে পেতে হলে। টেরীর সেই গণিতের সাথে মিশে যা্ওয়া, আর দশজন গণিতবিদের মত কাঠখোট্টা নয়। বরং ভীষণ মজার।
টেরীর এই উদাসীন গণিত মগ্নতার কারণেই হয়তোবা, গণিতের কোন নির্দিষ্ট শাখায় আবদ্ধ রাখতে পারেন নি নিজেকে। তাই কালে কালে, সব ডালে ঘুরতে ঘুরতে তিনি হয়ে উঠেছেন সকল শাখার শাখামৃগ, এহেম, সকল কাজের কাজী। আর এ কাজী এমনই অনন্য আর কার্যকর যে, গণিতের যে শাখায়ই তিনি হাত দিয়েছেন, সে্ই শাখার শত বছরের অমিমাংসিত সব গাণিতিক সমস্যার অভূতপূর্ব সমাধান তিনি এনে দিয়েছেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক।
গণিতের যাদুকরী সংখ্যা ‘মৌলিক সংখ্যা’। এই মৌলিক সংখ্যাগুলো আবার আছে সংখ্যারেখা বিভিন্ন জায়গায়।
কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে কয়েকটা মৌলিক সংখ্যাকে একটি ধারা হিসেবে দেখানো যায়। যাকে কি না বলা হয়, মৌলিক সংখ্যার যোগত্তর ধারা। অজানা সংখ্যক শতাব্দি ধরে, সম্ভবত যখন গণিত মৌলিক সংখ্যার বিস্তৃতি নিয়ে কাজ শুরু করে তখন থেকে, ধারনা করা হতো, এই ধরনের ধারার সংখ্যা অসীম। এবং, এ ধরনের ধারার পদ সংখ্যাও অসীমভাবে পাওয়া সম্ভব। এই যে ধারনাটা, তার প্রথম ভাগ প্রমাণ করা হয় ১৯৩৯ সালে। কিন্তু, দ্বিতীয় ধারনাটা ঠিক কি ভুল, তা কারও কাছেই সপ্রমাণ ধরা দিচ্ছিলো না। কিন্তু, হঠাৎ, ২০০৪ সালে এসে টেরী এবং আরেক গণিতবিদ বেন গ্রীন মিলে তা প্রমাণ করে ফেললেন। মজার ব্যাপার হলো, তাদের এই প্রমাণ পদ্ধতিতে তাঁরা তেমন কোন নতুন কৌশল বা গণিতের যাদু আনেন নি। স্রেফ সকল গণিতবিদের কাছে পরিচিত দুটো ভিন্ন রকম তত্ত্বকে এক করেছেন তাঁরা। ‘দৈব’ সংখ্যার বিস্তৃতির মাঝে যোগোত্তর ধারার উপস্থিতির উপর একটি পুরনো প্রমাণ, আর মৌলিক সংখ্যার বিস্তৃতির ‘দৈবত্ব’ নির্ণয়ের একটা তত্ত্বর উপর ভিত্তি করে তারা বের করে ফেলেন এই প্রমাণ।
তাদের এই সহজবোধ্য (অবশ্যই গণিত জগতে) গোবেচারা প্রমাণ দেখে তো কেউ কেউ বলেই বসলেন,
“প্রমাণ তো ঠিক। কিন্তু, আমি এটা আগে দেখলাম না কেন?”
এটাই টেরীর কৃতিত্ব। এরকম আরো অনেক অমিমাংসিত সমস্যা নিয়ে টেরী কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।কেউ কেউ মজা করে বলে থাকেন,
“তুমি যদি কোন কঠিন গাণিতিক সমস্যায় আটকে যাও, তাহলে কোন মতে টেরীর নজর কাড়ার চেষ্টা কর। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। “-চার্লস ফেফারম্যান।
টেরী এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। গণিতকে মজার করে প্রকাশ করার জন্য তার বিভিন্ন লেখা অনলাইনে ছড়ানো। তাঁর নিজের একটা ব্লগও আছে ওয়ার্ডপ্রেসে। তবে, তার এতকিছুর মাঝে, তার যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অর্জন সেটা হলো গণিতের নোবেল ‘ফিল্ডস মেডাল’। গণিতের উপর সবচেয়ে মর্যাদাবান এই পুরস্কার তার কেবল একটা বিষয়ে নয়, গণিতের বেশ কয়েকটি শাখায় তাঁর মৌলিক কাজের স্মীকৃতি স্বরূপ। টেরীর বয়স তখন মাত্র ৩১। ইতিহাসে এত কম বয়সে ফিল্ডস মেডাল আর কারও নেই।
সেখানেই থেমে নেই তাঁর বিচরন। এই গত ২০১৪ এর জুন মাসে তিনি পেলেন নোবেল পুরস্কারের চেয়েও দামী পুরস্কার “ব্রেকথ্রু প্রাইজ-২০১৫”।কিন্তু তাও, চিনা বংশবোদ্ভূত এই বিনম্র ব্যক্তি, নম্রতায় বিগলিত হয়ে বলেছিলেন,
“আমার মনে হয় আমি যথেষ্ট কাজ করিনি। আমি একা এত বড় পুরস্কারের যোগ্য নই। বরং, আরো কিছু মানুষের সাথে দিলে ভাল হয়।”

টেরীর কাছে আমাদের কেবল গণিত নয়, শেখার আছে আরও অনেক কিছু
তিনি এমনকি নিজেকে অসাধারণ বলতেও নারাজ তিনি। তাঁর নিজের মতে তিনি একজন গড়পড়তা গণিতবিদ। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ক্ষণে ক্ষণে গণিতকে ছাড়িয়ে মহাকাশবিদ্যা এমন কি, চিকিৎসা বিদ্যার পর্যায়ে চলে গেছে। আশা করি টেরী আরো অনেক দিন বেঁচে থাকবেন, আর আমাদেরকে উপহার দিবেন আরও আশ্চর্য অনেক গাণিতিক তত্ত্ব।
[এই বিস্ময়কর গণিতবিদ কিছু বইও লিখেছেন। তার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন, এই উইকিপিডিয়া লিঙ্কে]
শুরু করার আগে ভেবেছিলাম কাঠখোট্টা কোন লেখা, কিন্তু পড়তে গিয়ে দারুণ মজা পেলাম।
পুরো লেখার সবচেয়ে প্রিয় অংশ – “তিনি এমনকি নিজেকে অসাধারণ বলতেও নারাজ তিনি। তাঁর নিজের মতে তিনি একজন গড়পড়তা গণিতবিদ।”
সত্যি কথা বলতে আমার মনে হয় মেধাবী মানুষ অনেকই পাওয়া যায়, টেরীর মত না হলেও মেধাবী। সবাই হয়তো নিজের মেধা বিকাশ করে না/করতে পারে না নানান কারণে। কিন্তু একই সাথে মেধাবী আর বিনয়ী মানুষ আমার মতে খুবই কম, তাই এত মেধাবী মানুষটার বিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
অনেকদিন পর লিখলেন ভাই। ওয়েলকাম ব্যাক।